তারেক হাসান (সিংগাপুর প্রবাসী): কি ভাবনা, ভাবায় আমাকে কীটপতঙ্গেরা কামড়ে খায় মস্তিষ্কের শিরা উপশিরা। অস্থির করে তুলে মৌনতা। ভাবনার দরজায় খটখট করে কড়া নাড়ে আর বলে প্রবাসীর সুখ কোথায়? আমি এক প্রবাসী শ্রমিক,,,, উত্তর খুঁজি প্রবাসের পথে প্রান্তরে,আকাশচুম্বী অট্টলিকার চূড়ায়, কখনো খুঁজি পাতাল রেলের দুর্বার গতিতে অতিক্রান্ত পথে। আবার কখনো খুঁজি আলোকিত শহরের চোখ ঝলসানো নানান রঙের আলোয়, রাস্তার পাশে বিলবোর্ড গুলো দেখে মনে হয় সুখ বুঝি লুকিয়ে আছে এখানেই, রাতের অন্ধকারে ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোয় খুঁজি সুখ পাখিটাকে। আসলে প্রবাসীর সুখ কোথায়,,,,
আমাদের সংসারে গার্জিয়ান যারা আছে, তারা একখানা পাসপোর্ট ও ভিসা হাতে দিয়ে টাকার মেশিন বানিয়ে পাঠিয়ে দেয় বিদেশে। এ মেশিনে শুধু টাকায় তৈরি হয় আর কিছুনা ভাবে তারা, নাকে তেল দিয়ে ঘুমায় নিশ্চিন্তে,,,,আর আমরাও ছুটে আসি খুব সহজে সুখ পাখিটাকে ধরবার জন্য এই প্রবাসে,,,,আসলে আমরা প্রবাসীরা কতটুকু সুখ পেয়েছি? চলুন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি,,,,,,,,
নাম তার রাহাত বাড়ি টাংগাইল জেলায়, সবে মাত্র কলেজে পা দিয়েছে। পড়াশুনায় ভালো, তিন ভাই বোনের মাঝে সে সবার বড়। বাবা আঃ মজিদ গ্রামের বাজারে ছোট একটা ব্যবসা করেন। কিছু আবাদি জমি থাকায় সংসারে কোন টানাপোড়ন পোহাতে হয়না। তার দোকানের এক খরিদদার আদম ব্যবসা করতো, প্রায় প্রতিদিন বলতো এই বয়সে আর কত খাটবেন। ছেলেটারে বিদেশ পাঠাইয়া দেন, কারণ এখন লেখাপড়ার দাম নাই। কতলোক বি.এ পাশ কইরা বসে আছে চাকুরী নাই। তার চেয়ে বিদেশ পাঠাইয়া দেন, মাসে হাজার হাজার টাকা কামাইব। আপনি খালি খরচ করবেন,আঃ মজিদ ভাবলো কথা ঠিক।
রাতে বাড়ি ফিরে পরিবারের সবাইকে বলে, রাহাত কে বিদেশে পাঠাবে সবাই সম্মতিও দেয়। কিন্তু আঃ মজিদ কোথায় পাবে এত টাকা? চলার সম্ভল ব্যবসার কিছু পুঁজি, তাতে না হয় দু’লক্ষ টাকা হবে আর টাকা কিভাবে জোগাড় করবে। প্রথমে রাহাত একটু দ্বিমত পোষণ করলেও পরে মায়ের কথায় রাজি হয়ে যায়। প্রতিদিন আদম ব্যবসায়ী আসে আঃ মজিদের বাড়িতে টাকা জোগাড় হল কিনা জানতে। রাহাতের বিদেশে যাওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে আঃ মজিদের দোকান বন্ধ। একদিন রাতে তার স্ত্রী শাহানাকে বলল, গহনা বিক্রি করে দিবে বলে, কিন্তু শাহানা খাতুন তাতে কোন আপত্তি করলো না, একদিকে সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অন্যদিকে স্বামীর সন্তুষ্টি, তাই গহনা গুলো বের করে এনে স্বামীর হাতে দিলেন। পরদিন সে গুলো বিক্রি করে দুই লক্ষ টাকার মত পেল, আরও বাকি দুই লক্ষ। কিভাবে সেই টাকা জোগাড় করবে আঃ মজিদ? একদিন বিকেলে বাজারে চায়ের দোকানে বসে ভাবছিলেন, এমন সময় সেই চায়ের দোকানে এসে হাজির হল গ্রামের অসাধু সুদী ব্যবসায়ী হাইতুল্লাহ। আরে মজিদ ভাই পোলাডারে নাকি বিদেশ পাঠাইতেছ? এবার তো মজিদ ভাই লাল হয়ে যাবে, মনে হচ্ছে কিছু চিন্তা করতেছ? পোলায় বিদেশ গেলে এমন দোকান কয়টা দিতে পারবা। চিন্তার কিছু নাই, তই এত টাকা কেমনে জোগাড় করলা? আদম বেপারী কে টাকা দেওয়া শেষ হয়েছে?-----না আরও দুই লক্ষ টাকা বাকী ভাবতাছি ঐ উত্তর পাড়ার জমিটা বিক্রি কইরা দিমু, কিন্তু খরিদ্দার পাইতেছিনা---- আরে ভাই জমি বিক্রি করবা কেন? আমি আছি না তোমার কত টাকা লাগবো? সন্ধ্যায় আমার বাড়ী আইসো কথা আছে, তুমি চিন্তা কইরো না আমার টাকার সুদ দিতে অইবো না। কিন্তু বিনা সুদে কেন টাকা দিবে হাইতুল্লাহ আঃ মজিদ কে?
এই কথাটা স্ত্রী শাহানা খাতুন কে জানালো এবং আর কোন পথ না পেয়ে টাকার জন্য
সন্ধ্যায় গেল হাইতুল্লার বাড়ীতে, খুব সমাদরের সহিত টাকা দিয়ে দিল হাইতুল্লাহ বেপারী। কি তার উদ্দেশ্য বলেনি সেদিন, পরদিন সম্পূর্ণ টাকা বুঝিয়ে দিল আদম বেপারী রফিকের কাছে। জানতে চাইলেন রাহাতের বাবা কবে যাচ্ছে ছেলে তার বিদেশ? আদম বেপারী সহজ উত্তর দিল আগামী দশ দিনের মধ্যে,,,, এই আশা নিয়েই চলে এলো রাহাতের বাবা। কিন্তু দশ দিনে ও হয়নি সব কিছু পেরিয়ে একমাস পর পারি জমালো প্রবাসে রাহাত, শুরু হলো রাহাতের প্রবাস জীবন। রাহাতের শুধু একটাই লক্ষ্য পরিবারের মুখে হাসি ফুটানো। পরেরদিন সকাল ৮টা থেকে কাজ, তাই আগেই প্রস্তুতি নিচ্ছে রাহাত। নতুন পরিবেশে তেমন কারো সাথে পরিচিত হতে পারেনি সময় স্বল্পতার কারণে। ভোর ৫টায় গাড়ী এসে নিয়ে গেল কর্মস্থলে। কি কাজ তা সে নিজেও জানেনা। পরে দেখতে পেল রডের কাজ, কাঁধে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে হয়। সে তো ভাষাও বুঝেনা কষ্ট হচ্ছিল অনেক। মাঝেমধ্যে কান্না আসছিল তার কিন্তু কিছুই করার নেই ভাগ্যের শিকলে হাত পা বাঁধা। এত কষ্টের পরেও কিছুই জানায়নি তার পরিবারকে। বোকার মত সয়ে যাচ্ছিল সব কষ্ট পরিবারে জন্য। এভাবে প্রায় ছয়মাস কেটে গেলে টাকাও পাঠিয়েছে দেশে, কিছুটা ঋণের টাকা কমিয়েছে। হাইতুল্লাহর টাকা কিছু দিয়েছে,কিন্তু ভিসার মেয়াদ প্রায় শেষের পথে কোম্পানির কাছ থেকে পেয়ে গেছে রেড সিগনাল বেশিদিন আর থাকা হবেনা প্রবাসের মাটিতে। এখন সকল দুশ্চিন্তা এসে পড়লো রাহাতের মাথায়। সবেমাত্র দাঁড়ানোর সময়,,, কিছুই করার নেই ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিল সব। একদিন চলে আসলো দেশের মাটিতে। এসেই বিয়ের পিঁড়িতে বসলো কনে হাইতুল্লাহর কন্যা আসমা। কিছুদিন দেশে থাকার পর শুন্যহাত বউয়ের কথা বাবা মায়ের কথা আর ভালো লাগেনা। রাহাত আবার বিদেশে পাড়ি জমাতে খুঁজতে লাগলো এজেন্ট। পেয়েও গেলো আবার শশুর মশাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পাড়ি জমালো অস্থির জীবন থেকে একটু সস্থির নিঃশ্বাস নিতে। কিন্তু পারেনি আর সে সস্থির জীবনে ফিরে যেতে। এখন সব সময় বউয়ের বায়না, সংসারের খরচ আর ঋণের টাকা তো আছেই। সময় মত সবার চাওয়া পূরণ না করতে পারলেই নানা দোষারোপ। বাবায় সব শশুর বাড়ি সব দিচ্ছে আর বউ ভাবে বাবা মাকে সব দিয়ে দিচ্ছে। নিজের ভবিষ্যৎ নাই,।এখন আর ঘুমাতে পারেনা আগের মত রাহাত। মুক্তি চায় নিজের জীবন থেকে, সুখ পাখিটির নাম ভুলে গেছে চিরদিনে জন্য রাহাত,,,,,,,,
০৪ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস