আবু এন এম ওয়াহিদ: পাঠকগণ নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আজকের শিরোনামটি আমার নিজের দেওয়া নয়। অন্য একজনের কাছ থেকে শোনা এবং ধারকরা। এ কথাটি ইতিমধ্যে আপনাদের হয়ত অনেকেরই জানা হয়ে গেছে। এমন সুন্দর উপদেশবাণী আমি প্র ম শুনেছি বেশ ক’বছর আগে ঢাকার কোনো এক বাংলা টিভি চ্যানেলের এক টক শো’তে। সেই টক শো’তে অতিথি ছিলেন অভিনেত্রী শম্পা রেজা।
প্রসঙ্গ মে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ওই টক শো’তে তিনি কথাটি যথপোযুক্তভাবেই পেড়েছিলেন। শম্পা বলেছিলেন, তিনি একবার ট্রেনে করে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথে কোনো এক অজপাড়া গাঁয়ের ছোট্ট স্টেশনে এসে ট্রেনটি থামল। জানালা দিয়ে তিনি এদিক-ওদিক দেখছিলেন। হঠাৎ তাঁর নজরে এলো, দেয়ালে একেবারে কাঁচা হাতে কেউ লিখে রেখেছে, ‘বড় হওয়া ভাল, ভাল হওয়া তার চেয়ে বড়’। দেয়ালের লিখনটি তাঁর কাছে খুব পছন্দ হয়েছিল। শোনামাত্র তাৎক্ষণিকভাবে আমার কাছেও খুব ভাল লেগেছিল। এমন সুন্দর কথা কার না ভাল লাগবে, বলুন তো? এর তাৎপর্য এবং গভীরতা হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মত! সেদিনকার অতিথির মুখে এই অমূল্য বাণীটি শুনে সাথে সাথে ভেবেছিলাম, এ নিয়ে একটা কিছু লিখব এবং আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব, কিন্তু নিত্যদিনের ব্যস্ততায় লেখা আর হয়ে ওঠেনি, এবং কয়েকদিনের মধ্যেই কথাটিও আমার মন থেকে হারিয়ে যায়।
বেশ কিছুদিন পর স্বাভাবিক এক সকালে ঘুম থেকে উঠে ঢাকার অনলাইন বাংলা কাগজে যখন চোখ বুলাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ ওই দিনকার টিভি টক শো এবং এই মূল্যবান কথাটি হুবহু আমার মনের আয়নায় আবার ভেসে উঠল। কেন এতদিন পর এ কথাটি সেদিন নতুন করে মনে পড়ল, তা ভেবে সময় নষ্ট না করেই, লিখতে বসলাম। লিখতে গিয়ে প্রমেই এক ধাক্কা খেলাম। বুঝলাম, এ কথাটির ওজন আমি যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি। এর গভীরতা অনুধাবন করে কিছু লিখতে গেলে যে পরিমাণ তথ্য-উপাত্ত, যুক্তির সাযুজ্য এবং জ্ঞান-বুদ্ধি দরকার, আমার মাঝে তার প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। এ দুর্বলতার কথা মেনে নিয়েই একদিকে ভাবতে লাগলাম এবং আরেক দিকে কী বোর্ডে আঙ্গুল চালাতে শুরু করলাম। লেখাটি দাঁড় করাতে আমার প্রায় সারাটা দিন লেগেছিল। তারপর মাজা ঘষা করেছি আরো কয়েকদিন ধরে। তবু জানি না কেমন হয়েছে। বিচারের মালিক আপনারা।
আলোচ্য বক্তব্যে স্পষ্টতই রয়েছি দু’টি অংশ। ‘বড় হওয়া’ এবং ‘ভাল হওয়া’। প্রমে দেখা যাক ‘বড়’ হওয়া মানে কী, এবং কারাই বা ‘বড়লোক’? । ‘বড়’ বলতে আমরা সাধারণত যা বুঝে থাকি তা হল, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া অর্থাৎ উচ্চতর ডিগ্রী হাসিল করা, বড় চাকরি পাওয়া, রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর খবরদারির দায়িত্ব পাওয়া, বড় ব্যবসা করা, ব্যবসায় সফল হওয়া, প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হওয়া। বড় বাড়িতে থাকা, দামি গাড়ি চড়া, শান-শওকতের মধ্যে জীবনযাপন করা, সমাজের ক্ষমতাবান এবং উঁচুতলার লোকজনদের সাথে চলাফেরা, উঠা বসা করা, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
আপাতদৃষ্টে সমাজে ‘বড়’ হয়ে যাঁরা প্রতিষ্ঠা পান, তাঁরা আবার দু’ধরণের। এক ধরণের ‘বড়লোক’ যাঁরা ‘বড়’ হতে গিয়ে অসৎ কিংবা অনৈতিক পথের ধারে কাছে যান না। সৎপথে থেকে বড় হওয়ার চেষ্টা করেন এবং সফলও হন। তাঁরা তাঁদের বড়লোকি যেখানে সেখানে জাহির করতে চান না এবং করেনও না। মানুষজনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য জ্ঞান করেন না, অহঙ্কার করেন না। সমাজের দুর্বল এবং গরিব মানুষদের প্রতি তাঁদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে সব সময় আন্তরিক থাকেন, সচেষ্ট থাকেন। ধর্ম-কর্মও পালন করেন। এ ধরণের বড়লোকদের বেলা কেউ বলতেই পারেন, ‘বড় হওয়া ভাল’, কিন্তু এরকম ‘বড়লোক’ সমাজে কয়জনই বা পাওয়া যায়! থাকলেও হাতে গোনা এবং তাঁরা সহজে ধরাও দেন না। এই লুকিয়ে থাকা লোকগুলো আমাদের গর্ব, সমাজের অমূল্য সম্পদ! তাঁরা এতই প্রচারবিমুখ, যে তাঁদের সহজে সনাক্তই করা যায় না। এমন লাজুক ও মহৎ ব্যক্তিদের মূল্যায়নই বা করবেন কীভাবে?
এবার আসা যাক নকল ‘বড়লোক’দের কথায়। এরা আজকাল সংখ্যায় অনেক। চোখ মেললেই আশে পাশে তাদের চলতে ফিরতে দেখা যায়। তারা ধান্ধাবাজ, ধুরন্ধর, চালাক, অতি চালাক!
আইনের ফাঁক-ফুকর গলিয়ে, ক্ষমতা বলয়ের কাছাকাছি থেকে, ক্ষমতধরদের সাহায্যে নীতি- নৈতিকতার মাথা খেয়ে, চাতুর্যের সাথে তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করতে ওস্তাদ। তারা সব কাজ এত সাবধানতার সাথে, সুকৌশলে এত নিপুণভাবে সমাধা করে যে তাদের কোনভাবেই ধরাছোঁয়া যায় না! তারা দূর্নীতিবাজ, চতুর এবং সাহসীও বটে। আর এইসব বদগুণের কারণেই তারা ‘বড়’ হতে পারে, তর তর করে বিশাল ‘বড়’ হয়ে উঠতে পারে। তাদের বিদ্যাশিক্ষা থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে, তবে তাদের অর্থবিত্তের কোনো কমতি থাকে না, থাকে ক্ষমতার দম্ভ। এদের বেলায় যে কথাটি ষোল আনা সত্য, তা হল, 'Behind every opportunity, there is a crime!' এমন বড়লোকদের কি কেউ ‘ভাল’ বলতে পারেন? আলবৎ না! তাহলে দেখা যায়, ‘বড় হওয়া ভাল’ এ কথার সঠিক মূল্যায়ন করার আগে জানতে হবে, কে কীভাবে ‘বড়’ হয়েছেন, এবং বড়লোকি জাহির করেন কিনা, করলে কিভাবে? তাই সহজেই আমরা উপসংহার টানতে পারি যে, ‘বড় হওয়া ভাল’ কথাটি কারো কারো জন্য প্রযোজ্য হলেও, এটা সার্বজনীনভাবে সঠিক নয়!
এবার দেখে নেই ‘ভাল হওয়া’ মানেটা কী, এবং কারা ভাল হতে পারেন, এবং কারা ভাল হন। এ প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত মত, ‘ভাল’ হতে গেলে ‘বড়’ হতে হয় না। যে, যে পেশাতেই থাকুন না কেন, চাইলেই তিনি সফল হতে পারেন, সার্থক হতে পানের, ‘ভাল’ হতে পারেন। ‘ভাল’ হতে হলে কাউকে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, উকিল-মোক্তার, জজ-ব্যারিষ্টার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, টাকার কুমির, দানশীল, সুশীল, সমাজসেবক, উচ্চশিক্ষিত, অধ্যাপক, ইমাম, মোয়াজ্জিন, এমন কী নোবেললরেটও হতে হয় না। ‘ভাল’ হওয়ার পূর্বশর্ত হল যে, যে কাজই করুন না কেন, তাঁর কাজটি তিনি সর্বদা আন্তরিকভাবে সম্পাদন করবেন, করবেন একান্তই যোগ্যতার সাথে, দক্ষতার সাথে, দায়িত্বশীলতার সাথে। কাজ করবেন দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে। কাজে ভুল হলে উদর পিন্ডি ভুধর ঘাড়ে চাপাবেন না বা চাপাবার চেষ্টাও করবেন না। ষোল আনা দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করবেন এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরণের বা অন্য কোনো রকমের ভুল না হয় তার জন্য সর্বাত্মক কোশেশ করে নিজের কাজ যতেড়বর সাথে করে যাবেন। সত্যিকারের ‘ভাল’ যিনি তিনি কারো প্রতি
বেইনসাফ করবেন না, আবার কেউ তাঁর প্রতি বেইনসাফ করলেও সেটা সহ্য করবেন না, তিনি যে ব্যক্তিই হোন না কেন। তিনি কখনো কাজে ফাঁকি দেবেন না, কিংবা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। জনগণ এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের সেবাই হবে তাঁর কাজের মূল উদ্দেশ্য, অন্য কিছু নয়। আর যিনি মানুষের সেবা করেন, সৃষ্টির সেবা করেন, বিশ্বাস যদি থাকে তবে তিনিই তো হতে পারেন আল্লাহর অনুগত বান্দা ও প্রিয়পাত্র।
তাহলে দেখা যায়, জনসেবার মনোবৃত্তি নিয়ে, ন্যায়-নীতি, আইন-কানুন মেনে সঠিকভাবে আপন দায়িত্ব পালন না করলে একজন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, নোবেললরেট, কোটিপতি, কিংবা সুশীল সমাজের সমাজপতি যেমন ‘খারাপ’ হতে পরেন, তেমনি আবার উল্টো বিবেচনায়, একজন কেরানী, চাপরাশি, কিংবা একজন মেথরানি সততা, আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার পরীক্ষায় পাস করে অনায়াসেই হতে পারেন ‘ভাল’, অনেক ‘ভাল’ একজন মানুষ! আর যে মানুষটি ‘ভাল’, তিনি যত গরিব হউন না কেন, তিনি যত ছোট কাজই করুন না কেন, তাঁকে আমি ‘ছোট’ বলি কী করে!
তিনি তো ‘বড়’, অনেক ‘বড়’, অনেক মহৎ, আমার কাছে তাঁর স্থান অনেক উঁচুতে, তিনি অনুসরণীয়, অনুকরণীয়! অন্যভাবে বলতে গেলে, প্রকৃত অর্থে যিনি ‘ভাল’, তিনি ‘বড়’, আর কেউ যদি ‘বড়’ হতে চান, তাহলে তাঁকে আগে ‘ভাল’ হতেই হবে, অন্য কোনো পথে ‘বড়’ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। মেকি বড়লোক প্রসঙ্গে সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খানের কথাটা অন্যভাবে বললে দাঁড়ায়:
যারা বলে বড়লোক, তারা বড় নয়
তাদের শুধু বড়র মত দেখতে মনে হয়।
(বানানে আমার দুর্বলতা এখনো রয়ে গেছে। ভুল বানান অথবা অন্য কোনো অসঙ্গতি চোখে পড়লে অনুগ্রহ করে
জানাবেন, উপকৃত হব ও কৃতজ্ঞ থাকব।)
লেখক: অর্থনীতির অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ
৩ জুন, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এইচএস/কেএস