মেহেরাব চৌধুরী, ফেসবুক থেকে : শরীফ চাচার টর্চ লাইটটা আমার খুব প্রিয় ছিলো। না না ! অন্ধকারে আলো জ্বালবার জন্যে নয়। ওটার গর্ভ থেকে তিনটা অলিম্পিক ব্যাটারি চুরি করবার জন্য।
ব্যাটারি চুরি করে আমি এলাকায় টুংটুঙ্গি বাজিয়ে আসা কটকটিওয়ালাদের থেকে সদাই কিনে নিতাম। শরীফ চাচা আমাকে আদুরে কণ্ঠে সোহাগ করে জিজ্ঞেস করতো, আম্মু ? তুমি কি ব্যতাড়িগুলো নিয়েছো ? আমিও খুব যত্ন করে উত্তর দিয়ে বলতাম, কই, না তো ! চোর যে আমিই ছিলাম, শরীফ চাচা বুঝতো। কিন্তু কোনদিন আমাকে দ্বিতীয়বার কোন প্রশ্ন করতো না । আমাদের গ্রামে আইসক্রিমকে আইসক্রিমওয়ালা নিজেই হাইস্ক্রীম বলে ডাকতো। সেই হাইস্ক্রীম এর একটা ছিলো ২৫ পয়সা করে, যেটায় বরফের মধ্যে সামান্য দুধ আর চিনি মিশিয়ে নারিকেল দেয়া থাকতো। আরেকটা ছিলো ৫০ পয়সা করে। সেটা ছিলো রঙিন। ছেলে মেয়েরা বাড়ি থেকে ভাঙা টিনের থালা, কিংবা ছেঁড়া স্যান্ডেল দিয়ে ওই নারিকেলী
হাইস্ক্রীমই পেতো। আর আমি তিনটা অলিম্পিক ব্যাটারি দিয়ে রঙিন হাইস্ক্রীম পেতাম চারটা। জানি লোকটা আমাকে ঠকাতো। এর মধ্যে আমিও ধরা পড়ে যাবার ভয়ে বাকি তিনটা কিংবা দুইটা আইসক্রিম ফেরত দিয়ে আসতাম।
আরেকটা খাবার ছিলো, শনপাঁপড়ি।আর একটা ছিলো নইটানা। এই খাবারগুলো আমাদের কাছে ঠিক খাবার ছিলো না । ছিলো বিনোদনের প্যাকেজ। একটা চামড়ার ফটফট আওয়াজ কিংবা একটা কাঁসার টুঙটুঙ আওয়াজ শুনে ফালটা করা বাঁশের দুই মাথায় দুই ঝাঁকা কাঁধে করে বয়ে বেড়ানো অচেনা লোকটার পেছন পেছন ছুটে চলা ছিলো একটা দুঃসাহসিক থ্রিল। ছিলো রোমাঞ্চ আর প্যাশনের সম্মিলিত একটা মণ্ড। শিশুকাল বোধহয় এইসব চুরির জন্যে ঐশ্বরিক হয়। আমারও তাই ছিলো !
আমি এরপর একবার টয়লেটের কমোড চুরি করলাম। এক তিলের খাজাওয়ালাকে চীনা মাটির কমোড তুলে দিলাম যখন, লোকটা একটা বিশাল তিলের।খাজা আমার হাতে দিয়েই দ্বিতীয়বার কোন ঘণ্টা না বাজিয়ে দৌড় দিলো। আমারি এক চাচাতো চাচাতো ভাই পনির। ও বিষয়টা দেখে আমার দাদিকে ‘ছোট দাদী’ বলে ডাকতে ডাকতে ডাকতে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। ততোক্ষণে খাজাওয়ালা বহুদূর চলে গেছে। আর আমিও খাজা গিলে নিয়েছি অনেকটাই। দাদী এসে কাকে কাকে যেনো ফরমান পাঠালেন। আর ওরাই ঝড়ের বেগে খেতপাতালে দৌড়ে গিয়ে খাজাওয়ালাকে পাকড়াও করে আনলো।
দাদী বললেন, আপনাকে একটা বাচ্চা মেয়ে ভালো কমোডটা দিলো আর আপনি নিয়ে নিলেন ? আপনার তো উচিত ছিলো ওকে ফিরিয়ে দেয়া, কিংবা বাড়িতে খবর পাঠানো। খাজাওয়ালা এটা সেটা বকে বুঝ দিতে চাইলেও দাদি ওকে সাবধান করে দিলেন। এরপর কিছু ধান দিয়ে খাজার দাম মিটিয়ে দিলেন।
ওই কমোড আমার বড় চাচা কিনে রেখেছিলেন। বাড়ি সংস্কারের সময় একটা এটাচড টয়লেট বানানোর কথা ছিলো যেটা হয়ে ওঠেনি তখন। কিন্তু পরে বানানোর প্লান ছিলো। আর সেই প্লানই আমার চুরি মারফত প্লেনের টিকেট কেটে গায়েব হচ্ছিলো। তো, দাদি আমাকে কোন কথাই বলেন নি এই বিষয়ে। দাদি কেনো, কেউ বলেনি।
আজ আমি বুঝতে পারি, ওরা আমাকে কতো ভালোবাসতো। তখন বুঝতাম না । আমার দাদির একটা নীল রং এর কাঠের আলমারি ছিলো। সেই আলমারি সবসময় তালা দেয়া থাকতো। ওই আলমারিটা ভুলেও যদি কোনদিন খোলা পেতাম, তাহলেই হতো ! আমরা চাচাতো ভাইয়েরা আর আমি ( আমার আর কোন বোন ছিলো না ) মিলে আলমারিতে থাকা
আমাদের প্রাণপ্রিয় আচার আর গুড়ের বয়ামে হামলা করতাম। সে এক অন্যরকম ডাকাতি ছিলো। ডাকাতি করলে দাদি কল্পনা বলে চিৎকার করতেন। কল্পনা হচ্ছে আমার ছোট ফুপির নাম। তিনি বড় নরম মানুষ । কিন্তু তার বড় বড় সবুজ চোখ দুটোকে আমরা ভীষণ ভয় পেতাম। ওই ভয়ই যথেষ্ট হতো, অথচ, আমাদেরকে আরো উচিত শিক্ষা দিতে কল্পনা ফুপি নয়, শোভা ফুপি আসতো। শোভা ফুপি আমাদের বড় ফুপি । তিনি এসেই আমাদের ধরে ধরে প্যাঁদাতেন। ওনার অনেক চ্যালাপ্যালা ছিলো। সাদিক, শাহীন, দুলাল, শরীফ এইসব ভাইগুলো তার কথায় উঠতো বসতো। পুকুরে ডুবোডুবি বেশি করলে ধরে ইচ্ছা মতোন চুবানো থেকে শুরু করে মুরগির বাচ্চা নিয়ে দৌড় দিলে গাছের সাথে বেঁধে রাখা পর্যন্ত ওরা শোভা ফুপির কথায় করতো। আমরা এই ব্যাপারে অসহায় ছিলাম। তাই বড় হয়ে একদিন প্রতিশোধ নেবার অভিসম্পাত করে আমরা আমরা আলমারির মায়া ছেড়ে পালাতাম।আজও সেই আলমারি আছে। কিন্তু দাদি নেই। এখন কেউ বাড়ি এলে বলে না , এই ওদেরকে ছাতু মেখে দে !
এখন ফুপি আমাদের দাওয়াত করে খাওয়ান। অথচ, প্যাঁদানিগুলোই বড় মধুর ছিলো বুঝতে পারি ! এখনো সদাইওয়ালা, হাইস্ক্রীমওয়ালারা আসে ..কিন্তু, জীবনের পাল্লা থেকে সময়ের সেইসব সেরা আবেদনগুলো কে যেনো চুরি করে নিয়ে গেছে … জানা হয় না !
লেখক : মেহেরাব চৌধুরী, চিফ এডিটর, বিডিটাইমসটুয়েন্টিফোর
সম্পাদনা : সালেহ্ বিপ্লব