আবু এন. এম. ওয়াহিদ: মনু মিঞার দাদা তৈয়ব আলী মুন্সী মারা গেছেন অনেক আগে। মৃত্যুর আগে তিনি বাড়ির জমা বিক্রি করে দেন মাস্টার সা’বের লন্ডনপ্রবাসী এক ভগ্নিপতির কাছে। তৈয়ব আলীর আর্থিক অবস্থা খুব স্বচ্ছল না হলেও দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থায় সংসার চলে যেত। মাস্টার সা’বের সাথে তৈয়ব মুন্সীর খুব স্বদ্ভাব ছিল। তৈয়ব আলী মাঝেমধ্যে তাঁর দিল-দরাজ আর্থিক আনুকূল্যও পেতেন। মাস্টার সা’ব মুন্সীকে বেশ সমীহ করতেন। রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও তিনি তাঁকে তৈয়ব ভাই বলেই ডাকতেন। মাস্টার সা’বের ডাকে তৈয়ব আলী সব সময় এক
পায়ে খাড়া থাকতেন। যে কোনো কাজে ডাক দিলেই তৈয়ব মুন্সী দৌড়ে আসতেন। গলগজায় তাঁর বাড়ি বেচার পর তৈয়ব আলী মুন্সী মরা ধামাইর পূব পারে পাকা ব্রিজের দক্ষিণ দিকে নতুন বাড়ি কাটান। কয়েক বছরের মধ্যেই বাঁশঝাড়, শিমুল, কদম, আর করই গাছে নতুন বাড়ি সবুজে সবুজময় হয়ে ওঠে। তৈয়ব মুন্সী ও তাঁর স্ত্রী নতুন বাড়িতে উঠে আসেন। তাঁর একমাত্র ছেলে ফরমুজ আলীও বউছেলে নিয়ে থাকে মা-বাবার সাথে। এক ছেলে হওয়ায় সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়নি। পিতার জমিজমা যেটুকুই ছিল ফরমুজ একাই ভোগ দখল করছিলেন। অনেক দিন পার হয়ে গেছে। তৈয়ব মুন্সী আজ আর নেই। ফরমুজ আলীও অসুস্থ - এই আছেন এই নেই!
সংসারের দায়-দেনা এখন ফরমুজ আলীর ছেলে মনু মিঞার ঘাড়ে। সে এখন রীতিমত তাগড়া জোয়ান। বয়স চল্লিশের নীচে। মনু মিঞা বেশ কয়েক বছর তালিমপুর ইউনিয়নে চৌকিদারি করেছে। কাজে গাফলতির জন্যে চেয়ারম্যান সা’বের বকাবকিতে রাগ করে হঠাৎ সেদিন চাকরি ছেড়ে দিল। বাড়তি দু’পয়সা আয়ের পথ মনু মিঞার জন্যে বন্ধ হয়ে গেল। এ নিয়ে মনু মিঞার বউ মালতী তার সাথে দিন রাত ক্যাটর ক্যাটর করে। মনু মিঞার শ্বশুরবাড়ি কাঞ্চনপুর। ওগাঁয়ে মালতী নাম একবারেই বেমানান। এ নামের পেছনে একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। মালতীর জন্ম হয়েছে তার নানার বাড়ি খুটাউরার আব্দুল হাকিমের ঘরে। আব্দুল হাকিম পৃত্থিম পাশার জমিদার বাড়িতে অ্যাসিস্টেন্ট বাবুর্চির হেল্পার ছিল। জমিদার বাড়ির জলসা ঘরে একবার লৌক্ষ্নু থেকে মালতী নামের এক বাইজি এসেছিল নাচতে। ওই বাইজির নামে আব্দুল হাকিম নাতনির
নাম রেখেছিল মালতী।
চৌকিদারি ছেড়ে মনু মিঞা এখন মনোযোগ দিয়ে ক্ষেতকৃষি করে সাথে মাছও ধরে। নিজে খায়; কোনো দিন বেশি ধরতে পারলে হাটে নিয়ে বিক্রি করে। মালতী তাতেও খুশি নয়। কারণ আগের মত মাস পুরলেই নগদ টাকার আমদানি হয় না। টাকার প্রতি মালতীর আকর্ষণ অস্বাভাবিক রকমের বেশি। মালতী আর দশ পাঁচ জন গেঁয়ো বধুর মত নয়। তার একটু আধটু সখ-আহ্লাদ আছে। একটু আধটু নয়, বরং একটু বেশিই। মাসে মাসে ঢাকাইয়া ফেরিওয়ালার কাছ থেকে তার কাঁচের চুড়ি, ইমিটেশনের কানের দুল, গলার হার, নাকের নথ, তার ওপর চুলের ফিতা, ক্লিপ ইত্যাদি সবই কেনা চাই। পাড়াগাঁয়ে মেয়েদের এমন সখ, কী গলগজা কী কাঞ্চনপুর কোথাও সচরাচর দেখা যায় না। মাসে মাসে শুধু নতুন গয়না কেনা আর পরাই নয়, পুরান হলে সেগুলো আবার ছোট বোনকে দিয়ে দেয়। মনু মিঞা সব জানে না। তবে বুঝতে পারে এরকম একটা অচানক সখ আছে তার বউ-এর। অপছন্দ হলেও মনু মিঞা মুখ ফুটে বউকে কিছু বলে না।
জমি বিক্রি করে মনু মিঞা ছেলে আমজাদকে সৌদি আরব পাঠিয়েছিল। কিন্তু কাজে লাগেনি। মূলধন তোলার আগেই আমজাদ দেশে ফেরত আসে। ছেলে এখন মনু মিঞার গলার কাঁটা। বেকার ঘোরাঘুরি করে। মাঝে-মধ্যে রাজমিস্ত্রীর সাথে যোগালীর কাজ করে। ইচ্ছে হলে এক দিন যায়, তো তিন দিন কাজে যায় না। এতে তার বিড়ি সিগ্রেটের পয়সা হয় মাত্র, কিন্তু মা বাবার হাতে দু’টাকা তুলে দিতে পারে না। মালতী আমজাদকে বিয়ে করাতে চায়। মনু মিঞা এতে রাজি নয়। মনু মিঞার কথা, ‘আমজাদের বয়স হলেও বিয়ে করে সংসার করার
মত পরিপক্ষতা আসেনি’। ‘আমি নাতি নাতনির মুখ দেখতে চাই। বয়স তো কম হল না। হঠাৎ কোন দিন মরে যাব, সখ আহ্লাদ আর পুরো হবে না,’ মালতীর আব্দার। মনু মিঞার মন এখন এতো সহজে আর গলবার নয়। আমজাদকে নিয়ে মনু মিঞার চিন্তার কোনো শেষ নেই! যে দিকে যায় ঝগড়া ফ্যাসাদ করে, মারামারি করে। যার তার সাথে মেজাজ করে, এতে তার কোনো বাছবিচার নেই। আমজাদের নামে মনু মিঞার কাছে হর হামেশা নালিশ আসে। কোনো কাজও করে না, কথাও শুনে না। আমজাদের কারণে মনু মিঞার যত অশান্তি!
বেয়াড়া ছেলেকে নিয়ে কী করবে কিছুই ভেবে পায় না। সেদিন বড়লেখা বাজারে মাছ দামদর করতে গিয়ে থানার দারোগা বাবুর কাজের ছেলের সাথে গালাগালি হাতাহাতি করেছে। পরদিন সকালে পুলিশ এসেছিল মনু মিঞার বাড়ি আমজাদের খোঁজে। আমজাদ ঘরে ছিল না। পেলে থানায় ধরে নিয়ে যেত। থানা-পুলিশ যে কী জিনিস মনু মিঞা ভাল করেই জানে!
মনু মিঞার বয়স যখন দশ, তখন কী কারণে তার বাপকে একবার পুলিশ থানায় ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তিন দিন পর ছেড়েছিল, কিন্তু ফরমুজ আলীকে এমন ভাবে মেরেছিল যে হেঁটে বাড়ি আসতে পারেনি। তাকে পলোতে বসিয়ে দুইজন ঘাড়ে করে বয়ে এনেছিল বাড়িতে। ফরমুজ আলীর সুস্থ হতে তিন মাস সময় লেগেছিল। মা’রের চোটে বাঁ হাতের কনুই ভেঙ্গেছিল সেটা আর কোনো দিনই ঠিক হয়নি। থানা-পুলিশ আমজাদকে খুঁজছে এটা ভাবলেই মনু মিঞার গায়ে রীতিমত জ্বর আসে। পুলিশ যখন ফরমুজ আলীকে ধরে নেয় তখন থেকে - পুলিশ দেখলেই মনু মিঞা ভয়ে কাতর হয়ে যায়! সেই ছোট বয়স থেকেই মনু মিঞা হামেশা আল্লার কাছে দোয়া করে, ‘পুলিশের মনে যেন রহম করম হয়।
পুলিশ যেন মানুষ হয়। মানুষের সাথে যেন মানুষের মত ব্যবহার করে - হউক না তারা চোর ডাকাত। চোরও তো মানুষ। তারও ত বিচার পাওয়ার অধিকার আছে’।
আমজাদের ওপর থানা-পুলিশের নজর পড়েছে। মনু মিঞার ভয়ের শেষ নেই! আমজাদের চিন্তায় তার ঘুম হারাম। কখন যে তার ছেলেকে থানায় ধরে নিয়ে যায় এই ভাবনায় মনু মিঞা অস্থির। মাঝে মধ্যে রাতে হঠাৎ করে মনু মিঞার ঘুম ভাঙে। পুলিশ পুলিশ করে ভয়ে কাঁপতে থাকে। এর মধ্যে এক দিন চেয়ারম্যান সাব মনু মিঞাকে ডেকে নিয়ে বলেছেন, আমজাদকে সাবধানে চলা ফেরা করতে। থানা-পুলিশ তাকে খুঁজছে। আমজাদকে মনু মিঞা নানার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করে। কার কথা কে শুনে! আমজাদ বাপের কথায় পাত্তাই দেয় না। বেপরোয়া চলা ফেরা করে। এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে, আর পথে-ঘাটে তার ফেতনা ফসাদ তো লেগেই আছে। মনু মিঞা বিপদ আসনড়ব বুঝতে পারে। তিন দিন পর শবে বরাত। মনু মিঞা ঠিক করে সারা রাত মসজিদে কাটাবে, আল্লার কাছে কানড়বাকাটি করবে, দোয়া করবে
যেন পুলিশ মানুষ হয়। মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতন বন্ধ করে, ইত্যাদি,ইত্যাদি। শবে বরাত চলে গেছে, মনু মিঞা তার প্রতিজ্ঞা মত সারারাত মসজিদেই ছিল। এবাদত করেছে, দোয়া করেছে। আল্লা যেন পুলিশকে ভাল করে দেয়। শুধু বড়লেখায় নয়, সব জায়গায, সারা দেশে। শুধু আমজাদের জন্যে নয়। সবার জন্যে। সব মানুষের জন্যে। মনু মিঞার দৃঢ় বিশ্বাস শবে বরাতের রাতে তার দোয়া কবুল হয়েছে।
মনু মিঞার মনের অশান্তি একটু কমেছে। স্বাভাবিক কাজকর্ম করছে, মাছ ধরছে। একদিন বাজারে মাছ বেচতে গেছে মনু মিঞা। দারোগা বাবু হাটে মাছ কিনতে এসে মনু মিঞাকে বলেছেন আমজাদকে নিয়ে পরদিন থানায় যেতে।
মনু মিঞার বিশ্বাস দোয়া কবুল হয়েছে। পুলিশ আমজাদকে মারবে না। সে পরদিন আমজাদকে খবর দিয়ে নানা বাড়ি থেকে আনিয়ে থানায় নিয়ে গেছে। থানা-পুলিশ আমজাদকে রেখে মনু মিঞাকে বাড়ি চলে যেতে বলেছে। মনু মিঞার মনে অশান্তি আমজাদের কী হয়! যদিও দারোগা বাবু বলেছেন আমজাদকে পরদিনই ছেড়ে দেবেন। তবু মনু মিঞা বিশ্বাস করতে পারছে না।
আবার অবিশ্বাসও হচ্ছে না। আল্লার ওপর পূর্ণ ভরসা রাখতে চায় মনু মিঞা। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মনু মিঞা বাড়ি চলে আসে। ছেলের চিন্তায় মনু মিঞার নাওয়াখাওয়া বন্ধ। সারাদিন মসজিদে পড়ে থাকে আর আল্লার কাছে কানড়বাকাটি করে। এক দিন, দু’ দিন, তিন দিন, আমজাদ আর বাড়ি ফিরে না। থানা থেকে কোনো খবরও আসে না। মনু মিঞার মনে নানান চিন্তা। এ রকম অবস্থায় প্রিয়জনকে
নিয়ে ভালোর চেয়ে খারাপ ভাবনাটাই মনের মধ্যে ঘুরেফিরে ঘুরপাক খায় বেশি। মনু মিঞার মনও একই দোলাচালে দুলছে। কখনো ভাবে আমজাদ ভালই আছে। আবার কখনো ভাবে ছেলেটাকে বুঝি মেরে শেষ করে ফেলল!
সাত দিনের মাথায় থানা থেকে খবর এল, আমজাদ আর নেই। উপর্যুপরি পুলিশী নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আমজাদ মারা গেছে।
আমজাদের জন্যে মনু মিঞার আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই, দুর্ভাবনা নেই, নেই কোনো অস্থিরতা। মনু মিঞা জানে, আমজাদ এখন সব জ্বালাযন্ত্রণার ঊর্ধ্বে।
আমজাদের বিদেহী আত্মা ধুলোমাটিতে মাখা অশান্ত এই পৃথিবীর সকল সীমানা পেরিয়ে মিশে গেছে মহা শান্তির মহাসাগরে। তবু মনু মিঞা কাঁদছে। তার চোখের পানি অঝোরে ঝরছে। মানছে না কোনোই বাধা। কিন্তু মনু মিঞার এ কানড়বা পুত্রশোকে নয়! সে কাঁদছে শবে বরাতের রাতে তার দোয়া আল্লার দরবারে কবুল হয়নি বলে - পুলিশ মানুষ হয়নি বলে।
- অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ
৯ এপ্রিল ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এইচএস/কেএস