আবু এন. এম. ওয়াহিদ: ২০০২ সালের গ্রীষ্মের ছুটিতে টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে দু’জন সহকর্মী, ফিস্টাস ওলোরনিও এবং অ্যালেন মিলারসহ আমাকে যেতে হয়েছিল আফ্রিকার মালাওয়িতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকারের একটি গ্র্যান্টের অধীনে আমরা গিয়েছিলাম মালাওয়ি ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট – সংক্ষেপে যাকে বলে মিম (এমআইএম)। বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সাহায্যে কয়েক বছর আগে মালাওয়ির রাজধানী লিলোংওয়ে-তে স্থাপিত মিম একটি আধুনিক শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান। মিম, মালাওয়ির সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের এবং এনজিওভুক্ত উন্নয়ন ও সমাজকর্মীদের প্রশাসন ও সুশাসন বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। আমরা গিয়েছিলাম মিম-এর কয়েকজন প্রশিক্ষক ও রিসার্চ ফেলোর সাথে যৌথ গবেষণামূলক কাজে সহযোগিতার জন্যে।
সহকর্মী ফিস্টাস, নাইজেরীয় বংশোদ্ভূত। তিনি মালাওয়ি যাওয়ার পথে স্বদেশে আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করে যাবেন বলে ন্যাসভিল থেকে আমাদের দু’সপ্তাহ আগেই রওয়ানা দিয়েছিলেন। তাই মালাওয়ি যাওয়ার সময় আমার সাথে ছিলেন শুধুই সহকর্মী অ্যালেন। অ্যালেন এবং আমি ন্যাসভিল থেকে আমেরিকার মোটরনগরী ডেট্রোয়েট, অ্যামস্টারড্যাম এবং জোহন্সবার্গ হয়ে দু’দিনের সফর শেষে মালাওয়ির রাজধানী লিলোংওয়ে-তে গিয়ে পৌঁছলাম। যাওয়ার পথে জোহন্সবার্গে কাটালাম একরাত। জোহন্সবার্গ এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাওয়ার পথে মে মাসের রাতে থরথর করে শীতে কাঁপছিলাম। এর আগে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে আমার যাওয়ার কোনো সুযোগ হয়নি। দক্ষিণ গোলার্ধের আরেকটি বৈশিষ্ট্য আরো পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ল যখন মালাওয়িতে গেলাম। মে মাসে বাংলাদেশে যখন গাছে গাছে আম পাকতে শুরু করে, ঠিক তখন মালাওয়িতে দেখলাম অসংখ্য আমগাছে মাত্র মুকুল এসেছে। উপলব্ধি করলাম মহান আল্লাহ্ পৃথিবীকে এভাবেই বৈচিত্র্যময় করে গড়ে তুলেছেন!
যাওয়ার সময় প্রজেক্ট খরচ, পার্টনারের বেতন-ভাতা এবং নিজের হাতখরচ বাবদ নিতে হয়েছিল নগদ প্রায় তিন হাজার ডলারের মতো। সহকর্মী ফিস্টাস, চেক তৈরি হওয়ার আগে চলে যাওয়ায় তাঁর তিন হাজার ডলারও আমাকে নিয়ে যেতে হয়েছিল। ডলার বেশি হওয়ায় নগদ না নিয়ে অ্যামেরিকান এক্সপ্রেস ট্র্যাভেলার্স চেক করে নেয়ার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাকাউন্টস অফিস থেকে বলা হয়েছিল। সরকারি ডলার, তাই সরকারি নির্দেশ শিরোধার্য। আমি আর অ্যালান যেদিন মালাওয়ি গিয়ে হাজির হলাম তার পরদিনই ফিস্টাস নাইজেরিয়া থেকে এসে আমাদের সাথে যোগ দিলেন। মালাওয়ি মুদ্রা আমাদের কারো সাথেই ছিল না। তাছাড়া প্রজেক্ট পার্টনারদেরকে তাঁদের ডলারও বুঝিয়ে দিতে হবে, তাই দেরি না করে ফিস্টাস আসার পরদিনই ট্র্যাভেলার্স চেক ভাঙানোর জন্য আমরা তিনজনই লিলোংওয়ে-র সিটি সেন্টারে গেলাম। দিনটি ছিল সপ্তাহের শেষদিন, অর্থাৎ শুক্রবার। যাওয়ার সময় আমাদের সাথে আমাদের আঞ্চলিক কাউন্টারপার্টগণও ছিলেন। লিলোংওয়ে-র সিটি সেন্টার দেখে হতাশ হলাম। একটি দেশের রাজধানী অথচ বাংলাদেশের যে কোনো উপজেলা শহর থেকে অনেক পেছনে। সারা শহরে একটিমাত্র বহুতল ভবন। তাও মাত্র পাঁচ-ছয়তলা। সেটা দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবালয়।
প্রথমে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো একটি বিদেশি প্রাইভেট ব্যাংকে ট্র্যাভেলার্স চেকগুলো ভাঙানোর জন্যে। ওখানকার রেট ভালো না হওয়ায় আমরা একে একে কয়েকটা ছোট ছোট দেশি ব্যাংকে গেলাম। তারপর এলাম এক মানি এক্সচেঞ্জ সেন্টারে। কাঁচের জানালার পেছনে ছোট্ট একটি ঘর – সিনেমা হলের বক্সঅফিস বা টিকেটঘরের মতো। সামনে একটু বসার জায়গা আছে, কিন্তু আমরা না বসে সবাই দল বেঁধে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভেতরে দেখলাম তিন-চারজন তরুণী এবং একজন পুরুষ, সম্ভবত তিনি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটির মালিক অথবা ম্যানেজার। আমরা কেউই মালাওয়ির আঞ্চলিক ভাষা জানি না। আমাদের বন্ধুরা আমাদের হয়ে কথা বলছিলেন। এক পর্যায়ে আমাকে বলা হলো প্রত্যেকটি ট্রেভেলার্স চেকের অরিজিনাল রিসিট বের করে দিতে। ন্যাসভিলে যখন ট্র্যাভেলার্স চেক কিনি, তখন আমাকে ব্যাংকটেলার চেকের রিসিট দিয়ে বলেছিলেন, এগুলো সব যতেœর সাথে চেক থেকে সবসময় আলাদা করে রাখতে যাতে ট্র্যাভেলার্স চেক এবং রিসিট কখনো একসাথে হারিয়ে না যায়। টেলার আরো বলেছিলেন, ট্র্যাভেলার্স চেক ভাঙানোর সময় রিসিট সাথে করে নিয়ে যেতে। বলেছিলেন, ওই সমস্ত দেশে রিসিট ছাড়া ট্র্যাভেলার্স চেক ভাঙাতে অসুবিধা হতে পারে। আমি রিসিটগুলো আলাদা করে যতেœর সাথে রেখেছিলাম ঠিকই, কিন্তু ওইদিন বেরোবার সময় স্যুটকেস এবং হ্যান্ডব্যাগে অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোথাও রিসিটগুলোর কোনো হদিস পাইনি। বুঝতে পারলাম আমি একটা বড় ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেছি! অনেক বুঝাবার চেষ্টা করলাম, “আমি একজন প্রফেসর, আমেরিকা থেকে এসেছি সরকারি কাজে। আমি কোনো চোর-বাটপাড় নই। আর আজ টাকা ভাঙাতে না পারলে আমার অসুবিধা হবে, তোমাদের দেশের লোকদের বেতন-ভাতা দিতে পারব না, প্রজেক্টের অসুবিধা হবে ...” ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কার কথা কে বোঝে! সকল চেষ্টা বিফলে গেল। আমাদের প্রজেক্ট পার্টনাররাও নাছোড়বান্দা। অনেকক্ষণ ধরে তর্কবিতর্ক করলেন, অনুনয়-বিনয় করলেন, কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। অবশেষে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না!
এমন সময় একটি মেয়ে আমাদের সামনে এসে আমার কাউন্টারপার্টের কাছে মালাওয়ি ভাষায় আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে চাইল। তিনি আমাকে কীভাবে চেনেন? আমি কেন ওখানে গিয়েছি? কোথায় উঠেছি? কতদিন মালাওয়িতে থাকব? ইত্যাদি ইত্যাদি। মেয়েটিকে দেখতে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মনে হল। কাউন্টারপার্টের সাথে কথা শেষ করে আমাকে এসে পরিষ্কার বাংলায় বলল, “আপনার ট্র্যাভেলার্স চেকগুলো দিন”। লিলোংওয়ে-তে বাংলা কথা শুনে, মনে হল আমি যেন হাতে আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কী করে জানলেন যে আমি বাংলাদেশি?” মেয়েটি বলল, “আপনার পাসপোর্টে লেখা আছে জন্মস্থান বাংলাদেশ”। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, সমস্যার সমাধান তা হলে হয়ে গেছে! আক্ষরিক অর্থে হলোও তাই! টাকাপয়সা সব বুঝে নিলাম। মনে হলো আমার জন্য অন্যেরাও রেট একটু ভালো পেলেন। তারপর মেয়েটির সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। আমাকে তার বাড়ি যাওয়ার জন্য দাওয়াত করল। নিজের নাম-ঠিকানা ও ফোন নাম্বার লিখে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিল আমার হাতে ।
মেয়েটির নাম বিবি আমিনা। বাবার নাম মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান। দেশের বাড়ি বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার সেনবাগ উপজেলায়। তিনি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। মালাওয়িতে ব্যবসা করেন। অনেক বছর আগে এক বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে মালাওয়িতে এসেছিলেন। কোম্পনি লালবাতি জ্বালিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর মান্নান সা’ব আর দেশে ফিরে যাননি। শুরু করেন ব্যবসা। তিনি মালাওয়িতে একজন সফল ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। সময়ের অভাবে কথা আর বেশি হলো না। আসার সময় আমিনা আমাকে বলল, “আপনি কাল অবশ্যই আমাদের বাসায় আসবেন”। আমি তাকে কথা দিয়ে সবার সাথে মালাওয়ি ইনস্টিটিউট হোস্টেলে ফিরে এলাম। পরদিন সকালে আমিনার বাবাকে ফোন করলাম। মান্নান সা’ব কথা বলতে বলতে আমাকে নেয়ার জন্য তাঁর ছেলেকে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিলেন মালাওয়ি ইনস্টিটিউট হোস্টেলে। এক/এগারোর অব্যবহিত পরে বলেই নিরাপত্তার কারণে আমাদের টিমলিডার, মান্নান সা’বের বাড়িতে আমাকে যেতে দিলেন না। মান্নান সা’বের ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে আমার ভীষণ খারাপ লাগল।
ওইদিন মান্নান সা’বের সাথে আমার অনেক কথা হলো। তাঁর সাথে কথা বলে মনে হলো তিনি যেন আমার কতদিনের চেনাজানা লোক! কত আপন! আফ্সোস, লিলোংওয়ে-তে মান্নান সা’বের বাড়ি আমার যাওয়া হয়নি। বিবি আমিনাকে কথা দিয়ে তার বরখেলাফ করলাম। তবে ড্যাটা কালেকশনে মান্নান সা’বের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়েছি। তাঁর ওয়্যারহাউসে গিয়েছি। মালাওয়ির অন্যান্য শহরেও তাঁর বিশাল ব্যবসা দেখেছি। মান্নান সা’ব সারা দেশে চাল, ডাল, তেল, আটা, ময়দা, চিনি, সিমেন্ট, রড, ঢেউটিন ইত্যাদির একক আমদানিকারক ও বিতরণকারি। তিনি মালাওয়ির সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী না হলেও তাঁদের একজন। তারপর আমি পৃথিবীর আরো অনেক দেশে গিয়েছি। অনেক বাংলাদেশির সাথে দেখা হয়েছে। অনেকের সাথে কথা হয়েছে। অনেকের বাড়িতে গিয়েছি। অনেকের বাড়িতে খেয়েছি। অনেকের বাড়িতে থেকেছিও, কিন্তু কোথাও আরেকজন মান্নান সা’বের দেখা পাইনি। আরেকজন বিবি আমিনার খোঁজ পাইনি। বিদেশে বসবাসকারী প্রতিটি বাংলাদেশি পিতা হোন একজন আব্দুল মান্নান আর প্রতিটি সন্তান হোক একজন বিবি আমিনা – আল্লাহ্র কাছে আজ এটুকুই আমার ঐকান্তিক প্রার্থনা।
অধ্যাপক: টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
২৪ এপ্রিল ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/প্রতিনিধি/এইচএস/কেএস