পুলিশ একাডেমিতে ট্রেনিং করার পর থেকে যেকোনো খারাপ মুহূর্তে শান্ত থাকার দক্ষতা আয়ত্ত করতে পেরেছিলাম। একবিংশ শতাব্দির সব থেকে দুর্গম পথগুলোর মধ্যে একটি হলো দিরাই থেকে জগন্নাথপুর উপজেলার খাগাউরা গ্রামের রাস্তা। এখনতো তাও রাস্তা-ঘাট হচ্ছে। কয়েক বছর আগেও নাকি মাইলের পর মাইল হেটে যেতে হতো আর বর্ষার একমাত্র মাধ্যম নৌকা।
সমুদ্রের মতো হাওর পারি দিয়ে আমার স্ত্রী যেত তাদের নানার বাড়ি। এসব গল্প শুনে শুনে যখন অটোরিকশা করে এগুচ্ছিলাম তখন রাস্তায় একটি ছেলেকে হামাগুড়ি দিতে দেখলাম। আমাদের ড্রাইভার অটোরিকশা গিয়ে থামাল ছেলেটির পাশে। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো ভিক্ষুক হবে। কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম "Don't judge a book by its cover"।
ড্রাইভার আমাদের অনুমতি নিয়ে ছেলেটিকে গাড়িতে তুলে নিলো, কারণ এটা নাকি এই ছেলের জন্য অলিখিত নিয়ম। যার গাড়িতে সিট খালি থাকবে ছেলেটিকে সেই নিবে।
গাড়িতে উঠেই সালাম দিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? গল্পে গল্পে জানা গেলো নাম, ঠিকানা আর পরিবারের আর্থিক অবস্থার কথা। আমি এর কয়েক সেকেন্ড আগেও জানতাম না যে পৃথিবীর অন্যতম একটি সংগ্রামী জীবনের গল্পের সাক্ষী হব। যে সংগ্রামের গল্প শুনে মনের অজান্তেই চোখে দুই ফোটা অশ্রু ছলছল করবে, অনুপ্রাণিত করবে আমার মতো হাত পা আছে এমন হাজারো মানুষকে। যে গল্প বদলে দিতে পারে কোনো নাম না জানা ছাত্রের জীবন। যে গল্প শুনে নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে ভাগ্যবান ব্যক্তি মনে হবে। প্রায় ১৫ মিনিট গল্পের মাধ্যমেই শেষ হলো আমার দেখা একজন স্মার্ট, সাহসী, নির্ভীক, অকুতোভয় নায়কের সঙ্গে জীবনের সেরা একটি জার্নি। জার্নি বাই অটোরিকশা। যাকে আমরা স্থানীয় ভাষায় টমটম বলি।
ছেলেটির নাম জসিম উদ্দিন। বাড়ি দিরাই উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামে। হত দরিদ্র পরিবারের তিন ভাইয়ের মধ্যে জসিমউদ্দিন ছোট। উপার্জনক্ষম বৃদ্ধ বাবা-মা এবং দুই ভাইয়ের সংসারে টেনেটুনে চলে তাদের। অজপাড়াগাঁয়ে অত্যন্ত গরিব ঘরে জন্মগত প্রতিবন্ধী ছেলে গরিব পরিবারের জন্য যেন মরার ওপর খরার ঘা। যেখানে সুস্থ সন্তান লালন করাই কষ্টকর সেখানে হাটতে চলতে পারে না এমন সন্তান একটি অসচ্ছল পরিবারের জন্য অভিশাপ ছাড়া আর কি হতে পারে?
কিন্তু জসিম উদ্দিনের পরিবার অন্য আর দশটি পরিবারের মতো না। তারা চায়নি জসিমউদ্দিন রাস্তায় হামাগুড়ি দিয়ে ভিক্ষা করুক, অন্যের করুণায় বেঁচে থাকুক। তার পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার জন্য পরিবারের সবাই সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সাধ্যমতো। আর জসিমউদ্দিনও পরিবারের বোঝা হতে জন্মায়নি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার অজুহাতে সেও কারও কাছে হাত পাতে না।
তার প্রতিটি কথা আমাকে মুগ্ধ করেছে। তার ইচ্ছা শক্তি আর আত্মবিশ্বাসের গভীরতা দেখে আমার একটা কথাই মনে হয়েছে এই ছেলে একটা কিছু হবেই। সে স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশের কোনো একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করবে। ভালো একটা চাকরি করবে। তার কথা শুনে মনে হলো সেটা কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ এভাবে আত্ম প্রত্যয়ী ছেলেকে কোনো বাধাই থামিয়ে রাখতে পারবে না।
জসিমউদ্দিন দিরাই উপজেলার তেতৈয়া প্রাইমারি স্কুলে (নিম্ন মাধ্যমিক পর্যন্ত) অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। ৩১ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে তার রোল নম্বর ৬। স্কুলের শিক্ষকরাও যথাসাধ্য চেষ্টা করেন সবধরনের সাহায্য করার। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে কিছু সাহায্য করতে চাইলেও সে আগ্রহী ছিল না। সে জানায়, যদি ভবিষ্যতে কখনও প্রয়োজন হয় তাহলে জানাব। তার ব্যক্তিত্ব আবারও মুগ্ধ করে আমাকে।
মোবাইল নম্বর দিয়ে বললাম যেকোনো প্রয়োজনে কল দিতে। একদিন অপরিচিত একটি নম্বর থেকে কল পেয়ে পরে ব্যাক করলাম। সালাম দিয়ে বলল, স্যার আমি জসিম উদ্দিন। নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি চিনে ফেলি। এখন মাঝে মধ্যেই কথা হয় জসিম উদ্দিনের সঙ্গে। সে কখনই বলে না আমাকে সাহায্য করেন। কেবল বলে দোয়া করবেন। আসলেইতো, জসিম উদ্দিনের সব থেকে বেশি প্রয়োজন দোয়ার।
লেখক : ফাহাদ মোহাম্মদ, পুলিশ সার্জেন্ট