শপিং মলে ঢোকার সময় আপনার চোখের সামনে যদি একজন পুরুষ চেকার আপনার বউকে হাতিয়ে চেক করে কেমন লাগবে দেখতে? আপনার মেয়েটার বাড়ন্ত গড়নে নতুন পোশাক বানাতে গিয়ে গায়ের মাপ দেয়া ছাড়া উপায় নেই, একজন পুরুষ দর্জি ফিতা নিয়ে এগিয়ে আসছে আপনার মেয়ের শরীরের মাপ নিতে, দেখতে ভালো লাগবে? ধরুন আপনার মায়ের পায়ুপথে বা যোনী পথে গুরুতর সমস্যা। কয়েকজন পুরুষ ডাক্তার মিলে কাপড় আগলে চেক আউট করছে আপনার মায়ের সমস্যা, দেখতে শোভনীয় লাগছে?
আমি কিন্তু মোটেই এইসব প্রফেশনে থাকা পুরুষদের চারিত্র নিয়ে কথা বলছিনা। আমি বলছি দেখার কথা। সারাবছর আগলে রাখা মা, বউ, বোন, মেয়ের গোপনীয়তা যখন সমস্যার সূত্র ধরে পুরুষদের হাতের নাগালে চলে যায় তখন সেই দৃশ্যটি দেখতে কেমন লাগে? আমি জানি, এই দৃশ্যটি দেখায় যেমন দৃষ্টিকটু তেমনি যার সাথে এসব ঘটে তার জন্যেও বিষয়টা অস্বস্তির।
তবুও কিছু তিন চোখা পুরুষ আছেন, যারা প্রথম চোখে কর্মজীবী নারীর বিরোধী, দ্বিতীয় চোখে পরিবারের জন্য কর্মজীবী মহিলাদের সার্ভিস নিতে বেশ আগ্রহী, তৃতীয় চোখে, "বউ, মেয়েকে চাকরি করতে দিয়েন না ভাই, এটা কেমন দেখায়? বউয়ের ইনকাম খাবেন?" ইত্যাদি নেতিবাচক কথা বলে অন্যান্য পুরুষদের উস্কে দেন নারী চাকরির বিরুদ্ধে। আমার যদি ক্ষমতা থাকতো আমি এইসব পুরুষদের জন্য মহিলা সার্ভিস ততোদিন নিষিদ্ধ ঘোষণা করতাম যতোদিন তিনি নারীর উপার্জন ক্ষমতার প্রতি সম্মান ফিরিয়ে না আনবে।
হ্যাঁ, ব্যক্তিগত পছন্দের জায়গা থেকে নিজের স্ত্রীকে, মেয়েকে চাকরি করতে দিতে নাই পারে, তিনি তার বউয়ের পরিচয় নিজের নামে তৈরি করতে চাইতে পারেন, আমরাতো কতোই মিসেস আবুল, মিসেস কাবুল, মিসেস হাবলু ইত্যাদি পরিচয় তুলে ধরা নারীদের সাথে পরিচিত হই, সেটা কোন সমস্যা নয়, অপমানেরও নয়। তাই বলে প্রত্যেকেই তার স্ত্রীকে নিজের নামে পরিচিত করাবে অথবা প্রত্যেক স্ত্রীই স্বামীর ট্যাগ লাগাবে এমনটা ভাবা অনুচিত এবং এমন পরামর্শ দেয়াটাও অনৈতিক বলেই মনে করি। খুব সম্ভব এধরণের পুরুষদের জন্যই একটা প্রচলিত কথা আছে, "অভাগার গরু মরে, ভাগ্যবানের মরে বউ"।
যাইহোক, একজন স্ত্রী যদি চাকরি করে এতে আখেরে লাভ ওই সংসারটার। পার্টিতে মিসেস আমজাদ পরিচয় দেয়া নারীটার থেকে ব্যাংকার সীমা, আর্টিস্ট রেবা ইত্যাদি পরিচয়টা নজরকাড়া হয়। বিপদে এর ওর থেকে ধারদেনা করার চাইতে বউয়ের বেতনটা ব্যবহার করা সম্মানের, এতে পাড়াপ্রতিবেশির কাছে ছোট হয়ে থাকতে হয় না। যেই পুরুষটা বউকে চাকরি করতে দিতে চায়না সেও যেমন সুখি জীবন চায়, যে চাকরি করতে দিতে চায় সেও সুখি জীবন চায়। যে নারী চাকরি করে সেও যেমন টাকা চায়, যে চাকরি করেনা সেও চায়। অনেক গৃহিণীকে দেখেছি, সংসারে এই খাত সেই খাত দেখিয়ে বরের টাকা নিয়ে নিজের কাছে জমিয়ে রাখে, সংসারের বিপদে এগিয়ে আসার জন্য।
এই টাকাটাকে আমি বলি চুরি করা টাকা। বরকে ঠকিয়ে জমানো টাকা। একজন চোর বউ তৈরি না করে একজন সাবলম্বী বউ তৈরি করাটা গর্বের না? বুড়ো বয়স পর্যন্ত একা খেটে একটা বাড়ি করে, সেই বাড়িতে নিজে থাকার আগেই গড় পরতা মৃত্যুর বয়স দরজায় কড়া নাড়ার চাইতে যৌবনে স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে সখের বাড়িটা করে বুড়ো বয়সে সেই বাড়িতে আরাম করাটা আনন্দের না? দোকানে গিয়ে একটাকা কম খুঁজতে গিয়ে পায়ে ব্যথা করার চাইতে একটাকা বেশি দিয়ে কিনে দু'জন মিলে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করাটা কি খুব বেশি খারাপ হবে?
বলছিনা নারীকে চাকরি করতেই হবে। কিন্তু নারীর চাকরি করাটাকে কোনভাবেই দৃষ্টিকটু করা যাবেনা। আজকাল লোকে এও বলে, চাকরি করা মায়েদের সন্তান খারাপ হয়। রানা প্লাজা, তাজরিন, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন, ভবনে রডের বদলে বাঁশ, খাল ছাড়া ব্রিজ, ঘুষ দুর্নীতি, প্রশ্নফাঁস, ঋণখেলাপ, দুর্নীতির স্ক্যান্ডাল এগুলো কারা করেছে? এদের অধিকাংশ গৃহিনী মায়ের সন্তানেরাই করেছে। কেননা, তাদের মায়েদের যুগে চাকরিজীবী নারী অমাবস্যার চাঁদ ছিল। আজকাল এও বলা হয়, মায়েরা নাকি সন্তানদের সময় দিতে পারেনা।
আচ্ছা, যেই যুগে নারী চাকরি করতোনা, সেই যুগে কি মায়েরা সন্তানদের খুব সময় দিত? জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অসচেতনতার কারণে একেক মা আট দশটা সন্তান জন্ম দিতেই ব্যস্ত৷ গর্ভাবস্থার সময়টা এতো সহজ? যৌথ পরিবার ছিল বিধায় জন্মানো সন্তানেরা দাদী, নানী, চাচী, ফুপুর হাতেই বেড়ে উঠেছে, মায়েরা ব্যস্ত থাকতেন অনাগত সন্তানের যত্নে, নিজের যত্নে। তারা বেশ গর্ব করে বলেন, "আমরা পোলাপান এতো লুতুপুতু কইরা মানুষ করি নাই, মাঠে ঘাটে ছাইড়া দিছি, দৌড়ায়া মানুষ হইছে।" এই ডায়লগে তাদের সন্তান বড় করার প্রক্রিয়াটা ধরতে পারছেন? সেই তুলনায় একজন কর্মজীবী নারী তার একটা বা দুটো বাচ্চাকে অনেক বেশি সময় দিতে পারে, অনেক বেশি আদর করতে পারে।
আপনারা যারা বউকে চাকরি করতে দিয়ে বা দিতে চেয়েছেন বলে ঠাট্টার ছলে অনেক কটু কথাই শুনিয়েছে, কথা প্রসঙ্গে বলেছে "অভাগার গরু মরে, ভাগ্যবানের মরে বউ" তাদের রিপিটে আপনিও শুনিয়ে দিন, "অভাগার গরু মরে, ভাগ্যবানের বউ চাকরি করে"। আমি বলছি না পরিবার বাদ দিয়ে শুধু ক্যারিয়ার, চাকরি নিয়েই পড়ে থাকতে।
আমি বলছি, নারীদের চাকরী করা মোটেও অসম্মানের নয় বরং সম্মানের। পরিবার, সমাজ ও দেশের অর্থনৈতিক কল্যাণে বেশ সহায়ক। একজন নারীর পক্ষে পরিবার দেখেও, সন্তান লালন পালন করেও চাকুরী করা সম্ভব যদি স্বামীর ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাপোর্ট ও উৎসাহ থাকে। তাই নারীদের উন্নতির পথে বাঁধা হয়ে না দাঁড়িয়ে আসুন সহযোগিতা করি। নারী পুরুষ মিলে একটা সুন্দর সমাজ এর কামনায় নারীর নিরাপত্তা ও সর্বাঙ্গিন উন্নতির জন্য শুভকামনা রইল।
Romana Akter - শুদ্ধবালিকা