পাঠকই লেখক ডেস্ক: নিঝুমপুর গ্রাম কি সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যপট, যে দিকে তাকাই সেদিকে দেখি মনোরম ছায়াগেরা গ্রামটি, গ্রামের এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী নালা খাল বিল আর অন্য পাশে সবুজ রঙ্গিন বিস্তীর্ন মাঠ ভুমি । যেখানে কৃষকের সবুজ সোনালী ফসলে ভরপুর । এই এলাকার শান্তি প্রিয় মানুষের মাঝে বসবাস করত এক দরিদ্র কৃষক পরিবারের সিহাব ।
সিহাব তার গ্রামের যেমন নিরব প্রকৃতির ছেলে, তেমন দুষ্টুমিতে ও সেরা । আর লেখাপড়া সে তো দৃষ্টি-চক্ষুর আড়ালে নয়, সে গ্রামের মঙ্গলময় আসন গ্রহন করেছে । তার প্রতিদ্বন্দ্বি এ পর্যন্ত কেউ হতে পারেনি । কিন্তু তার বন্ধু ঝিনুক এবং শেমল তার পরেই স্থান দখল করে আছে ।
শেমল, পলাশ, ঝিনুক এবং সিহাব একে অপরের পরম বন্ধু ।
শেমল ও ঝিনুক ধনাট্য পরিবারে বসবাস এবং পলাশ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান । সিহাব এক কৃষক পরিবারের রত্ন মানিক । তারা চার বন্ধু প্রতিদিন একসাথে স্কুলে যায় এবং স্কুলে গিয়ে চারজন সারা স্কুলকে মাতিয়ে তোলে । দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি,পানি দিয়ে একজন অন্যজনকে ভিজিয়ে দিত । এসব অভিযোগ তাদের প্রতিদিনের গড় রিপোর্ট ছিল ।
একদিন স্কুলেরে ইংরেজি টিচার ক্লাসে ইংরেজী পড়া দিয়ে বলল, আগগামীকাল যে পড়া না পারবে তাকে মাঠে কানে ধরে দাড়িয়ে থাকতে হবে । ঐ দিন তারা চারজন বাড়িতে গিয়ে নদীতে মাছ ধরতে গেল এবং গিয়ে দেখল নদীর ধারে জেলের একটা ছোট নাও বাঁধা আছে । তারা সবাই এটা চালাচ্ছে, এদিক ওদিক ঢেউ খাচ্ছে এলোমেলোভাবে । এভাবে দুষ্টুমি করতে করতে নৌকাটা ডুবিয়ে দিল । এবার তারা ভয়ে জটপট সাতার কেটে বাড়ি এসে পড়ল । এভাবেই ঘনিয়ে এল বিকাল । সন্ধা হলে জেলে গিয়ে দেখে তার নৌকাটি আর ঘাটে নেই । তার বুঝতে বাকী রইলনা যে একাজটি কে করেছে । কারন এলাকার এমন সব সংস্কারমূলক কাজ এ চারজনের দ্বারাই হয়ে থাকে । তারাই বিভিন্নভাবে দুষ্টুমি করে এসব জিনিস নষ্ট করে ।
জেনে রাতেই শেমলের বাড়িতে গেল । গিয়ে ডাকল,শেমলের আব্বু বাড়িতে আছেন? শেমলের আব্বু বলল, হাঁ বিতরে আসুন । ঐ দিকে জেলের আওয়াজ শুনে সেমল আস্তে আস্তে বাড়ি থেকে কেটে পড়ল । শেমল পলাশদের বাড়িতে গিয়ে পলাশকে নিয়ে সিহাবদের বাড়িতে চলে গেল । রাতটা তারা তিনজন ওখানেই কাটাল । সারা রাত তিন বন্ধু হাসা-হাসি,গল্প-গুজব করে কাটাল । ওদিকে জেলে গিয়ে শেমলের বাবাকে বলল, দেহেন শেমলের আব্বা আমি গরিব, আমার নাউডা দিয়া আমি মাছ ধরি, এই নৌকাডা শেমল এবং তার বন্ধুরা ডুবাইয়া দিছে । শেমলের আব্বু বলল, ঠিক আছে আমি তোমাকে নতুন একটা নৌকার টাকা দিয়ে দেবনে । সিহাব,শেমল,পলাশ সকাল বেলায় সিহাবদের বাড়িতে নাস্তা করে সিহাবের বইগুলো নিয়ে, স্কুলে চলে গেল । স্কুলে গিয়ে দেখে এখনো ঝিনুক স্কুলে আসেনি, তারা তিনজন ঝিনুকের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ২য় ঘন্টা পার হয়ে গেল । কিন্তু এখনো ঝিনুকের কোন সাড়া মেলেনি ।
এরই মধ্যে ৩য় ঘন্টা চলে এলো, সাথে সাথে ইংরেজী স্যার ও চলে এলো । এসেই জিজ্ঞাসা করল কে কে পড়া পার না, দাড়াও । তিন বন্ধু এবং সাথে আরো কয়েকজন দাড়াল । তিন বন্ধু তো গতকাল দুষ্টুমির কারনে পড়া হয়নি, আর ঝিনুক তো আসেইনি । তোমরা যারা পড়া পারনা তারা কানে ধরে বারান্দায় গুরে আস । বৃষ্টি থাকার কারনে মাঠে যেতে বলা হয়নি । তারা তিন বন্ধু বাহিরে এসে বুদ্বি করে এমনিতেই ড্রেস নিয়ে পানিতে গড়াগড়ি করতে লাগল । তাদের গড়াগড়ি দেখে ক্লাসের ফেলডিবিশনের ছাত্র ফেলুও একটা ডিগবাজি দিয়ে আসল । তারা তিনজন সহ আরো কয়েকজন ভিজা ড্রেস নিয়ে ক্লাসে গেল ।
স্যার জিজ্ঞাসা করল, সিহাব তুমি ভিজলে কিভাবে? সে মৃদু হেসে উত্তর দিল, স্যার আমি পানিতে পড়ে গিয়েছিলাম । আচ্ছা শেমল তোমার কী হয়েছে? সে বলল, স্যার সিহাব পড়ে যাওয়ার সময় সে আমাকে ধরে ছিল রক্ষা পাওয়ার জন্য । অবশেষে আমি পরে যাই । পলাশ তোমার? স্যার আমি তাদের ধরতে গিয়ে ধরতে না পেরে পড়ে যাই । কারন আমার দুই হাতই কানে ধরা ছিল ।
সর্বশেষ ফেলুকে জিজ্ঞাসা করা হল, কিরে ফেলু তুইতো সব সময় ফেল করিস, তো তুই কেন ভিজলি । স্যার আমি যখন কানে ধরা ছিলাম,তখন দেখি ওরা পানিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে । ভাবলাম এটাই বুঝি আমাদের শাস্তি, তাই আমিও তাদের দেখাদেখি একটা ডিকবাজি দিয়ে আসি । সর্বশেষ কী আর করা চারজনকেই ছুটি দিয়ে দেয়া হল ।
বাড়িতে যাওয়ার সময় সিহাব বলল, আজ অনেক মজা হয়েছে, কাল একটু আগে আসবি কারন ঝিনুকের সাথে মজার ঘটনা পেশ করতে হবে ।
পর দিন চার বন্ধু একত্রিত হলো স্কুলে যাওয়ার জন্য । পথে একটা বকুল গাছ ছিল যার নিচে মানুষ রোদ্র থেকে এসে বিশ্রাম নিত । গাছটি অনেক বড় ছিল, তাই চার বন্ধু স্কুলে যাওয়া আসার পথে বিশ্রাম নিত । আজ ও তারা গাছটির নিচে বসল এবং ঝিনুককে সব ঘটনা খুলে বলল, পরে সবাই স্কুলে গেল । ৩য় ঘন্টা যাওয়ার পর অফিস থেকে একটা নোটিস আসল যে,
আগামী ২৭ তারিখ থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে । সার্বিক প্রস্তুতির জন্য ২০ তারিখ থেকে স্কুল ছুটি ঘোষণা করা হল । ক্লাস শেষে সিহাব বন্ধুদের নিয়ে মাঠে বসল । সিহা বলতে লাগল আর মাত্র পরীক্ষার ১৫ দিন বাকী আমাদের দুষ্টুমী আজ থেকে ছুটি ঘোষনা করা হল । আমরা আজ থেকে আরো মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করব । রুটিন মাফিক আমাদের এই সময় গুলো পরিচালনা করব । তারপর ছুটি শেষে বাড়ি আসার পথে সেই বকুল গাছ থেকে ফুল কুড়িয়ে নিয়ে সবাই যার যার বাড়ি চলে গেল । পলাশ বাড়িতে গিয়ে দেখে তার বাবা কার সাথে যেন কথা বলছে , তার মা তাকে খাবার দিল । খাবার খেতে খেতে তার মাকে বলল, মা ওই লোকটি কে? মা বলল, লোকটা গাছের বেপারী, তোর বাবা একটা গাছ বিক্রি করবে তো ,তাই এসেছে । পলাশ জিজ্ঞা করল মা কোন গাছটা বিক্রি করা হবে? তোদের স্কুলে যাওয়ার পথের বকুল গাছটা ।
এ কথা শুনে পলাশের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল । সে বলল,মা বাবাকে বলনা গাছটা যেন বিক্রি না করে । কারন আমরা ৫জন বন্ধু, তাদের মাঝে গাছ ১জন । মা আমাদের অটুট ভেঙ্গে দিয়না ।
কিন্তু পলাশের বাবা যে বেপারিকে পাকা কথা দিয়ে দিয়েছে সে কথা পলাশ জানতনা । তারপর দিন স্কুলে যাওয়ার সময় সিহাব এবং পলাশ ঐ গাছের নিচে কিছুক্ষন বসে রইল । পলাশ গাছটাকে হাত বুলাচ্ছে । কিছু সময় পর তারা চলে গেল । তারা সবাই মনোযোগ সহকারে ক্লাস করল । কারন সিহাব ভাই গতকাল সবাইকে বলে দিয়েছে পরীক্ষার আগে দুষ্টুমি বন্ধ । সুতরাং সবাই সবগগুলো ক্লাস করে, বাড়ি ফেরার সময় দেখল ঐ গাছটি আর নেই । আকাশ বাতাস যেন স্তব্ধ হয়ে পড়ল । জায়গগাটুকু যেন শূন্য মরুভুমি বালিকাময় হয়ে রয়েছে । প্রকৃতি যেন নিবিড় হযে পিপাসায় ধূ-ধূ করছে । তাদের কন্ঠ যেন রুদ্ব হয়ে আসছে । আজ থেকে চির বিদায় নিল একটি নিধারুন বন্ধু,এই নিঝুমপুর গ্রাম থেকে । যার ব্যাথায় হৃদয় ঘাত হয়ে তীক্ষ্ণ বিষের যন্তনায় বুকটা কাতরাচ্ছে । সকলেই আঁখি জলে ফিরে গেল যার যার বাড়িতে । পরের দিন সিহাব বকুল গাছের শূন জায়গায় বসে একা একা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল ।
কিছুক্ষণ পরে আসল পলাশ, এরপর শেমল এবং ঝিনুক। তারপর তারা চারজন নিরবে বসে রইল। আজ ওরা স্কুলে যায়নি। ক্লাসে ইংরেজি স্যার এসে বলল ওরা কোথায়? একজন বলল,স্যার স্কুলে আসার পথে যে গাছটা ছিল তা গতকাল কর্তন করা হয়েছে তারা ঐ গাছের শূন্য জায়গায় বসে আছে। এ কথা শুনে স্যারও ব্যথা পেল । গাছের ভালবাসায় ছুটির পর স্যার ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে সেখানে গেল এবং দেখল এখনও তারা সেখানে বসে আছে। এ দেখে রায়হান স্যার তাদের কে সান্ত্বনা দিল এবং বলল, চল গিয়ে দেখি গাছটা কেন কর্তন করা হলো। ঐ দিকে পলাশের বাবা ও এসেছে তাদের সান্ত্বনা দিতে। কারণ সে জানতো না যে গাছটা তাদেও এতো প্রিয়। পথের মাঝে এতো ছাত্র-ছাত্রী,শিক্ষক ও সিহাব কে দেখে তার বুঝতে বাকী নেই যে তারা কার কাছে এসেছে । সিহাবের চক্ষু দিয়ে বৃষ্টির মতো অঝোর ধারে পানি ঝরছে। বাকীদেরও একই অবস্থা। পলাশের বাবা ও কেঁদে কেঁদে সিহাবকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,বাবা আমি জানতাম না যে, এই গাছটা তোমাদের এতো প্রিয়।
আমি কথা দিচ্ছি, যে ৪০ হাজার টাকা আমি গাছ বিক্রি করেছি তা দিয়ে আমি অনেক গুলো চারা গাছ কিনে তোমাদের নিয়ে রোপণ করব এই নিঝুমপুর গ্রামে। সবাই এতে অনকে খুশি হল। পরীক্ষার আর মাত্র ৭ দিন বাকী,স্কুল বন্ধ, সবাই বাড়িতে গিয়ে প্রস্তুতি নেবে। আজকের পর থেকে চার বন্ধুর কেউ কারো সাথে দেখা হচ্ছে না, কারণ সামনে পরীক্ষা। এদিকে সিহাবের প্রচুর জ্বর সে শুয়া থেকে উঠতে পারে না। এদিকে বাকীরা তো জানে না সিহাবের এই অবস্থা। সময় ঘনিয়ে এসেছে,আগামীকাল পরীক্ষা। সবাই রাত্রে সার্বিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর সিহাব পিড়াদায়ক যন্ত্রনায় ভুগছে। সকাল হলে সকলেই গোসল করে পরীক্ষার জন্য রওনা হল। শেমল,পলাশ ও ঝিনুক সকলেই হার্ডবোর্ড নিয়ে স্কুলে সিহাবের জন্য অপেক্ষা করছে। কারণ আজ অনেকদিন পরে চার বন্ধু এক সাথে সাক্ষাৎ হবে। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। সিহাব এখনো আসছে না। পরীক্ষার সময় ১০মিনিট ওভার হয়ে গেছে । তারা তনি বন্ধু সহিাবরে প্রত্যাশায় জানালার দিকে দৃষ্টি অবনত রাখছে। হটাৎ দেখা গেল যে সিহাবকে তার বাবা নিয়ে আসছে। এ দেখে শেমল,ঝিনুক ও পলাশ পরীক্ষা রেখেই কান্নার পরশ বুকে দামাচাপা দিয়ে বাইরে চলে এলো। গিয়ে দেখে সিহাবের সুন্দর চেহারা মলিন হয়ে গেল জ্বরের তীব্রতায়, সবাই সিহাবকে ধরে হলে নিয়ে এলো। সিহাব কোন রকমে ২ঘন্টা ভালই কলম চালাতে লাগল। পরে সে বেরিয়ে পড়ল। সাথে সাথে শেমল,পলাশ ও বেরিয়ে পড়ল এবং সিহাবকে বাড়ি পৌঁছে দিল। এরপর থেকে প্রতিদিন তারা তিনজন সিহাবকে পরীক্ষায় নিয়ে আসে। এভাবে সবগুলোা পরীক্ষা প্রায় ভালই দিয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ পরীক্ষাটা দিতে পারল না কারণ তার জ্বরটা আরো ত্বরান্বিত হয়েছিল। এদিকে সিহাবের বাবা ছেলের জন্য দু’নয়ন ভিজিয়ে একাকার করে দিয়েছিল। আর নয়নমনি মায়ের অবস্থা কেমন তা সবারই জানা । সিহাবের বাবা সিহাবকে গ্রাম্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল এবং ডাক্তার তাকে কিছু ঔষধ দিল। ডাক্তার বলল, সিহাবকে পরীক্ষা করাতে হবে,এ ঔষধ সমসাময়িকের জন্য কার্যকর । সিহাব ঔষধ সেবনের কিছুদিন পর সুস্থ হল। কিছুদিন পর পরীক্ষার রেজাল্ট ঘোষনা করার সময় ঘনিয়ে এলো। এরপর দিন রেজাল্টের জন্য সিহাব স্কুলে গেল। সকল ক্লাসের পর ৭ম শ্রেণীর রেজাল্ট ঘোষনা করতে পরিচালক স্যার বলতে লা লাগলেন যে, ১০ বিষয়ের মধ্যে ৯টিতে অংশ গ্রহণ সর্বাধিক নাম্বার পেয়েছে সিহাব। একটি বিষয়ে অনুপস্থিতির জন্য তাকে প্রথম স্থান বিবেচনা করতে না পারায় আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সুতরাং প্রথম স্থান অধিকার করেছে ঝিনুক,২য় স্থান সিহাব,৩য় স্থান শেমল এবং ৪র্থ স্থান পলাশ। এভাবে সবগুলো বলে সর্বশেষ ফেলুরটা বলল, এবার ফেলু পাশ করেছে। রেজাল্ট পেয়ে সবাই যার যার বাড়িতে চলে গেল। স্কুল ১৫দিনের জন্য ছুটি ঘোষণা করে দিয়েছিল। এবং ছুটির পাঁচ দিন পর বার্ষিক ক্রিয়া প্রতিযোগিতা শুরু হবে। হাটি হাটি পা পা করে পনের দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। বিজ্ঞপ্তির ঘোষণা অনুযায়ী ক্রিয়া প্রতিযোগিতা শুরু হলো। এবার ক্রিয়া প্রতিযোগিতায় সিহাব ক্রিকেট খেলায় ম্যান অব দ্যা ম্যাচ এবং অন্য সব গুলোতেও ভাল অবদান রেখেছিল,সাংস্কৃতিক পর্বেও সকল দর্শককে মাতিয়ে রেখেছিল একক ও যৌথ অভিনয়ের মাধ্যমেও। সর্বশেষ পুরস্কার বিতরণী পর্বে প্রধান অতিথির থেকে ক্র্যাস্ট গ্রহণ করল। সার্বিক দিক থেকে স্কুলের সুনাম এবং খ্যাতি অর্জনের জন্য সিহাবকে কিছু বলার জন্য প্রধান অতিথি অহ্বান জানালেন। আহবানে সাড়া দিয়ে সিহাব মঞ্চে উঠে দর্শকদের উদ্দেশ্যে এই বলে ভাষণ দিল যে, আমি একজন গরিব কৃষকের ছেলে,আমার এবং এই স্কুলের জন্য দোয়া করবেন আর ছাত্র ভাইদের উদ্দেশ্যে বলল, তোমরা ২৪ঘন্টার একটা রুটিন তৈরি করে পড়ালেখা করবে এবং সর্বশেষ এই ভূখন্ডে দন্ডায়মান জাতি গঠনের হাতিয়ার এই স্কুল যেন চিরদিন এই দেশের জন্য সৎ ও দক্ষ দশে প্রমেকি নাগরকি গড়ে তুলতে পারে। কেননা আজ হয়তো আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি আগামিতে এমন ও তো হতে পারে আমাকে এই সবুজ ভূখন্ড ছেড়ে চলে যেতে হবে।
এভাবে অনুষ্ঠানসূচি শেষ হলো । কয়েকদিন পর ৮ম শ্রেণীতে নতুন ক্লাস শুরু হবে। তারা চারজন আবার ও বার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নিল সেই পুরোনো ইতিহাস দিয়ে। নিত্য দুষ্টুমি,টাইম মত লেখাপড়া,নদীতে সাতার কাঁটা,এলাকার সংস্করণমূলক কাজ ইত্যাদি নতুন বছরের কর্মসূচি। এদিকে শেমলের বাবা আমেরিকার অধিবাসী, তিনি বছরে আট মাসই সেখানে থাকেন। সেখানে তাদের নিজস্ব ফ্ল্যাট আছে। আর পলাশের বাবার নিজস্ব বাড়ি চট্টগ্রামে,এই গ্রামে তারা জমি ক্রয় করে বাসা বাড়ি করেছেন। আর সিহাব এই গ্রামের মাটি ও মানুষের সন্তান। তারা তিন বন্ধু এভাবে বিভিন্ন স্থান থেকে একত্রিত হয়ে এই নিঝুমপুর গ্রামে লেখাপড়া করছে। এদিকে হাটি হাটি পা পা করে নতুন বছর অর্ধেক এর চেয়েও বেশি সময় শেষ হয়ে গেল। তাদের এ বছর সরকার অনুমোদিত সেন্টার পরীক্ষা দিতে হবে। সুতরাং সবাই ভাল করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে পলাশ এবং পলাশের পরিবার তাদের দাদুর বাড়ি চট্টগ্রামে চলে গেল। একমাস ঐখানে থেকে আবার তারা ফিরল এবং রুটিন মতো চার বন্ধু লেখাপড়া শুরু করল। কারণ তাদের ফাইনাল পরীক্ষা আর মাত্র দুই মাস বাকী। এরইে মধ্যে সিহাবের জ্বর আবার ও পুনরাবৃত্তি করল। এবার যেন অসুখ আর থামছে না । এই অসুখ নিয়েই লেখাপড়া করছে সিহাব। কিন্তু তারা চার বন্ধু সবাই নিরব হয়ে গেছে কারণ তাদের সামনে বার্ষিক পরীক্ষা এবং একসাথে খেলাধূলা করতে আর আসছে না । আবার সিহাবের ও অসুখ । আস্তে আস্তে এভাবেই যেন পরীক্ষা নিকটবর্তী হয়ে গেছে। সবাই নতুন জামা ক্রয় করেছে পরীক্ষার জন্য। আর সিহাব গরিব কৃষকের ছেলে, সে তেমন কোন বাহ্যিক প্রস্তুতি নেয়নি। এরই মধ্যে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। এখন যেন সিহাব কিছু সুস্থতা অনুভব করছে।
পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলে সারা দেশের সকল শিক্ষার্থীর মাঝে সিহাব ও পরীক্ষা দিতে লাগল। কিন্তু শেষের কয়েকটা পরীক্ষার আগে সিহাব পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়ল। এভাবেই যেন পরীক্ষা গুলো শেষ হলো। পরীক্ষা শেষ হওয়ার ১৫ দিন পর শেমল পলাশকে নিয়ে সিহাবদের বাড়িতে গেল। সিহাবকে নিয়ে এলাকায় ঘুরতে বের হলো। শেমল সিহাবকে বলল,দোস্ত আমাকে ক্ষমা করে দিস্,কত দুষ্টমি করেছি। সিহাব বলল, কেন কি হয়েছে । শেমল বলল, আমরা স্ব-পরিবারে আমেরিকা চলে যাচ্ছি,আমাদের জমি ও বাড়ি অল্প কিছুদিনের মধ্যে বিক্রি করে দেওয়া হবে। ঐখানে আমাদের ফ্ল্যাট আছে সুতরাং ঐখানেই চলে যেতে হবে। ওখানেই বাকী জীবন কাটাতে হবে। পিলাশরে এসব কথা শুনে সহিাবরে চোখ দয়িে পানি বৃষ্টির মতো ঝরছে। আচ্ছা ঠিক আছে , তবে ভাল করে লেখাপড়া করবে যেন। আর ওখানে নতুন বন্ধু গড়ে নিবে এবং তাদের সাথে মিলেমিশে থাকবে। এরই মধ্যে শেমল বলল, তোরা কিন্তু আমাকে শেষ বিদায় দিতে এয়ারপোর্টে যাবি। এই বলে শেমল আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। তারা তিন বন্ধু সারা বিকেল ধরে সারা গ্রামে ঘুরে বেড়াল। অবশেষে সন্ধ্যা লগ্নে যে যার বাড়িতে চলে গেল। বাড়িতে গিয়ে শেমল শুনতে পেল যে আগামীকালই তাদের চলে যেতে হবে এবং সারা রাতই তারা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল। নানান কিছু গোছাতে গোছাতে রাত শেষ হয়ে এল, ফযরের আযান শুনা যাচ্ছে। শেমল সিহাব কে নিয়ে পলাশদের বাড়ি গেল এবং সেখান থেকে মসজিদে নামাজ পড়তে গেল। নামাজ শেষে শেমল বলল, দোস্ত আমাদের সব কিছু ঠিক হয়ে গেছে , আজই আমাদের চলে যেতে হবে। এরই মধ্যে শেমলের কথা শুনে পলাশ এবং সিহাবের মুখটা মলিন হয়ে গেল। একজন অন্যজনকে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। এভাবে শেমল শেষ বিদায় নিল নিত্যদিনের বন্ধুদের কাছ থেকে ।
আবার সকাল আটটায় শেষ বিদায় নিয়ে হয়তো চিরদিনের জন্যই চলে যাব। শেমল এবং সিহাবের মনটা স্থির হয়ে গেল। তাই দু’জনে একত্রিত হয়ে নদীর ধারে চলে গেল। সিহাব বলল, আজ এই সবুজ ভূখন্ডে যেন আধার লাগছেরে,আমার সামনে যেন সব কালো আঁধার দেখছি । এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে পলাশ বলল,আমাদের পরীক্ষার রেজাল্ট তো আর একমাস পরে,তাই ভেবেছি চট্টগ্রামে দাদুর বাড়ি যাবো। মনটা যেন আমার মরুভূমি লাগছে,কিছুদিন পর পলাশ তার বাবা ও মায়ের সাথে চট্টগ্রাম চলে গেল। এদিকে পলাশ যাওয়ার পর থেকেই সিহাবের সেই জ্বর পুনরায় দেখা দিল।
এবার জ্বর যেন গভীর খারাপ রুপ ধারণ করছে। এভাবে অসুস্থতার মাঝে পনের দিন চলে গেল। সিহাবের অবস্থা অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। সিহাব যেন কোন এক ভূবনের যাত্রী হয়ে হতে যাচ্ছে। এলাকার অনেকেই সিহাবকে দেখতে আসে কিন্তু সিহাবের ভিতরটা বেদনায় সিক্ত হয়ে আসছে। কেননা স্মৃতিগুলো তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, বন্ধু গুলো আজ কত দূরে! যতই দিন যেতে লাগল সিহাবের অবস্থা ততই খারাপ হতে লাগল। তার যেন শেষ মূহূর্ত চলে আসছে। তার মা-বাবার চোখগুলো অশ্র“সজল হয়ে উঠল। চক্ষু দিয়ে রক্ত ঝরছে । এলাকায় সিহাবকে নিয়ে নানা গুঞ্জন । গরিব বাবার ছেলে বিদায় ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারছে না। সিহাবের ভিতরটা শুকিয়ে আসছে , শয়নে থেকে সেই স্কুলে যাওয়ার দৃশ্য মনে করছে। এভাবেই দিন পার করছে সে। শনিবার সারা দিন সিহাব করুন অবস্থা পার করে যখন রাত্রি হল,তার জীবন প্রবাহ যেন দিনের আলোর মত শেষ হয়ে আসছে। এভাবে সারা রাত পার হয়ে সুবহে সাদিক হয়ে গেল, ঐ দকিে মসজিদের মিনার থেকে আযান শুনা গেল। যখনই আস্ছালাতু খায়রুম মিনান নাউম বলা হলো, তখনই সিহাব চিরদিনের মতো বিদায় নিল এই নিঝুমপুর গ্রাম থেকে। সকাল হলেও যেন পাখির কিচির মিচির শুনা যাচ্ছে না,শূন্য পৃথিবীতে প্রবল বেগে বাতাস বইছে। সিহাবের মায়াময়ী মুখটা হলুদ হয়ে দেহটা লাশ হয়ে মাটিতে পরে রয়েছে। সিহাবের চলে যাওয়ার খবরটা প্রবল বেগে ছড়িয়ে পড়ল । কেউ যেন সিহাবের চলে যাওয়ার খবরটা বিশ্বাস করতে পারছে না। সকলেই তাকে দেখতে আসছে। আর দুঃখিনী মা বাবার অবস্থা তো সবারই জানা। কিছু সময় পর এলাকার গন্য মান্য ব্যক্তিরা এবং স্কুল শিক্ষকরা এসে দাফনের ব্যবস্থা করল। অবশেষে লেবু তলায় সিহাবকে চিরদিনের জন্য সয়ন কক্ষ বানিয়ে দেওয়া হল। চরিদনিরে জন্য চির নিদ্রায় চলে গেল সিহাব।
এদিকে ঝিনুকের বুকরে ভিতরটা খাঁ-খাঁ করে উঠল। এভাবে বিদায় নিবে সিহাব সে বুঝতেও পারল না । ঝিনুক যেন পৃথিবীকে উলট পালট দেখছে। ঐ স্কুলটা যেন চিরদিনে জন্য স্তিমিত হয়ে গেল। ঐখানে খেলাধূলা আর হয়না। এদিকে চট্টগ্রাম থেকে কছিুদিন পর পলাশ গ্রামে আসল। এসেই দেখল যে সিহাবের বাড়ির পাশে একটা কবর,সে ভাবল এটা কার কবর? যাই সিহাবকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে আসি। গিয়ে দেখে সিহাবদের বাড়িতে মানব শূন্যতা বিরাজ করছে। এলাকার কয়েকজনের কাছে জিজ্ঞাসা করে উত্তর পেল যে, সিহাব আর নেই ,চিরদিনের জন্য চলে গেল সিহাব। পলাশের বুঝতে বাকী রইল না যে, ওটা কার কবর ছিল। পলাশ সিহাবের কবরের পাশে গেল এবং দাঁড়িয়ে বলল, সিহাব তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে? আমিও চলে যাচ্ছি তোমাদের গ্রাম ছেড়ে,রইব না আর। এই সব বলে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। সিহাব ব্যথার পাহাড় বুকে নিয়ে চট্টগ্রামে চলে গেল। সকলকে ছেড়ে যাওয়ার ব্যথা রয়ে গেল এই স্মৃতি পটে।
অবশেষে তারা সবাই যার যার অবস্থানে থেকে বন্ধু শূন্যতা নিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে লাগল। নিঝুমপুর গ্রামের উচ্ছাস যেন চিরদিনের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
লেখক পরিচিতি :
মোঃ সেলিম মিয়া
গ্রাম- ভিটিপাড়া, ডাকঘর- সিংহশ্রী,
উপজেলা- কাপাসিয়া, জেলা- গাজীপুর।
১৯ জানুয়ারি, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এইচএস/কেএস