পাঠকই লেখক ডেস্ক: শীতকাল ভাপা পিঠা খাওয়ার সময়। আর বিয়েশাদি করার সময়। বন্ধুরা বিয়েশাদি করে কক্সবাজারের সমুদ্রপাড়ে গিয়ে সেলফি তুলছে। সেলফি তুলতে লাগছে পাঁচ মিনিট, ফেসবুকে লোড করতে লাগছে এক মিনিট। এসব দেখে আমরা তিন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম, বউ নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাব। সেলফি তুলতে হলে ওখানে গিয়ে তুলব। সব যখন ঠিকঠাক শুধু দুটি কারণে যাওয়া হলো না।
১। কারো পাসপোর্ট নেই।
২। কারো বউ নেই।
‘বউ না থাকলে কি ঘুরতে যাব না?’ রাজু চায়ের কাপে সুড়ুত করে টান মেরে বলল।
‘অবশ্যই। বউ-বাচ্চা নিয়ে যাওয়া মানে ভেজাল।’ তন্ময়ের মন্তব্য।
‘চল, তাহলে কাল ফুটি। কাল বছরের প্রথম দিন।’ আমি বললাম।
‘কই যাবি?’ দুজনেই জানতে চাইল।
‘বান্দরবান!’
বিনা নোটিশে বাড়ি ছাড়ার যেমন আবেদন আসে, আমরাও বিনা নোটিশে পরদিন সকালে ব্যাগপ্যাক নিয়ে বের হয়ে পড়লাম। যাওয়ার সময় গলির মুখে এক ভদ্রলোকের মুখোমুখি হয়ে গেলাম। আমাদের এত সকালে দেখে তিনি অবাক।
‘কোথায় যাও তোমরা এত সকালে?’
‘আঙ্কেল আমরা বান্দরবান যাচ্ছি।’ রাজুর জবাব।
আমাদের আগাগোড়া অবলোকন করার পর তিনি বললেন, ‘ইউ পিউপল ডিজার্ভ দ্যাট প্লেস।’
আমরা কিছু না বলে চলে এলাম।
‘কী রে তুই আঙ্কেলকে কিছু বলিস নাই?’ তন্ময় আমাকে জিজ্ঞেস করল।
‘না। বললে এখন যেটা বলল, বাসায়ও এসব কিছু বলত আর কি।’
‘আঙ্কেল তোরে খালি খালি ছিলার ওপরে রাখে না?’
‘হ্যাঁ।’ দীর্ঘশ্বাস চেপে বললাম আমি।
‘কিছু বলস না?’
‘কিভাবে বলি? একে তো বাবা, তার ওপর বয়সেও বড়।’
সবাই গলা ছেড়ে হেসে ফেললাম। বাসস্টেশনে টিকিট কাটতে গিয়ে শুনলাম, একদম পেছনে সিট পাওয়া যাবে। সেই স্কুল থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত সারা জীবন পেছনেই বসলাম।
‘উই পিউপল ডিজার্ভ দিস।’ তন্ময়ের কথায় আরেক প্রস্থ হাসাহাসি হলো।
বাস ছাড়ার আগমুহূর্তে রাজু বলল, ‘আমার একটু ওয়াশরুমে যেতে হবে।’
এটা রাজুর পুরনো অভ্যাস। কোনো কাজ হওয়ার আগে আগে তার টয়লেটে যেতে হয়। আমাদের বন্ধুসমাজে চালু আছে, বিয়ের সময় কবুল বলতে বললে রাজু বলতে পারে, ‘ইয়ে মানে, আমার একটু ওয়াশরুমে যেতে হবে।’
হেলপারকে বলতেই হেলপার চেঁচিয়ে বলল, ‘ওস্তাদ এখন ছাইড়েন না, এক ভাই টাট্টিখানায় যাইব।’
‘মান-ইজ্জতের ফালুদা।’ পাশে বসা তন্ময়কে বিড়বিড় করে বললাম।
‘শীতকালে ফালুদা না, বল মান-ইজ্জতের এক্সপ্রেসো কফি।’
রাজু ফিরল, বাস ছাড়া হলো। রাজুকে বসতে হলো এক মোটা আঙ্কেলের পাশে।
বাসচালকের কাজকারবার দেখে মনে হলো, তার জীবনের দুটি উদ্দেশ্য।
১। পেছনের যাত্রীদের হাড্ডি-মাংস আলাদা করে ফেলা।
২। ঋধংঃ ্ ঋঁত্রড়ঁং সিরিজে পল ওয়াকারের জায়গায় নিজেকে রিপ্লেস করা।
বান্দরবান যখন পৌঁছলাম, তখন ঝলমলে রোদ। স্টেশনে নেমেই আমরা বিকেল সাড়ে ৬টার রিটার্ন টিকিট করে ফেললাম। মার্কোপোলো বলেছেন, ‘কোথাও পৌঁছে আগে আসার ব্যবস্থা করে ফেলবে বৎস।’ টিকিট করে একটা হোটেলে ঢুকে চা, পরোটা আর ডিম ভাজি খেলাম। এরপর রওনা দিলাম স্বর্ণমন্দিরের উদ্দেশে। লোকাল ‘সিএনজি নাকি টেম্পো’—এই সাইজের একটা বাহনে করে রওনা দিলাম। ওই টেম্পোর এক আঙ্কেল স্বর্ণমন্দির যাব শুনে তার ইতিহাস বর্ণনা শুরু করলেন।
‘বাঙালি কথা বলতে পছন্দ করে, শুনতে না।’ তন্ময় ফেসবুকে স্টেটাস দিল।
যথারীতি স্বর্ণমন্দিরে পৌঁছলাম। তখন সূর্যের যৌবনকাল চলছে। বেশ রোদ। মন্দিরের গায়ে লেগে লেগে রোদ ছিটকে পড়ছে। আশপাশের সবাইকে দেখলাম, সেলফি তুলতে ব্যস্ত।
‘প্রকৃতি না দেখে মানুষ ক্যান যে খালি সেলফি তোলে?’ এটা বলে তন্ময় কয়েকটি সেলফি তুলে ফেলল।
সেলফি তুলে দেখলাম, সে আশপাশের কয়েকটা লোককে স্বর্ণমন্দিরের ইতিহাস বলা শুরু করল। টেম্পোতে এতক্ষণ যা শুনে এসেছি তা-ই ছাড়ছে।
‘বাঙালি কথা বলতে পছন্দ করে, শুনতে না।’ তন্ময়ের স্টেটাসটা আমার টাইমলাইনে শেয়ার দিয়ে দিলাম।
স্বর্ণমন্দির থেকে নেমে খানিকটা দূরেই একটি কুয়ার মতো দেখলাম। সেটাতে অনেক টাকা ভাসছে! দুই টাকা থেকে শুরু করে ৫০, ১০০ টাকা পর্যন্ত।
‘এটাতে মনে হয়, লোকেরা আশা পূর্ণ হওয়ার জন্য টাকা ফেলে।’
এই বলে তন্ময় একটি পাঁচ টাকার কয়েন ফেলে বিড়বিড় করল। ইদানীং তার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে কী যেন একটা সমস্যা চলছে।
পাশ দিয়ে বৃদ্ধ এক লোক যাচ্ছিল। গায়ে চাদর, চোখ কুঁচকে আছে। তাকে দেখে আমি বললাম, ‘আচ্ছা দাদা, এই কুয়ায় কি সাঁতার কাটা যাবে? বেশিক্ষণ লাগবে না, ধরেন দু-একটা ডুবসাঁতার দিয়েই উঠে পড়ব।’
বৃদ্ধ রেগে চেঁচিয়ে কী-সব বলে ওঠল। আমরা দ্রুত ওখান থেকে কেটে পড়লাম। বান্দরবানে খাবারের দাম বেশি হবে ভেবে আমরা চট্টগ্রাম থেকেই কেক, কলা, ড্রিংকস নিয়ে এসেছিলাম। নীলাচল বলে একটি জায়গায় গিয়ে ওসব খেলাম। পানি কিনতে গিয়ে এক দোকানে শুনি, দেড় লিটার পানি ৪০ টাকা! যার দাম এমনিতে ২৫ টাকা।
দাম শুনে আমি বলে উঠলাম—‘কাইফা হালুকা।’
দোকানদার অবাক হয়ে তাকালে বললাম, ‘না ভাই, আসলে দাম শুনে ভাবলাম আরবের কোনো মরুভূমিতে আছি।’
খাবারদাবার সেরে বাসস্টেশনে এসে দেখি, তখনো মাত্র ৫টা। কিন্তু আমাদের টিকিট সাড়ে ৬টার।
‘এখন কোনো বাস নেই?’
‘আছে, তবে পেছনের সিট।’
‘চলবে।’ আমি আর তন্ময় বলে উঠলাম।
এর মধ্যেই দুটি মেয়ে এসে বলল, ‘চট্টগ্রামের এখন কোনো টিকিট নেই?’
‘ছিল, ওনারা নিয়ে ফেলেছেন।’ কাউন্টারের লোকটা আমাদের দেখিয়ে দিল।
‘তাহলে পরের বাসেই যাব।’ এই বলে মেয়ে দুটি ওয়েটিং রুমে বসল।
‘ভাই, এখন কেমন জানি শরীর খারাপ লাগছে। আমরাও পরের বাসেই যাব।’ এই বলে আমরাও ওয়েটিং রুমে বসলাম। কাউন্টারের লোকটা মেয়েগুলোকে ডেকে আমাদের টিকিট দিয়ে দিল। মেয়েগুলো হাসতে হাসতে আমাদের সামনে দিয়ে বাসে উঠে চলে গেল।
‘নারী সর্বদাই ছলনাময়ী’—ফেরার সময় তন্ময় স্টেটাস দিল। আমি আর রাজু দুজনই ওটা শেয়ার করলাম।
লেখক: মো. সাখাওয়াত হোসেন
১১ জানুয়ারি ২০১৬/এমটি নিউজ২৪ডটকম/জুবায়ের/রাসেল