‘মনের মানুষ’ এক মহাত্মার জীবন দর্শন
পাঠকই লেখক ডেস্ক: কুষ্টিয়াঅঞ্চলের একটি কায়স্থ (হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি উপবর্ণ বিশেষ) পরিবারেজন্ম নেয় লালু নামের একটি ছেলে। শৈশব কালেই বাবাকে হারিয়ে মায়ের আঁচলে বড়হতে থাকে সে। প্রায় কিশোর বয়সেই করতে হয় বিয়ে। কাজে কর্মে কোন মন নেই।গানকে সে অনেক ভালোবাসে। একদিন গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে একটি দলের সঙ্গেবহরমপুরে যাত্রা করে লালু। পথিমধ্যে বসন্ত রোগের কবলে পরতে হয় তাকে।সঙ্গী-সাথীরা তাকে মৃত ঘোষণা করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়। তবে ভাগ্যের চরমলীলাখেলায় লালু প্রাণ ফিরে পায় এক মুসলমান মায়ের সেবায়।এমন সময় তার সাথেপরিচয় হয় সিরাজ সাঁই নামক এক সাধকের সাথে। সুস্থ হয়ে যখন লালু তার আপন গৃহেফিরে যায় তখন তাকে শুনতে হয় ধর্মচ্যুত হওয়ার অপবাদ। নিজের গর্ভধারিণী মাওযখন এই অপবাদ ছিটকে দিয়ে ঘরে ঠাই না দেয় তখন রাগে অভিমানে লালু চিরদিনেরজন্যে গৃহত্যাগ করেন। গৃহত্যাগের পরে লালু এক জঙ্গলে নিজের আবাসস্থল তৈরিকরার সিদ্ধান্ত নেয় এবং নিজের অতিতের সব কিছু মাটি চাঁপা দিয়ে লালু থেকেলালন নামে তার নতুন জীবন শুরু করে।
এরকম একটি প্রেক্ষাপট দিয়েই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘মনের মানুষ’উপন্যাসটি রচনা করেছেন। উপন্যাসটিতে তিনি লালনের জীবনের মূলভাব ও আদর্শফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। লালন সবসময় প্রচার বিমুখ থাকায় তার সঠিকজন্মইতিহাস কিংবা তার জীবদ্দশার তথ্যাবলি তেমন একটা পাওয়া যায় না। তবে তারবিভিন্ন গান যেমন “সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে? লালন বলে জাতের কি রূপদেখলাম না এই নজরে।” কিংবা “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়?” অথবা “মিলন হবে কত দিনে? আমার মনের মানুষের সনে” ইত্যাদি গানগুলোতে তারজীবনদর্শন অনেকটাই উপলব্ধি করা যায়।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গানের বিশেষ ভক্ত ছিলেন। মূলত তিনিইআধুনিক সমাজের সাথে লালনের গানের পরিচয় করিয়ে দেন। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরসাথে লালনের কখনও প্রত্যক্ষ আলাপ-পরিচয় হয়েছে বলে কোন প্রমান গবেষণায়পাওয়া যায়নি।
উপন্যাসের শেষে লেখক ‘লেখকের বক্তব্য’ নামক অংশে এই উপন্যাসটির ব্যাপারেকিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি অকপটেই বলেছেন এটি লালনের কোনজীবনকাহিনী নয়। লোকশ্রুতি অনুযায়ী এবং কিছু লালন গবেষণামূলক বইয়ের উপরনির্ভর করে কাল্পনিক এবং বাস্তবিক কিছু চরিত্র নিয়ে তিনি তার এই উপন্যাসটিরচনা করেছেন। সেখানে তিনি লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী এবং সৈয়দ শহীদ নামকজৈনিক ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। পাঠকদের তৃষ্ণা মেটাতে লেখকবইয়ের শেষে লালনের বেশ কিছু গানও সংযোজন করেন। শুধু তাই নয়, লালনেরজীবনদর্শন এবং সমসাময়িক কাল সম্পর্কে যারা জানতে আগ্রহী তাদের উদ্দেশ্যেলেখক অতিপ্রয়োজনীয় কিছু বইয়ের নামও উল্লেখ করেন।
সবশেষে বলব, উপন্যাসটিতে লেখক খুব সহজভাবে লালনের জীবন-দর্শন ব্যাখ্যাকরার চেষ্টা করেছেন। একজন লালনভক্ত হিসেবে আমি তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছুই এইবইয়ের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। বইটি আমাকে লালন ও তাঁর জীবনদর্শন সম্পর্কেআরও আগ্রহী করে তুলেছে। চাইলে আপনিও পড়ে ফেলতে পারেন এক মহাত্মারজীবনদর্শনের এই দর্পণ।
বিভাগঃ বুক রিভিউ;
লেখকঃ ওমর ফারুক কোমল
৬ জানুয়ারি,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস