পাঠকই লেখক ডেস্ক: গতকাল সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে। আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর খুব খুশি হয়েছিলাম। বাসার সামনেই রাস্তায় পানি জমে গেছে। তার মানে স্কুলে যাওয়া হবে না। বন্ধুদের সাথে খেলবো। আব্বু অফিসে যাওয়ার আগে বলে গেলেন যেনো বাসা থেকে বের না হই।
আমি রাহাত। ক্লাস ফোরে পড়ি। আর আমার ছোট ভাইয়ের নাম রাশেদ। আমরা ২ ভাই প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঝগড়া বাঁধাই। আম্মু আমাদের মারামারি থামায়। বড় বলে সব দোষ আমার ঘাড়েই পড়ে। আর রাশেদের যেন কোন দোষ নাই। সবাই রাশেদকে বেশি ভালোবাসে। ওকে এটা-ওটা কিনে দেয়। আর আমকে কিনে দেয় ডিকশনারি। এটা নাকি আমার কাজে লাগবে।
আব্বু আম্মুর মতে, রাশেদের সাথে মারামারিতে আমাকেই হার মানতে হবে। কারণ আমি ওর বড় ভাই তো! রাশেদ যখন ছিল না তখন আব্বু আম্মু আমাকে কতো আদর করতো, আর এখন সব যেন ওর জন্যই।
রাশেদ মাত্র ক্লাস টুতে পড়ে। এখনই আমি যা করতে চাইবো ও তার বিপরীত করবেই। আজ যখন আমি বললাম স্কুলে যাবো না। রাশেদ তখনই আম্মুর কাছে ছুটে গিয়ে বললো, আমি স্কুলে যাবো। বলেই কান্নাকাটি শুরু করে দিল। আমার ইচ্ছে করছিল গালে একটা ঠাস করে চড় দেই। কতো বড় ফাজিল! যাই হোক, আম্মু আর আমাদের স্কুলে যাওয়ার জন্য জোর করলো না।
সকাল থেকে এক নাগাড়ে ৩ ঘন্টা পড়ছি। আমার এখন খুব খেলতে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আম্মু যেতে দিবে না। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এলো! রাশেদ যদি আম্মুর কাছে যেয়ে কান্নাকাটি করে তবে আম্মু হয়তো মানবে। রাশেদকে ডেকে বললাম, লক্ষ্মী ভাইয়া আমার, তুমি আম্মুকে গিয়ে বলো আমাদেরকে যেন একটু বাইরে যেতে দেয়। রাশেদ আম্মুর কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করা শুরু করলো।
আমি আম্মুর কাছে গিয়ে বললাম, যাই না আম্মু, মাত্র ৫ মিনিট। আম্মু অতিকষ্টে রাজি হলো। আম্মু বললো, শুধু গেটের সামনে দাঁড়াবে। রাস্তার পানিতে নামবে না। ৫ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে। সিড়ি দিয়ে নামার সময় রাশেদ বললো, ভাইয়া আইসক্রিম খাবো। আমি বললাম, আইসক্রিম খেলে ঠান্ডা লাগবে। তাহলে চকোলেট খাবো। আচ্ছা পরে কিনে দিবো। রাশেদ বললো, না ভাইয়া আমি এখনই খাবো। আমি বললাম, আমরা আসার সময় কিনে দিবো। আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি ভাইয়া? খেলতে যাচ্ছি। আম্মু বকা দিবে না? আম্মু জানতেই পারবে না। আর জানলে কি হয় তা পরে দেখা যাবে।
গেটের সামনে আসতেই রাশেদ হঠাৎ বললো, ভাইয়া আমি খেলতে যাবো না। আমার কেমন যেন ভয় লাগছে। আমি বললাম কিসের ভয়? দেখ, সবাই কেমন মজা করে খেলছে, আমরাও খেলবো। আমাদের বাসার সামনে পুকুরটা ভরে গেছে। রাস্তায় হাঁটু সমান পানি। আমরা দুজনে বন্ধুদের সাথে খেলতে লাগলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার চারপাশে রাশেদ নেই। কিছুদূরে কতগুলো ছেলেমেয়ে চিৎকার করছে। মনে হয় পানিতে কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে। আমার কেন জানি হাত-পা অবশ হয়ে গেল। আমি দৌড়ে সেই ছেলে-মেয়েদের কাছে গেলাম। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার ছোট ভাই রাশেদ পানিতে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে।
আমি এখন কি করবো? নিজেও সাতার জানি না। রাশেদকে বাঁচাবো কিভাবে? বাসার দিকে দৌড়ে গেলাম। প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে অনেক বড় মনে হচ্ছে। আমি বাসায় এসে আম্মুকে বললাম, আম্মু রাশেদ পানিতে পড়ে গেছে। আম্মু চিৎকার দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এলো।
আমার আম্মুকে এভাবে কখনো কাঁদতে দেখিনি। আম্মু পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদছে। আম্মুর কান্না দেখে আমি কাঁদছি। অনেকে তখন পানিতে নেমে রাশেদকে খুঁজছে, কিন্তু ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাশেদ ডুবে গেছে। আব্বুর অফিসে ফোন করা হলো। আব্বু তার অনেকগুলো বন্ধুকে নিয়ে এলো। আম্মু বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। জ্ঞান ফিরলেই রাশেদকে খুঁজছে। পুকুরে জাল ফেলা হলো। চারপাশে অনেক মানুষ ভিড় করেছে। কিন্তু রাশেদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমার হঠাৎ মনে হলো আমি রাশেদকে অনেক ভালোবাসি। ওকে না দেখে আমি একদিনও থাকতে পারবো না। ওকে ছাড়া রাতে ঘুমাতে পারি না। আমাদের সব ঝগড়া ও মারপিটের কথা আমি একদম ভুলে যাই। রাশেদের যদি কিছু হয় তবে আমি পাগল হয়ে যাবো। বৃষ্টি আরো বেড়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যেই সবাই পানিতে নেমেই রাশেদকে খুঁজছে। প্রায় আধ ঘন্টা খোঁজার পর রাশেদকে অর্ধমৃত অবস্থায় পাওয়া গেলো। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পর জানা গেল রাশেদ মৃত।
আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। মাত্র আধঘন্টার ব্যাবধানে আমার ছোট ভাই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। আমার বাবা-মায়ের কান্না আরো হাহাকার আমার মনে প্রচন্ড কষ্ট তৈরি করলো। বৃষ্টির পরিমান বেড়েই চলছে। আজ আমার মনে হলো আমার আব্বু-আম্মুর কষ্টে, আমার কষ্টে আকাশও কাঁদছে। আমার কানে শুধু একটা কথাই বাজছে, 'ভাইয়া আমি খেলতে যাবো না, আমার ভয় লাগছে।' আর কেউ কোনদিন আমার কাছে এসে বলবে না, 'ভাইয়া আমাকে চকোলেট কিনে দাও না.......।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
লেখক: আহমেদ ইমরান হালিমী
বি:দ্র: সম্পাদক দায়ী নয়
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসবি/বিএসএস