এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : মাত্র দুই টাকায় মিলছে গরু কিংবা খাসির মাংস দিয়ে ভাত। কেউ গরু না খেলে তার জন্য রয়েছে মুরগির মাংস। আছে মসুরের ডালের সঙ্গে ইলিশ মাছের ব্যবস্থাও। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও রাজবাড়ীর একদল তরুণ স্বেচ্ছাসেবী `দুই টাকার হোটেল' খুলে এভাবেই পেটপুরে খাওয়াচ্ছেন দরিদ্র মানুষদের। কাছে দুই টাকা না থাকলেও এ হোটেলে পেটপুরে খেতে পারেন সমাজের অসহায়, দরিদ্র, ভাসমান, ছিন্নমূল ও দিনমজুরসহ নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষেরা।
সপ্তাহে দুইদিন রাজবাড়ী রেলওয়ে স্টেশনের পাশে ফুলতলায় বসে দুই টাকার এ হোটেল। ডেকোরেটর থেকে আনা চেয়ার-টেবিলে ওয়ান টাইম প্লেট ও গ্লাসে মেজবানি আয়োজনে খাওয়ানো হয় এ হোটেলে। বাড়িতে রান্না করা সাদা ভাত ও ভুনা খিচুড়ির সঙ্গে থাকে খাসি, গরু ও মুরগির মাংস। আরও থাকে ইলিশ, মুড়িঘণ্ট ও ডাল। খাওয়া শেষে কোনো কোনোদিন থাকে মিষ্টি ও পান-সুপারির ব্যবস্থা।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে মাছ-মাংস খাওয়া অসহায় শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। এদের কথা চিন্তা করেই রাজবাড়ীতে দুই টাকার হোটেলটি গড়ে তুলেছেন মাহিন শিকদার, মনিরুল হক আকাশ, রাব্বি শেখসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী। সপ্তাহে অন্তত দুইটি দিন ভালো-মন্দ খেতে পেরে খুশি এ হোটেলে খেতে আসা হতদরিদ্ররা। বিশেষ এই হোটেলে ৬০ থেকে ৭০ জন শ্রমজীবী খেতে পারছেন।
সরজমিনে দেখা যায়, একদল তরুণ-যুবক রাজবাড়ী রেলস্টেশন সংলগ্ন ফুলতলায় রাস্তার একপাশে চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে রেখেছেন। টেবিলে রয়েছে পানির জার, ওয়ান টাইম প্লেট ও গ্লাস। পাশেই একটি ভ্যানের ওপর বড় বড় গামলা ও পাতিলে রাখা রয়েছে বাড়ি থেকে রান্না করে আনা চিকন চালের ভাত, খাসি, গরু মুরগির মাংস ও ডাল। রাস্তার পাশে রিকশা রেখে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসেছেন শ্রমজীবীরা। টেবিলগুলো মানুষে পূর্ণ হলেই পরিবেশন করা হচ্ছে খাবার।
এখানে খেতে আসা রিকশাচালক আমিন মিয়া বলেন, ‘দুই টাকার হোটেলে গরুর মাংস ও ডাল দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়েছি। শুধু আমি না, আমার মতো ৬০ থেকে ৭০ জন খেয়েছেন। বর্তমানে গরুর মাংসের যে দাম, আমরা বছরে দুই একবারও খেতে পারি না। কিন্তু আজ তৃপ্তি সহকারে খেয়েছি। আমার খুব ভালো লেগেছে। দোয়া করি ওনারা যেন এভাবে আমাদের পাশে থাকেন।’
আরেক রিকশাচালক শহিদ শেখ বলেন, ‘দুই টাকায় ভালো একটা চকলেটও হয় না। আজ দুই টাকায় গরুর মাংস, ডাল দিয়ে ভাত খেয়েছি। খাবারও অনেক সুস্বাদু হয়েছে। এর আগে এখানে ভুনা ইলিশ-খিচুড়ি, খাসির মাংস, মিষ্টি খেয়েছি।’
দিনমজুর শাহজাহান মোল্লা বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। কাজের সন্ধানে রাজশাহী থেকে রাজবাড়ীতে এসেছি। সারাদিন কোনো কাজ না পেয়ে স্টেশনে বসে ছিলাম। তখন শুনতে পাই স্টেশনের পাশে দুই টাকায় দুপুরে মাছ-মাংস-ভাত পাওয়া যায়। পরে এখানে এসে গরুর মাংস দিয়ে পেট ভরে ভাত খেয়েছি।’
উদ্যোক্তাদের একজন শিক্ষার্থী মাহিন শিকদার। তিনি সময় সংবাদকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে অনেক মানুষ আছে, যারা ভালো-মন্দ খাওয়া তো দূরের কথা; অনেক সময় না খেয়ে তাদের দিন কাটে। ওইসব মানুষগুলোর কথা চিন্তা করে, তাদের ভালোবেসে আমাদের এই উদ্যোগ।’
শুরুর দিকের গল্প শুনিয়ে মাহিন শিকদার বলেন, ‘হোটেল শুরু করতে আমরা রান্না করা নিয়ে চ্যালেঞ্জে পড়ি। এসময় সাগর ভাইয়ের আম্মু আমাদের দুই টাকার হোটেলের কথা শুনে সবকিছু রান্না করে দিতে রাজি হন। এরপর থেকে আমরা বাজার করে এনে দিলে আন্টি নিজ হাতে সব খাবার রান্না করে দেন।’
মনিরুল হক সাগর নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের হোটেলের নাম ‘দুই টাকার হোটেল’ দেওয়ার কারণ আমাদের রাজবাড়ী শহরে দুই টাকার নোট কোনো ব্যবসায়ী বা কেউ নিতে চায় না। এজন্য চিন্তা করে আমরা হোটেলের নাম দিয়েছি ‘দুই টাকার হোটেল’। যাতে করে দুই টাকা দিয়ে শ্রমজীবীরা আমাদের হোটেলে এসে একবেলা ভালো খেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে নিম্নমানের কোনো খাবার দেওয়া হয় না, সম্পূর্ণ বাসায় রান্না করা এবং আমরা যা খাই সেটা এখানে দেওয়া হয়। সপ্তাহে দুদিন আমরা হোটেলের কার্যক্রম চালাই এবং আমরা নিজেরাই মেহমানদারিত্ব করি।’
আরেক উদ্যোক্তা রাব্বি শেখ বলেন, ‘নামমাত্র দুই টাকার হোটেল। মূলত অসহায় ও শ্রমজীবী মানুষদের সম্মান জানাতে দুই টাকার হোটেল নামকরণ করা হয়েছে। অনেকের কাছ থেকে আমরা টাকাই নিই না। আমাদের ইচ্ছা আছে এই কার্যক্রম দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়ার।’