বিএ-এর আগেই বিয়ে
আদনান মুকিত: বিষয়টা যে এই প্রথম ঘটল তা নয়, প্রায়ই ঘটে। কম্বল মুড়ি দিয়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকলেই কেন যেন বন্ধুবান্ধব ফোন দিয়ে জানতে চায়, ঘুমাচ্ছি কি না। এখন যেমন শিহাব ফোন করেছে। নিশ্চয়ই নতুন দেখা কোনো মুভির কাহিনির বর্ণনা দেবে। ফোন ধরতেই করুণ গলায় সে বলল,
‘দোস্ত, আমাকে বাঁচা!’
: এখন কয়টা বাজে?
: ৩টা ৪৫।
: দুঃখিত, এই মুহূর্তে তোকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না। কয়েক ঘণ্টা পর আমি ঘুম থেকে উঠলে আবার চেষ্টা করিস।
ফোন কেটে দিলাম। শিহাবের একটা অসামান্য প্রতিভা হলো, তুচ্ছ সমস্যাকেও বাঁচা-মরার পর্যায়ে নিতে পারে। প্রায়ই সে ফোন দিয়ে বলবে, ‘দোস্ত, আমাকে বাঁচা!’ পরে দেখা যাবে ওর ফোনের চার্জ শেষ, আশপাশে কারও কাছে চার্জার খুঁজে পাচ্ছে না। আমি নিশ্চিত, এমন তুচ্ছ কোনো ঘটনার কারণেই সে ফোন করেছিল। তাই পাশ ফিরে শুয়ে আবার ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। এ সময় আবার শিহাবের ফোন। আবারও সেই করুণ কণ্ঠ, ‘দোস্ত, এই বারের সমস্যাটা আসলেই রিয়াল। নিশির জীবনটা ধ্বংসের কাছাকাছি চলে এসেছে। নিশির মামা এক ম্যাচমেকারের কাছে ওর সিভি দিয়েছিলেন।’
: ইংরেজি সাহিেত্য পড়ে, ও ম্যাচ কোম্পানিতে চাকরি করবে? ভালোই হবে, আমাদের তো অনেক ম্যাচের দরকার...
: আ রে, ওই ম্যাচ না। ম্যাচমেকার। ঘটক। পাত্রপাত্রী খুঁজে দেয়। পাত্র এসে ওকে ভার্সিটিতে দেখেও গেছে। এখন দ্রুত বিয়ে করতে চায়। ক্যানটিনের শিঙাড়ার দোহাই, তুই কিছু একটা কর।
: ভার্সিটিতে আইডি কার্ড ছাড়া আমাদেরই ঢুকতে দেয় না। ওদিকে জলজ্যান্ত পাত্র বিনা বাধায় ঢুকে যাচ্ছে! কালই প্রক্টর স্যারের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় লেখাপড়ার জায়গা, পাত্রপাত্রী দেখার জায়গা নয়!
: আরে দূর, তুই আমার আর নিশির কথা ভাব। নিশি তো তোদেরও বন্ধু, ও তো তোদের অ্যাসাইনমেন্টও বানিয়ে দেয়। ওর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তোরা কিছু করবি না?
: অবশ্যই করব। যা, ফটোগ্রাফার ঠিক করার কাজ আমার। পরিচিত কিছু ছোট ভাই আছে, দিন-রাত ডিএসএলআর নিয়ে ঘোরে আর মেয়েদের প্রোফাইল পিকচার তোলে। বললেই রাজি হয়ে যাবে।
: কী বলিস এইসব?
: আরে ঘুমা এখন। সকালে দেখা হবে।
২.
সকালে চোখে ঘুম নিয়েই দ্রুত ক্যাম্পাসে এসে দেখি শিহাব-নিশি দুজনই চলে এসেছে। দেখে মনে হচ্ছে ৩০ পাতার অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়ে ৩ পেয়েছে ওরা। তিনজন মিলে গ্রুপ ডিসকাশন করেও যখন কোনো বুদ্ধি বের করতে পারলাম না, তখন হাল ছেড়ে দিয়ে শিহাব বলল, ‘একটা চাকরি পাওয়া যায় কি না দেখ।’
: বিএ পাস করেই মানুষ চাকরি পায় না আর তুই তো এখনো পাসই করিসনি। কোনো দিন পাস করবি—এমন সম্ভাবনাও দেখছি না। বাংলা সিনেমার কত নায়ক বিএ পাস করার পর চাকরি না পেয়ে সার্টিফিকেট ছিঁড়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয়, দেখেছিস? তুই তো এখনো সার্টিফিকেটই পাসনি।
: এসএসসি আর এইচএসসির সার্টিফিকেট আছে। ওগুলোর ফটোকপি ছিঁড়ে ফেলি, কী বলিস?
আমি মাথা নাড়লাম। নিশি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আম্পায়ারের মতো মাথা নাড়িস না। কিছু একটা কর। মামার মাথায় একবার ভূত চাপলে তাঁকে আর থামানো যায় না। শিহাব, তুই তোর বাবাকে রাজি করা না। মুরব্বি কেউ মামাকে বোঝালে কাজ হতে পারে।’
: বাবা যা রাগী! তাকে বললে চড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দেবে। তোর পরিচিত ডেন্টিস্ট আছে? যে ফ্রি চিকিত্সা করাবে? বাবা তো হাড়কিপটা। একটা টাকা দেবে না।
শিহাবকে থামিয়ে উঠে দাঁড়ালাম আমি, ‘চল। তোর বাবার সঙ্গে দেখা করে আসি।’
: মানে? পাগল নাকি?
: সমস্যা নেই। আমার পরিচিত ডেন্টিস্ট আছে। নিশি, তুই ফোকলা ছেলেকে বিয়ে করবি তো?
: করব।
: তা হলে চল।
৩.
শিহাবদের ড্রয়িংরুমে বসে আছি নিশি আর আমি। শিহাবের বাবা রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। শিহাব যে কেন তার বাবাকে এত ভয় পায়, তা বুঝলাম। আংকেলের চেহারাটাই এমন যে রিমান্ড সেলে উনি থাকলে আসামি হাতের কোনো স্পর্শ ছাড়াই তথ্য দেওয়া শুরু করবে। আংকেল ভরাট কণ্ঠে বললেন, ‘তোমরা নিশ্চয়ই খেয়ে এসেছ?’
‘জি।’ কোনোমতে বলল নিশি। শিহাবের কথা সত্য। আংকেল আসলেই কৃপণ।
: তা বলো, কী করতে পারি? আইনি পরামর্শ হলে পর্যাপ্ত ফি দিতে হবে।
আমি আর নিশি পরস্পরের দিকে তাকাই। কীভাবে বলব, ঠিক বুঝতে পারছি না। শেষে সাহস করে আমি বলেই ফেললাম, ‘আংকেল, ও নিশি। আমি, শিহাব, নিশি—আমরা একসঙ্গেই পড়ি। ঘটনা হয়েছে কি, নিশির বাবা একজন কবি। কবিতা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। পরিবারের সব সিদ্ধান্ত নেন ওর মামা। উনি সম্প্রতি নিশির বিয়ে দেওয়ার জন্য খুব চাপাচাপি করছেন। কিন্তু আপনি তো জানেন, আমাদের লেখাপড়া এখনো শেষ হয়নি...’
: শেষ হয়নি তো কী হয়েছে? বিয়ের পর পড়বে। আমি নিজেও বিয়ের পর ল পাস করেছি। এটা কোনো ব্যাপারই না।
: ইয়ে...হয়েছে কি, নিশি আবার একটা ছেলেকে পছন্দ করে। মানে ওরা ঠিক করেছিল বিএ শেষ হলে বিয়ে করবে...কিন্তু ভয়ে বলতে পারছে না। ছেলের বাবা ভীষণ রাগী। উনি কিছুতেই এসব মানবেন না।
: ভয় পেলে হবে? প্রেমের মূল ব্যাপার হচ্ছে সাহস। আমিও প্রেম করেই শিহাবের মাকে বিয়ে করেছিলাম। তোমরা ওনাকে বোঝাও। কনভিন্স করো। এসব ব্যাপারে জবরদস্তি চলে না।
: জি, সে জন্যই আমরা আপনার কাছে এসেছি।
: কিন্তু এখানে কোনো আইনি সহায়তা দেওয়ার সুযোগ তো দেখছি না।
: আংকেল, নিশি আসলে শিহাবকেই পছন্দ করে। শিহাবও। ও ভয়ে আসেনি। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
: অসম্ভব! বিএ-র আগে বিয়ে কিসের? শিহাব আসুক। এক চড়ে ওর একাধিক দাঁত ফেলে দেব আমি। বেয়াদব! লেখাপড়া বাদ দিয়ে প্রেম-ভালোবাসা? অ্যাই মেয়ে, তোমার সিজিপিএ কত?
‘থ্রি পয়েন্ট ফাইভ জিরো।’ নিশি মাথা নিচু করে উত্তর দিল।
: পড়াশোনা তো করো না, শুধু প্রেম! যাও, বাসায় যাও।
‘জি আচ্ছা।’ নিশি উঠে দাঁড়াল। ব্যাকপ্যাক কাঁধে নিতে নিতে বলল, ‘একটা কথা বলি?’
: হুম...
: আংকেল, বিয়েতে এখন ফটোগ্রাফারের খরচই কিন্তু অনেক। কমিউনিটি সেন্টার, ডেকোরেশন—সব মিলিয়ে কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়ে যাবে।
: তো?
: মানে বিয়েটা আমরা এখন করে রাখলাম, তারপর পড়াশোনা শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজেদের বিয়ের খরচ নিজেরাই দিলাম, এটা হয় না? এই যে সম্ভাব্য খরচ প্রিন্ট করে নিয়ে এসেছি।
আংকেল চশমা পরে খরচের হিসাবটা পড়লেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, ‘কমিউনিটি সেন্টারের এত ভাড়া?’
: জি।
: তোমার মামার ফোন নম্বরটা দিয়ে যাও। আমি কথা বলব।
: থ্যাংক ইউ, আংকেল!
৪.
আমি আর নিশি খুশি মনে বেরিয়ে আসছি, পেছন থেকে আংকেল বাংলা সিনেমার মতো বললেন, ‘দাঁড়াও।’
সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়ালাম আমরা। আংকেল আমাদের পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘গাধাটা কোথায়? ওকে কিছু বুদ্ধি ধার দিতে পারো না?’
আমরা বেরিয়ে এলাম, আংকেলও এলেন আমাদের পেছন পেছন। আমাদের দেখে ছুটে এল শিহাব, ‘দোস্ত, তোরা ঠিক আছিস তো? আমি তো ভেবেছি ভেতরে রক্তারক্তি হয়ে গেছে! তোদের দেরি দেখে অ্যাম্বুলেন্সেও খবর দিয়েছি। দুই মিনিটের মধ্যে চলে আসবে।’
আমাদের ঠেলে সামনে এগিয়ে এলেন আংকেল, ‘কোন অ্যাম্বুলেন্স খবর দিয়েছিস? তোর জন্য তো দরকার ভেটেরিনারির অ্যাম্বুলেন্স।’
শিহাবের মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল আর ফিক করে হেসে ফেলল নিশি। ঠিক এমন সময় সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এসে থামল। ড্রাইভার দ্রুত দরজা খুলে নেমে বললেন, ‘রোগী কে?’
কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থেকে এলাকা কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন আংকেল। তাঁর সঙ্গে আমরাও। অ্যাম্বুলেন্সের চালক বিস্ময় নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।-প্রথম আলো
২২ ডিসেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪ডটকম/জুবায়ের রাসেল