সোমবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯, ০৩:৩৬:৫৪

৪৫ বছর ধরে খুঁজেও যে বিমান ছিনতাইকারীর হদিস পায়নি এফবিআই!

৪৫ বছর ধরে খুঁজেও যে বিমান ছিনতাইকারীর হদিস পায়নি এফবিআই!

বিচিত্র জগৎ ডেস্ক: ভদ্রলোক বিমানে উঠে একদম পিছনের আসনে বসলেন। বিমান সেবিকা কাছে আসতেই তাঁর হাতে ধরিয়ে দিলেন একটি চিরকুট। বিমান সেবিকারা এমন ঘটনার সঙ্গে অভ্যস্ত। ওই বিমান সেবিকা ভেবেছিলেন নিশ্চয় ওই যাত্রী তাঁর সঙ্গে ফ্লার্ট করছেন। বিমান সেবিকার মুখ দেখে ওই যাত্রী আন্দাজ করেছিলেন সেবিকা কি ভাবছে। সেবিকাকে চাপা গলায় কিছু কথা বলেন ওই ব্যক্তি।

বিমান সেবিকা ধীরে ধীরে ওই যাত্রীর পাশে গিয়ে বসেন। তারপর যা ঘটনা ঘটেছিল তা আজও রহস্য এবং ভয়ংকর। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ে কাছেও সেই ব্যক্তি রহস্য এবং ভয়ংকর হয়ে থেকে গিয়েছে।

ডিবি কুপার, এফবিআইয়ে ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিলেন প্রেম নিবেদনের মতো ওই চিঠির মাধ্যমে। আসলে ওই চিঠিতে প্রেম বলে কিছু ছিল না। ছিল বিমান হাইজ্যাকের হুমকি এবং অনেক টাকার চাহিদা। বিমানটি হাইজ্যাকও করে কুপার। কিন্তু টাকা নিয়ে মাঝ আকাশের মধ্যে বিমান থেকে লাফ দিয়ে দেয়। এফবিআইয়ের দুটি স্পেস্যাল বিমান কুপারের হাইজ্যাক করা বিমানকে ধরবার জন্য পিছু নিয়েছিল। সবার অলক্ষ্যে প্যরাস্যুট নিয়ে কুপার ঝাঁপ দেন বিমান থেকে। তারপর কোথায় গেলেন কুপার? শত খুঁজেও তার কোনও খোঁজ মেলেনি। বহু বছর এফবিআইয়ের আতঙ্কের কারণ ছিল এই কুপার। কিন্তু রহস্য থেকে গিয়েছে রহস্যই।

ঘটনা ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বরের। আমেরিকার পোর্টল্যান্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চল্লিশের মাঝামাঝি বয়সী এক লোক আসলেন ওয়াশিংটন এর সিয়াটলে যাত্রার উদ্দেশ্যে। পাঁচ ফুট ১০ ইঞ্চির একটু বেশি উচ্চতার লোকটির পড়নে কালো স্যুট আর রেইনকোট। কালো প্যান্ট এর সাথে বাদামী লোফার জুতা। গলায় কালো টাই বাঁধা। হাতে অ্যাটাচি কেস। বিমানবন্দরে এসে ২০ ডলার দিয়ে নর্থওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের ৩০৫ নম্বর ফ্লাইটের টিকেট কিনলেন সিয়াটল যাওয়ার উদ্দেশ্যে। টিকিটে নাম লেখালেন ড্যান কুপার।

বোয়িং ৭২৭ বিমানটি সেদিন বিকাল তিনটে নাগাদ যাত্রা শুরু করেছিল। কুপার বসেছিলেন সবার পিছনের সিটে। একটু পর ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট ফ্লোরেন্স শেফনার এর কাছে দুই গ্লাস ড্রিংকস অর্ডার করেন। শেফনার ড্রিংকস নিয়ে আসলে তাকে একটি চিরকুট ধরিয়ে দেন কুপার। শেফনার মনে করেন কুপার হয়তো তার সাথে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করছেন।

চিরকুটে হয়তো তার ফোন নম্বর দিয়েছেন মনে করে সেটা না পড়েই পার্সে রেখে দেন শেফনার। বিষয়টি লক্ষ্য করে কুপার নিচু গলায় বলেন, ‘ম্যাডাম আপনার উচিত চিরকুটটি পড়ে দেখা। আমার সাথে বোমা আছে।’ শুনে ভীত সন্ত্রস্ত শেফনার চিরকুটটি খুলে দেখেন। চিরকুটে সেটাই লেখা ছিল। শেফনারকে তখন কুপার তার পাশের সিটে বসতে বলেন। শেফনার সেটা করতে বাধ্য হলেন। কুপার তখন এটাচি কেস বের করে তার ভিতর রাখা বোমা দেখালেন।

শেফনারকে তখন কুপার জানান সিয়াটলে অবতরণ করার পর তাঁকে যেন নগদ দু’লাখ ডলার দেওয়া হয়। সাথে দু’টি ফ্রন্ট প্যারাস্যুট ও দু’টি ব্যাক প্যারাস্যুটেরও দাবি জানান তিনি। আর বিমানবন্দরে যেন ফুয়েল ট্রাক থাকে, সাথে কিছু খাবার। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে কুপার দু’লাখ ডলার চাইছিলেন সব যেন ২০ ডলারের নোট হয়। সেসময়ের দু’লাখ ডলার মূল্যমান বর্তমানের ১.২ মিলিয়ন ডলারের সমান। শেফনার তখন ইন্টারকমের মাধ্যমে খবরটি ককপিটে পৌঁছে দেন। পাইলটরা তখন নর্থওয়েস্ট এয়ারলাইন্সকে জানান। একইসঙ্গে এফবিআইকেও জানানো হয়। কিন্তু বাকি যাত্রীরা এসব কিছুই জানতেন না।

এফবিআই তখন একটি নির্দিষ্ট সিরিয়াল নম্বরের ২০ ডলারের নোটযুক্ত দুলাখ ডলার প্লেনে পাঠানোর ব্যাবস্থা করে যেন কুপার পালাতে গেলেও তাকে ধরে ফেলা যায়। শেফনারকে দিয়ে তাঁর চাহিদামাফিক জিনিস পাওয়ার পর কুপার যাত্রীদের সবাইকে ছেড়ে দেন। শেফনারকেও ছেড়ে দেন। ডলার আর প্যারাস্যুট হাতে পাওয়ার পর কুপার পাইলটকে বলেন মেক্সিকো সিটিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ।এদিকে কিছুক্ষণ ওড়ার পর তখন সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আর বাজে আবহাওয়া থাকায় পাইলট মেক্সিকো সিটির চেয়ে নেভাডার রেনোতে অবতরণ করাটাকেই যুক্তিযুক্ত বললেন। কুপার তাতে সায় দেন।

কুপার পাইলটকে ১০০০০ ফুটের কম উচ্চতায় বিমান রাখতে বলেন। তবে বিমানের রুট নিয়ে কিছু বলেননি। সেটা পাইলট তাঁর ইচ্ছানুযায়ীই চালান। এদিকে এফবিআইয়ের দুটি বিমান তখন এই বোয়িং ৭২৭-কে অনুসরণ করতে থাকে। একটি থাকে ৭২৭-এর ওপরে অন্যটি থাকে নিচে। রাত আটটার দিকে অ্যটেনন্ডেন্টকে ককপিটে চলে যেতে বলেন কুপার। অ্যাটেনটেনডেন্ট তখন দেখতে পান কুপার ডলারের ব্যাগটি আর প্যারাস্যুট তাঁর শরীরে বাঁধছেন।

একটু পর ককপিটে সবাই টের পান বিমানের পেছনের দরজাটি খুলে যাচ্ছে। কিন্তু সবাই তখন এতটাই আতঙ্কে ছিলেন যে মুখ ফুটে কোনো কথা বের হচ্ছিল না। কেননা কুপার তখন বোমাটি বিমানে বিস্ফোরিত করে প্যারাস্যুট নিয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেই সবার ধারণা ছিল। কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি। রাত আটটা থেকে আটটা ১০ মিনিটের দিকে বিমান যখন লুইস নদীর উপর দিয়ে যাচ্ছিল তখন ঝাপ দেন ডিবি কুপার। রহস্যজনক ব্যাপার হলো এরপর থেকে তাঁকে আর কোথাও পাওয়া যায়নি। তার লাশও পাওয়া যায়নি। বোয়িং ৭২৭-কে অনুসরণ করা বিমান দুটিও তাঁর লাফ দেওয়া টের পায়নি।

রেনোতে বিমান নিয়ে নামার পর পুলিশ এফবিআই বিমানটিকে ঘিরে ফেলার পর দেখা যায় পেছনের দরজাটি খোলাই আছে। চারটি প্যারাস্যুট এর মধ্যে দুটি নেই আর দুটি রয়ে গেছে আর কুপারের সিটে তাঁর টাইটি পড়ে আছে।আর কিছু নেই। সমগ্র এলাকা জুড়ে চুলচেরা অভিযান চালাতে থাকে এফবিআই। তাঁর স্কেচ জনগণের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল। স্থলপথ বন জঙ্গলে তো খোঁজা হয়ই সাথে সাবমেরিন দিয়েও চলে কুপার অভিযান। কিন্তু কুপারকে পাওয়া যায়নি। নর্থওয়েষ্ট এয়ারলাইন্স আর হাইজ্যাক একসাথে এই কেস নাম দিয়েছিল ‘নরজ্যাক’।

কিন্তু এফবিআইয়ের জন্য নরজ্যাক একেবারে নরকে পরিণত হয়। পাঁচ বছরে প্রায় ৮০০ সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয় কিন্তু কারও সঙ্গেই ডিবি কুপারের কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায়না। তবে সবচেয়ে বেশি সন্দেহ করা হয়েছিল রিচার্ড ফ্লয়েড ম্যাককয় জুনিয়রকে।

কুপারের ঘটনার পাঁচ মাস পর ম্যাককয় একই কায়দায় কুপারের মতো বিমান ছিনতাই করেন। তিনি দুই লাখ ডলারের জায়গায় পাঁচ লাখ ডলার দাবি করেন। তবে তিনি পরের দিনই ধরা পড়েন এফবিআইয়ের হাতে। তিনি ছিলেন একজন প্যারাট্রুপার। ধারণা করা হয় তিনিই ডিবি কুপার। তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের ডিবি কুপারের বর্ণনার সাথে সন্দেহভাজন ‘ডিবি কুপার’ মিল না থাকায় এফবিআইকে আবারও হতাশ হতে হয়। ম্যাককয়ের ৪৫ বছরের জেল হয়। পরে তিনি জেল থেকে পালাতে গিয়ে এফবিআই সদস্যের গুলিতে মারা যান। ডিবি কুপার রহস্য হয়েই থেকে যান।

তাঁর সাথে বিমানে সবচেয়ে বেশি সময় কাটানো অ্যটেনডেন্ট ফ্লোরেন্স শেফনার ও টিনা মাকলোর কাছ থেকে তার চেহারার বর্ণনা ও উচ্চতা অনুযায়ী স্কেচ আঁকা হয়।কিন্তু কুপার যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। তাকে আর কোনোদিন পাওয়া যায়নি। এমনকি তার কোনও লাশও পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ ৪৫ বছর এফবিআই ড্যান কুপারকে হন্যে হয়ে খুঁজেও কোন কূল কিনারা পায়নি।

শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালে তাকে নিয়ে তদন্ত বন্ধ করে দেয়। তার নাম ড্যান কুপার হলেও পত্রপত্রিকায় ভুলে ডিবি কুপার নামে ছাপা হয়ে যায়। পরে ড্যান কুপার নামটির চেয়ে ডিবি কুপার নামটিই বেশি জনপ্রিয়তা পায়। প্রসঙ্গত, প্রায় ৫০ বছর আগে স্থানীয় বিমান যাতায়াতের ক্ষেত্রে যাত্রীদের চেকিং করা হতোনা। শুধু টিকিট কেটেই বিমানে উঠে যাওয়া যেত। তাই কুপার বোমা নিয়ে বিমানে উঠে যেতে পেরেছিলেন।

বেশ কিছু বছর পর কলম্বিয়া নদীর তীরে টিনা বার নামক একটি জায়গায় ব্রায়ান ইনগ্রাম নামের ৮ বছরের একটি ছেলে আসে বাবা মায়ের সাথে পিকনিক করতে। ক্যাম্প ফায়ার করতে গিয়ে সে ২০ ডলারের কিছু বান্ডিল দেখতে পায়। এফবিআই সেসময় ডিবি কুপারকে দেয়া ডলারগুলোর সিরিয়াল নাম্বারগুলো প্রকাশ করেছিল।

ইনগ্রামের বাবা মা সেগুলো দেখে বুঝতে পারে এই ডলারগুলো নয় বছর আগে ডিবি কুপারকে দেয়া নোটগুলোই।তারা এফবিআই এর কাছে ডলারগুলো দেয়। তখন এফবিআই সে এলাকা খুড়ে চষে বেড়ায়। কিন্তু আর কোন হদিস পায়নি। কুপারের রহস্য নিয়ে টেলিভিশনে সিরিজ হয়েছে, হলিউডে সিনেমাও হয়েছে।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে