আমি আর আসিব না ফিরে
পাঠকই লেখক ডেস্ক: মারুফ কোন এক জেলার কদমপুর গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মারুফ জন্মের পর থেকেই এই সোনালী দিগন্তময় কদমপুর গ্রামের প্রকৃতির সাথে হাটি হাটি পা পা করে বেড়ে উঠে। সে এখন ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করে। মারুফ ঐ ক্লাসের ফাস্ট বয় এবং তার পরের স্থানটা হাকিয়ে নিয়েছে রোজিনা। সেও অত্যন্ত মেধামুখর মেয়ে, তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সে একজন ডাক্তার হবে। সে এই দেশের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে। আর মারুফ সে তার আশার গগনে বুক পাতিয়া সাম্যর দিকে অগ্রসর হচ্ছে সে এক জন সৎ দক্ষ সাহসী কলম সৈনিক হবে। রোজিনা এবং মারুফ তারা একে অপরের পাঠশালার পরম বন্ধু। একজনের দুঃখে অন্যজন পাশে থাকে। এলাকার মানব সভ্যতা এই বন্ধুত্ব কে হাজারো অভিবাধন প্রেরণ করেন। কারণ তারা এই কদমপুর গ্রামকে জ্ঞানের মশালে সবসময় মাতিলে তুলত।
রোজিনার বাবা এবং মা ছিল শান্ত প্রকৃতিমনা মানুষ। একদিন রোজিনা তার বাবার কাছে বায়না ধরল মারুফ এবং রোজিনাকে ঢাকা মিরপুর চিড়িয়াখানা এবং শিশু পার্ক সংসদ ভবন ইত্যাদি দেখাবে। এসব বিষয়ে কৌতুহল হওয়ার কারণ ইতিপূর্বে সে এসব দর্শনীয় জায়গা সম্পর্কে পরিচিত হয়েছে তাদের পাঠ্য বই থেকে। রোজিনার বাবা বলল এখন তো আমার অনেক কাজ আছে সামনে মাসের নিয়ে যাব। এ কথা বলতেই রোজিনা মুখটা বাঁকা করে বলল বাবা আমার বন্ধু মারুফ কে কথা দিয়ে দিয়েছি। বাবা মেয়ের সাথে কথায় না পেড়ে বলল ঠিক আছে মা নিয়ে যাব। হরতাল অবরোধ করার দরকার নেই। তোদের দুজনকেই নিয়ে যাব। এদিকে মারুফ সে তো একজন সামান্য কৃষক পরিবারের ছেলে তাই সে নিজেকে রঙিন সুতায় বেধে রাখে না। তার মনটা সব সময় নিরব থাকত আর বেশি বেশি লেখালেখিতে নিজেকে সোপর্দ করত। রোজিনা বাবার আরজি পেয়ে খুশিতে বাবাকে বলল বাবা তোমাকে তাৎক্ষণিক সংবর্ধনা দেয়া উচিত, আমাকে কিছু টাকা দাও। এমন কথা বললে আলম সাহেবের মনটা মোমের মতো গলে যায়। কি আর করা রোজিনাকে ১৫০ টাকা দিল। রোজিনা টাকা পেয়েই নিকটস্ত ফুটপাতের বইয়ের দোকান থেকে একটা ডাক্তারি বই কিনে নিয়ে বাসায় আসল এবং এসেই ইহা পেকেট করল এবং দু-হাত প্রসারিত করে গিয়ে বাবার সামনে বলল এই হল তোমার সংবর্ধনা। রোজিনার বাবা পেকেটনা হাতে নিয়ে বলল এটাতে কি আছে। রোজিনা বলল লক্ষী বাবা খুলে দেখনা কি। রোজিনার বাবা পেকেটটা খুলতেই দেখল ডাক্তারি বই রোজিনার বাবা আলম সাহেব বলল এ দিয়ে আমি কি করব। রোজিনা বলল তোমার মেয়ে যখন অসুস্থ হবে তখন তুমি এটা দিয়ে চিকিৎসা করবে। বুঝতে পারলে। আলম সাহেব জবাবে বলল হে গো বুঝতে না পারলে ও পারলাম। রোজিনা বাবাকে এই দিয়ে সে তার বন্ধু এর কাছে গেল এবং গিয়ে দেখে মারুফ লেখালেখি করছে। রোজিনা বলল মারুফ আমরা দুজন আগামীকাল ঢাকায় বেড়াতে যাব। বাবা আমাদের নিয়ে যাবে। এদিকে আলম সাহেব একটা কঠিন পীড়াদায়ক যন্ত্রণায় ভুগতেছিল যা এটা সে কাউকে শেয়ার করত না। আলম সাহেবের লিবারে সমস্যা ছিল।
রোজিনাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার আগের দিন বিধাতা কেন যেন আলম সাহেবের সকল শক্তিকে নিস্কৃতি করে দিল। সকলেই আলম সাহেব কে হসপিটালে নিয়ে গেল। কিন্তু ভাগ্যর লিখন খন্ডাবে কে আলম সাহেবের জীবনের শেষ বাণী টুকু রেখে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেল। এই সুন্দর নিষ্ঠুর পৃথিবী ছেড়ে। কাল বৈশাখীর ঝড়ে পুরো পরিবারটাকে শোকের মাতমে বয়ে ছিল। রোজিনা চিৎকার করে কান্না করতে লাগল, তার কান্নার পরশে আজ আকাশ বাতাস যেন কম্পিত সব বাতাসের গতি যেন স্তিমিত হয়ে গেল। মারুফ রোজিনাদের বাসায় আসল এবং অশ্র“ সিক্ত ব্যথার যন্ত্রণায় তার নয়নে অশ্র“র ধারে বন্যা বইতে লাগল। বুকের ভেতরটায় মনে মনে নিশ্বাস নিচ্ছে। রোজিনার বুক ভাসানো কান্না সকলেই মনের সিক্ত মাধুরী দিয়ে দেখছে। রোজিনা ঐ ডাক্তারি বইটা হাতে নিয়ে তার বাবার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল বাবা এই হৃদয় জড়ানো বই দিয়ে, আমার চিকিৎসা করবে না। এভাবেই কান্নাকাটি করে শেষ বিদায় দিয়ে দিল বাবাকে ঐ মাটির ঘরে। রোজিনার মনটা যেন একটু ক্ষিণতার পরশে গভীর ভাবনার গন্ডিরে নিজেকে রেখে দিয়েছে। তবু রোজিনা ব্যথার কারাগার থেকে নিজেকে মুক্ত করে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ সে এদেশের সেবক হতে চায়। তার পিতা চিকিৎসার মরণ কামরায় ছিল তাই সে তার প্রতিশ্রুতিটাকে দৃঢ় আজ্ঞা করল।
সে আজ চিন্তা করছে তার বাবা চিকিৎসার অভাবে দুনিয়া ছাড়ল। কিন্তু ভাগ্যর ইতিহাস। আজ রোজিনার পরিবারকে কি শক্তি যেন ধ্বংসের ভয়াল কবলে ঠেলে দিচ্ছে। ঐ দিকে মারুফ, সে ও অর্থের অভাবের তাড়নায় ক্ষুদার যন্ত্রণায় মাঝে মাঝে এই যন্ত্রণাটুকু কবিতা কিংবা গল্পে তুলে ধরেন কলমের কালি দিয়ে সাদা কাগজে। সে এতে শান্ত কেননা আজ তার জীবনে এমন জীবন সংগ্রাম না আসলে সে কিভাবে কলম চালাত। ভাবতে অবাক লাগে ৬ষ্ঠ শ্রেণির একজন কিশোরের লেখার হাতে এত মাধুরী এত আলোর ঝলক। এই চমৎকার দৃশ্য না দেখে বুঝা যাবে না। যা ভাবুকের ভাবা অতুলনীয়। এভাবে তাদের জীবনে একটা বছর পার করে ৭ম শ্রেণিতে পদার্পণ করল। রোজিনা এবং মারুফ তারা আবারো আশানুগতীত রেজাল্ট নিয়ে জ্ঞানের মহিমার স্থানটুকু দখল করল। সকলেই তাঁদের সামনের দিকে অগ্রসর হতে সহসার বাণীটুকু প্রধান করেন। মানুষের জীবন পাতা যে কিভাবে রচিত হয় তা নিজের না আসলে বুঝা নিদারুন। আসলে রোজিনার জীবনের পাতা ও বিধাতার এভাবেই সাজানো। কি করার ভাগ্যের আকাশকে বাস্তবতাকে এভাবেই মেনে নিতে হবে রোজিনার মা ও বাদ্যবৎ জনিত কারণে পরলোকে গমন করেন রোজিনার শেষ মায়ের বুকটাকে ও হারাল যেখানে একটু নিড়ে নিজেকে মাথা রেখে শান্তিতে শয়ন। রোজিনা মা এবং বাবাকে হারিয়ে ৬ মাস পাথর হয়ে আকাশ বাতাসে বুকের মতো চেয়ে থাকত এদেশের প্রতিটি ধুলি বালু আকাশে বাতাসে উড়ছে সে এখন নিস্তব্ধ এদিকে মারুফ সে ও বন্ধুর ব্যথায় নিজেকে জড় পদার্থ করে ফেলেছে। অবশেষে রোজিনাকে শেষ মাথা গুজার সম্বল হিসাবে তার বড়ো বোনের বাসায় চলে গেল শহরে। রোজিনা শহরে গিয়ে নতুন ভাবে লেখাপড়া শুরু করে। এদিকে মারুফ সে গ্রামের নদী নাখা খাল বিল হাজারো প্রকৃতির মাঝে থেকে ও যেন মাহাশুন্যর মাঝে বিরাজ করছে কষ্টের বাঁধ তাকে প্রতিটা মুহুর্তে চিরে চিরে খাচ্ছে বন্ধু কে হারানোর কথায়।
মারুফ গ্রামের বকুল তলার নিচে বসে ভাবতে লাগল বিধাতা কেন আমাদের এই ছোট দেহকে সংগ্রামী জীবন দান করল, আমাদের কেন পৃথিবী বন্দী কারাগারে থাকতে হবে। মারুফ বুঝতে পারল প্রভু এভাবেই তার বান্দাদেরকে হাজারো প্রতিকূলতার মাঝে শ্রেষ্ঠ করে তুলেন। ঐদিকে রোজিনা নতুন বছরের নতুন ক্লাসে ক্লাস করছে কিন্তু আগের মতো মনের গহীন ভালোবাসা দিয়ে বইকে আকড়ে ধরতে পারে না। সে শুধু ভাবে তার মা বাবার হারানোর মিশনময় স্মৃতি। তবু রোজিনা লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এরই মাঝে রোজিনার জীবনে আরেকটি ঝড় এসে প্রবল বেগে তছনছ করে দিল। রোজিনার শিক্ষা জীবনে। রোজিনার বোনের পরিবার অর্থ যোগান দিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনে কলম খাতাকে দূরে সরিয়ে দিতে হলো। ঐ দিকে মারুফ গ্রামের নদী নালা খাল বিল আকাশ বাতাস ধূলি কনা নিয়ে নিজের লেখনী কলম সৈনিকের মতো চালাচ্ছে। কিন্তু ভয়ই দুঃখজনক বিষয় এত মনের মাধুরী দিয়ে লিখা অর্থের জন্য জনসাধারণের কাছে পৌছাতে পারল না। আজকে এই পৃথিবীর মানুষকে মনের লুকানো তপ্ত ব্যথা গুলোকে জানাতে ও অর্থের প্রয়োজন ঐ দিকে রোজিনা লেখাপড়া থেকে অবসর নিল সে এখন নিরব পাখির মোহ হা-হা করে কাঁদে। তার যন্ত্র বুনা জাল ছিড়ে তছনছ হয়ে গেল। রোজিনা একদিন পড়ন্ত বিকালে খাতা এবং কলম নিয়ে মারুফ এর কাছে এবং তার বন্ধুদের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখা শুরু করল চিঠিতে মোটা কালির কলমে প্রথমেই বড় করে লিখা “আমি আর আসিব না ফিরে” এর মানে আমি আর ঐ গ্রামে ফিরে আসব না। যেখানে আমার মা বাবা ঘুমন্ত। আমি আর ফিরব না বিদ্যালয়ের বিদ্যানিকেতনে। এ চিঠি লিখে গ্রামের পোষ্ট অফিসের ঠিকানায় মারুফ এর নামে পাঠিয়ে দিল। মারুফ চিঠিটাতে চোখ বুলিয়ে দু নয়ন দিয়ে বিজিয়ে দিল চিঠিটাকে। মারুফ চিন্তা করল সে তার বন্ধু রোজিনাকে একটি বারের জন্য দেখে আসবে তাই সে তার বাবা মাকে বলল মারুফ মা বাবা বলল বাবা তুমি কি এসব চিন। মারুফ বলল বাবা এই চিঠির মধ্যে প্রেরকের ঠিকানা আমার পেতে মনে হয় কষ্ট হবে না। এরপরের দিন মারুফ মা-বাবার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল শহরের উদ্দেশ্যে। মারুফ গ্রাম থেকে হেটে বাসষ্ট্যান্ডে গেল এবং টিকেট নিল।
বাসে উঠল বাস চলতে লাগল। ঐদিকে রোজিনাও জানে না মারুফ শহর তার সাথে দেখা করতে আসছে। কারণ রোজিনার গ্রামের কারো সাথে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না। মারুফ যে গাড়িতে ছিল তা অনেক দ্রুত চলছে। হঠাৎ ড্রাইভার সাহেব দেখল সামনে থেকে একটা ট্রাক আসছে দেখতে না দেখতেই বিকট আওয়াজে দুটো গাড়ি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন মারুফ। এই অকাল মৃত্যু ইহা তে বিধাতার দান পুলিশ মারুস সহ ৭ জনের লাশ এবং ৩০ জনকে আহত মেডিক্যাল সোর্পদ করে। সকলের লাশ যার যার স্বজনের কাছে পৌঁছে দিল কিন্তু মারুফের চেহারা বিকৃতি হয়ে যাওয়ায় স্বজনের সাড়া মেলেনি অবশেষে পুলিশ কাষ্টরিতে তার জানাযা হয়ে দাফন করে নিল। কিন্তু আজ ও জানে না মারুফের বাবা তার ছেলে কোথায়। গ্রাম থেকে দিনের এবং রাতে প্রহর গুনতে থাকে মারুফ আসবে আসবে বলে। ঐ দিকে রোজিনা দিন দিন নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে সে জানে না মারুফ তার আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। আজ রোজিনা শুধু দেহ নামের দহেটা নিয়ে বেঁচে আছে। বাকী জীবন কিভাবে কাটবে তা আর জানা নেই।
লেখক: মোঃ সেলিম মিয়া
গ্রাম- ভিটিপাড়া, ডাকঘর- সিংহশ্রী,
উপজেলা- কাপাসিয়া, জেলা- গাজীপুর।
মোবাইল : ০১৯৩০০-৪৯৮৪৫, ০১৭৬৬৬-৩২৮১৫
০৭ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এইচএস/কেএস
�