মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বাবু: বয়স আমার চল্লিশের কোঠা পার হয়েছে বছর দুয়েক আগে। এখনো আমি আমার বাবার খোকা। বুড়ো খোকা। ফোন করলেই সেই একই ডাক আব্বুরে কেমন আছ বাবা ।যেন চলন্ত বাস থেকে আমায় ডাকছে মেঘনা ব্রীজের উপর থেকে। তখন আমি নতুন চাকরিতে। বাবু ডাক কত জোরে দিয়েছিলো কল্পনা করা যায়। মেঘনা সিমেন্ট ফ্যাক্টরী কাজ করতাম তখন। ডাক শুনে পিছন ফিরে দেখি বাস চলে গেছে বীর্যের মধ্যখানে। হাত দেখা যাচ্ছে বাবার।
যে দিন বাবা ফোনে আব্বু বলে না ,অল্প কথা বলে বুঝতে পারি আমার বাবার মন ভালো নেই। রেলওয়ের অবসর প্রাপ্ত উপসহকারী প্রকৌশলী আব্দুল হক আমার বাবা। আমিই তার বড় সন্তান। আজ বাবা সত্তর পেরিয়েছে। ডায়াবেটিক করেছে কাবু। দিনে কয়েবার ইন্সুলিন নেয়। চোখে লাগিয়েছে লেন্স। সত্তর পেরিয়েছে বয়স.একে একে চলে যাচ্ছে বাবার ভাই বন্ধু সব পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। যারা আমার ছাত্র জীবনে আমার বাবার সাথে মিশেছে তাদের কাছেও একজন আদর্শ পিতা ,একজন ভালো বন্ধু ছিলেন বাবা। আজ স্মৃতি শক্তি ধৈর্য্য,সপ্ন দেখানোর ,উপরে উঠার সিঁড়ি দেখাবার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। আমাকে ডাকার স্টাইল রয়ে গেছে আগের মতোই যেমন ডাকতেন শিশু বেলায়। ভিশন অভিমানী এখন,পান থেকে চুন খসলেই পুরানো সৃতির খাতা খুলে বসেন। রাগ করেন ,অভিন করেন,আব্বা বলে একবার ডাকলেই ভুলে যান সব.বাবার বুড়ো খোকা ,বড় খোকা আজ বাবর উত্তরসুরী হয়ে বৃদ্ধের খাতায় নাম লেখবার সময় হয়ে এসেছে।
প্রবাস থেকে বাবার এলোমেলো স্মৃতি বুকের পাঁজর কাঁপিয়ে চোখ থেকে ঝরাচ্ছে নোনা পানি। বাবার কথা মনে পড়ছে বারবার। জীবনের প্রথম যে হাতের স্পর্শে, আমার প্রথম হেঁটে চলা, সে আমার বাবা। কলেজ জীবনে, হোস্টেল জীবনে নাটক কবিতা নিয়ে যখন মহিলা সমিতি, গাইড হাউস, পাবলিক লাইব্রেরিসহ নানা জায়গায় ঘুরতাম ভব ঘুরের মতো, বাবা হোস্টেলের সামনে এক নজর দেখার জন্য অপেক্ষা করতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
একবার শ্রীপুর থেকে ঢাকা আসার পথে তেজগাঁও রেল ক্রসিং পার হওয়ার সময় ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে মারায় মাথা ফেটে গিয়েছিল। রক্তাক্ত অবস্থায় স্টেশনের টিটি আমায় দেখছিল। সম্ভবত তারা বাবাকে ফোন করেছিলেন। শুনে গাড়ি থামিয়ে কী করে অল্প সময়ে ছুটে এসেছিলেন হোস্টেলে শ্রীপুর থেকে ঢাকা। ছোটবেলায় কঠিন অসুখে কাঁধে নিয়ে ডাক্তারদের কাছে ফিরেছেন, নার্সদের অবহেলায় মারতে গিয়েছিলেন ময়মনসিংহ চরপাড়া হাসপাতালে।
সরকারি চাকরির সামান্য আয়, ব্যয় সামাল দিতে ঘড়ি মেরামত করতেন। ঘডির ছোট ছোট নাট বল্টু স্প্রিং হুইল হারিয়ে গেলে সারা ঘর ঝাড়ু দিয়ে বালি একত্র করে কাগজের উপর রেখে শত পাওয়ারের বিদ্যুতের বাতির কাছে নিয়ে ফু দিয়ে খুঁজে বের করতেন। একটা ঘড়ি ওয়াইলিং করলে পাঁচ দশ টাকা পেতেন, তা দিয়ে ময়মনসিংহ থাকার সময় বসাকের দোকানের চিনি দেয়া খাঁটি মিষ্টি দুধ, আড়িখোলা, কালীগঞ্জ থাকতে পুরি, নান রুটি, নানা রকমের খাবার খাওয়াতেন।
একবার নাকি লিচু খেতে চেয়েছিলাম, বাবা ফিরতে রাত হয়ে যায়। এসে দেখেন আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুমের মধ্যেই লিচু খাইয়েছিলেন। ও কথা বাবার মুখেই শুনেছি। বাবাকে বেশির ভাগ আব্বা বলেই ডাকি। কত বলবো বাবার আদরের কথা। খাতা ফুরাবে লেখা ফুরাবে না, বাবার আদর যত্ন কথা ফুরাবে না। শিশুবেলায় কাঁধে করে নিয়ে যেতেন ময়মন সিংহ সিগন্যাল অফিসে। মা বাড়ি গেলেও আমাকে রেখে দিতেন তার কাছে।
১৯৯৫ সালে আমার নতুন চাকরিতে মেঘনা, সোনারগাঁ আমাকে রান্না করে খাইয়ে এসেছিলেন। বিদেশ আসার আগে দেশের চাকরি ছেড়ে এসেছিলাম রাজশাহী থেকে। তখন আব্বার কাছে কমলাপুর মেসেই থাকতাম। ছিয়ানব্বই সালের শেষের দিকে ড্রাইভিং শিখতাম কমলাপুর, বাবা থাকতেন মেসে স্টেশনের শেষ প্রান্তে। প্রতিদিন চক চকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট পকেটে দিতেন। বলতেন টাকা ছাড়া মানুষ বড় অসহায় ভোগে। আমি আছি, একদম চিন্তা করবি না। কখনও নিজের উচ্চতা নিয়ে আফসোস করলে স্টেশনে শুয়ে থাকা লম্বা মানুষদের দেখিয়ে বলতেন, শোকর করো আল্লাহর দরবারে, তুমি সুস্থ। ঢাকা চট্রগ্রাম রাজশাহী থেকে গাড়ি এলে যাত্রীদের ভিড় থেকে তার চোখ খুঁজে বের করতো লম্বা সুন্দরী মেয়েদের। বলতেন, যদি আমাকে সুযোগ দাও আমি এক পরী উপহার দেবো এর চেয়ে সুন্দর। আমি কথা রেখেছি, বাবাও রেখেছেন। আমাকে শুধু পরী নয় এক লক্ষী বউ দিয়েছেন। আজ .....
১৯ জুন ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এইচএস/কেএস