সেঁজুতি ইসলাম : আমার বাবাকে নিয়ে কোন স্মৃতি আমার নেই। কোন আনন্দের কথা, কোন কষ্টের কথা, কোন ভালোলাগা মন্দ লাগা, কোন শাসন কোন বারণ, কোন আদর কোন অভিমান.....কিছুই নেই আমার বাবাকে ঘিরে। বাবাকে নিয়ে খুব লিখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু লিখতে গেলেই চোখের সামনে ক্যানভাসটা ধূসর ধোঁয়াটে মনে হয়।
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে আমার বাবা আসলে কেমন মানুষ ছিলেন....আমি যতটুকু জেনেছি বা শুনেছি বাবার বন্ধুদের কাছ থেকে, আমার বাবা খুব ভালো কবিতা লিখতেন, গল্প লিখতেন।
আমার দাদা বাড়ি ছিলো পদ্মা নদীর তীরে। বাড়ির সামনে বিশাল নদী, তার পাড়ে বসে বাবা কবিতা লিখতেন। নদীতে চলতো পালের নৌকা, লঞ্চ, আর তরুণ কবি বসে বসে আনমনে কবিতা লিখতেন। বাবার এক বন্ধু আমায় একদিন বলছে, ‘তোমার বাবা কি ভালো লিখতো,আবার সেগুলো আবৃত্তি করে আমাদের শোনাতও, আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা শুনতাম’।
আমাদের এখনকার মতো তখন এতো সুযোগ সুবিধা তো আর ছিলোনা বই প্রকাশ করার বা কবিতা ছাপানোর, থাকলে হয়ত আমার বাবার কিছু লেখা আমি পেতাম আজ।
আমি তখন ক্লাস টু তে পড়ি। তখন একবার আমার দাদা বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার চাচা আমাকে অনেক গুলো খাতা দেখিয়ে বলেছিলেন, এগুলো তোর বাবার লেখা। তখন ওই লেখাগুলো কতটা দামী হতে পারে আমার কাছে, এটা বুঝিনি। আমি দু’ একটা পড়েছিলামও কিন্তু সে কথাগুলোর মানে তখন আমি বুঝিনি বলে অতটা গুরুত্ব পায়নি আমার কাছে।
তখন আমার ছড়া পড়ার বয়স, আমি কি বুঝি এত শক্ত শক্ত কথা? যদি বুঝতাম তাহলে যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতাম। তাহলে আজ আর আমাকে স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতে হতোনা। আমার দাদা দাদি আমার বাবার স্মৃতি গুলো জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না কাটি করতো। আমার সাথে আমার দাদার যে কবার দেখা হয়েছে, ততবারই আমি তাকে কাঁদতে দেখেছি। আমার বাবাই ছিলেন তাদের প্রথম সন্তান।
আমাকে বাবাকে তারা ভালোবাসতেন ঠিকই, তবে বাবার কন্যা সন্তান হিসেবে আমাকে কখনও তারা মেনে নিতে পারেননি। আমি যদি মেয়ে না হয়ে ছেলে হয়ে জন্ম গ্রহণ করতাম, তাহলে হয়ত দাদা বাড়ি আমার ঠিকানা হতো। মৃত পুত্রের স্ত্রী ও কন্যা সন্তানের দায় ভার কে গ্রহণ করতে চায়? মেয়েকে বড় করতে হবে, লেখাপড়া শেখাতে হবে, আবার ভালো পাত্র দেখে বিয়েও দিতে হবে। এসব করার কার এতো দায় পড়েছে। তাই আমার আর মায়ের আশ্রয় মেলেনি দাদার বাড়িতে। এ জন্য আমার কোনো কষ্ট নেই, তবে ক্ষোভ আছে অনেক।
আমি যখন ক্লাস ফোর এ পড়ি তখন আমাকে একেবারে নিয়ে যাবার জন্য লোক পাঠিয়েছিলো, আমি যাইনি। কেনো যাবো? তখন তো আমি বুঝতে শিখেছি সব, আমার মাকে ঘিরে আমার একটা আলাদা জগত তৈরি হয়েছে। কেনো যাবো আমি তাদের কাছে? কে হন তারা আমার? তাও আবার আমার মাকে ছেড়ে থাকতে হবে। সেটা কি করে সম্ভব?
পরে শুনেছি পদ্মা নদীতে ভেঙ্গে গেছে দাদার বাড়ি ঘর ফসলের জমি সবকিছু। আর সাথে করে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে আমার বাবার সেই লেখা কবিতার খাতা গুলো। বাবার সব স্মৃতি গুলোও ভাসিয়ে নিয়েছে সর্বনাশী পদ্মা নদী।
বাবার কোন ছবিও আমি দেখিনি কখনও। একটা ছবি আমাদের ঘরে ছিলো, তখন আমি অনেক ছোট, এই তিন চার বছর বয়স হবে, আমার মা তখন কাশিয়ানী উপজেলায় হাসপাতালে চাকরি করতেন। আমরা মা মেয়ে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। রাতের বেলা চোর এসে আমাদের ঘরের সব জিনিস চুরি করে নিয়ে গেছে, সাথে দেয়ালে টানানো ছবিটাও। আমার আর বাবার মুখ দেখা হলোনা...
আমার বাবা একজন তালিকা ভুক্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হলেও সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোনো দাম নেই। শুধু দাম বেড়ে যায় এই ১৬ ডিসেম্বর এলে। এই বিজয়ের মাস এলেই।
১৬ ডিসেম্বর এলে আমাকে খবর দেয়া হয়। আমাকে বলবে, ‘শোনো, তোমার বাবাকে ও সকল মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে আমরা একটা আলোচনা সভার আয়োজন করেছি, তুমি এসো’। আমি কোনোদিনও যাইনি। গেলে হয়তো শহীদ মুক্তিযোদ্ধার একটা মেডেল অথবা একটা ক্রেস্ট আর কিছু উপহার সামগ্রী হাতে ধরিয়ে দেবে, কিছু বানানো বক্তৃতা শুনতে হবে, আর গলা ফাটিয়ে ফাটিয়ে চিৎকার করে বলবে, আমরা তোমাদের ভুলবনা....
আমি কখনও যাইনি সেখানে। কেনো যাবো আমি? সারা বছর তো কেউ আমার বাবা বা আমাদের খবর নেননা, সরকারও জানতে চাননা কেমন আছে শহীদ পরিবার গুলো, কেমন আছে শহীদের সন্তানেরা?
এ দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে আমার বাবা জীবন দিয়েছেন। আমিই কেবল বুঝি বাবা না থাকলে কতটা কষ্ট হয়। আমিই কেবল বুঝি কতটা ক্ষতি হয়েছে আমার। আমার শৈশবটা হয়তো আরো সুন্দর হতে পারতো। আমিও আর ১০ টা বাচ্চার মতো বাবার হাত ধরে পথ চলতে পারতাম। আমিও সবার কাছে বাবাকে নিয়ে গল্প করতে পারতাম। কেউ আমায় বকলে দৌড়ে বাবাকে নালিশ করতে পারতাম। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আমিও হয়তো রাক্ষসের অথবা পরী রানীর গল্প শুনতে পারতাম.....
মুক্তিযুদ্ধ কার কি ক্ষতি করেছে আমি জানিনা, কিন্তু আমার কেড়ে নিয়েছে সব। আমার শৈশব কৈশোর আমার ভবিষ্যৎ সব কিছু। হয়তো বাবা থাকলে আমার জীবনটা আরো একটু সুন্দর হতে পারতো। আরো একটু সুন্দর হতে পারতো আমার জীবন। সন্তানের জীবন সাজানোর দায়ভার তো বাবাই তুলে নেন কাঁধে। যে সুযোগ থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি।
সবাই বলে, ‘তুমি তো গর্বিত, তোমার বাবা একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা’। আমার বাবার মৃত্যু কি করে আমার জন্য গর্বের বিষয় হয়? সেখানে কতটা হাহাকার লুকিয়ে আছে, তা কেবল আমিই জানি। আর জানেন আমার চিরদুঃখী মা।
মাকে কখনও বাবার কথা বলতে শুনিনি, আর মা কষ্ট পাবে বলে আমিও আর কখনও জানতে চাইনি, বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছি সব সময়। আমার মায়ের স্বপ্ন গুলো বালির বাঁধের মতো ভেঙ্গে দিয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধ....
এতো ত্যাগ করার পরেও যদি এ দেশের মানুষ গুলো ভালো থাকতো, শান্তিতে থাকতো, তবুও না হয় মনকে সান্ত্বনা দিতাম, না আমার বাবার রক্ত বৃথা যায়নি....বৃথা যায়নি আমার ভবিষ্যৎ.....আর বৃথা যায়নি আমার মায়ের স্বপ্ন...আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, দেখে যাও বাবা....কতটা ভালো আছে তোমার রক্তে গড়া সোনার বাংলার মানুষ গুলো....একবার এসে দেখে যাও। লেখক : কবি ও গল্পকার
২৬ মার্চ, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন