এমটি নিউজ ডেস্ক : ভালোবাসা মানে না কোন দেওয়াল, ভালোবাসা মানে না অর্থের মাপকাঠি, ভালোবাসা যুগে যুগে তৈরি করেছে ইতিহাস। কেউ হয়েছে দেউলিয়া কেউ আবার হারিয়েছে জীবন। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধী নারীর প্রেমে এক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া প্রেমিকের প্রেম বিরল ভালোবাসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। ময়মনসিংহে সোহেল মিয়া ও রওশন আক্তারের ভালোবেসে বিয়ে হয়। এরপর স্ত্রীকে পিঠে নিয়ে চলছে ১৫ বছরের সংসার।
১৫ বছর আগে ১০ টাকার নোটে লেখা নাম্বারে মোবাইল ফোনে পরিচয়। প্রতিদিনের কথোপকথনে ঘটে প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক। এরপর বিয়ে। পরিবার মেনে না নেওয়ায় তাদের অমতে পালিয়ে দুই পা বিকলাঙ্গ রওশন আরাকে বিয়ে করেন রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সোহেল মিয়া।
মেয়েটি প্রাথমিক পর্যায়েই তার প্রেমিককে জানিয়েছিলেন, তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী। কিন্তু ভালোবাসার বাঁধনে জড়িয়ে পড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করা রাজশাহীর গোদাগাড়ীর সোহেল মিয়া ২০০৭ সালে পরিবারের অমতে বিয়ে করেন জন্মসূত্রেই দুই পা বিকলাঙ্গ ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার আমিরাবাড়ী ইউনিয়নের গুজিয়াম টানপাড়া গ্রামের রওশন আরাকে।
সেই থেকে পিঠে চড়িয়ে সংসারের কাজ, এখানে সেখানে যাওয়া, ঘুরে বেড়ানো আর স্ত্রীর সব দায়িত্ব পালন করে চলেছেন ১৪ বছর ধরে। এ যেন ভালোবাসার এক অনন্য নিদর্শন সোহেল-রওশন দম্পতির মধ্যে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সোহেল মিয়া আট ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরি নেন সোহেল। ১০ টাকার নোটে পাওয়া ফোন নাম্বারে কল করে পরিচয় হয় ত্রিশালের আমিরাবাড়ী ইউনিয়নের গুজিয়াম টানপাড়া গ্রামের রওশন আরার সঙ্গে। প্রতিদিনই কথা হতো দুজনের মধ্যে।
এক সময় সোহেল রওশনকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। জন্মসূত্রেই দুই পা বিকলাঙ্গ রওশন তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কথা সোহেলকে জানিয়ে অপারগতা প্রকাশ করেন। কিন্তু ততক্ষণে ভালোবাসার মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে, তার প্রেমে প্রায় অন্ধ ছিল সোহেল।
২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে প্রেমের সম্পর্ক শুরু। শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে প্রেমিক যুগল ওই বছরের ডিসেম্বরে বসেন বিয়ের পিঁড়িতে। ভালোবাসার টানেই সোহেল তার পরিবারের অমতে প্রতিবন্ধী রওশনকে বিয়ে করেন।
পরিবারের সদস্যদের আপত্তির কারণে স্ত্রীকে নিয়ে নিজ বাড়িতে উঠতে পারেননি সোহেল। অকৃত্রিম ভালোবাসার রওশনকে সবসময় পাশে পেতে আর দেখাশোনার জন্য ঢাকা থেকে ইউনিফুডের চাকরি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি এলাকায় বেছে নেন ব্যবসা। যদিও ১০টা মেয়ের মতো সুস্থ স্বাভাবিক নয় রওশন, তবুও কখনো ছেড়ে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতির পর সোহেল স্ত্রীকে নিয়ে পার করেছেন জীবনের ১৪টি বছর।
বাস্তবতায়- ভালোবাসা যেখানে অভাব অনটন দেখে, সেখান থেকে দৌড়ে পালায়, সেখানে অভাবকে বরণ করে ভালোবাসার এক অনন্য নিদর্শন গড়ে তুলেছেন ওই দম্পতি। আমিরাবাড়ী ইউনিয়নের গুজিয়াম টানপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা মিলে ওই দম্পতির। ছোট্ট একটি মাটির ঘর আর একটি টং দোকানই তাদের একমাত্র সম্বল। শত কষ্টের মাঝেও ভালোবাসা আর পরস্পরের আস্থা-বিশ্বাসই যেন তাদের সুখের রাজ্য।
স্থানীয়রা জানান, জন্ম থেকেই দু-পা অচল রওশন স্বামীর পিঠে চড়ে চলাচল করেন এখানে, সেখানে। হয়েছেন এক কন্যা সন্তানের মা। কঠিন এ জীবন সংগ্রামে মসৃণ পথচলার মূলে ছিল প্রেম, ভালোবাসা, ভরসা আর বিশ্বাস।
প্রেমিক সোহেল বলেন, আমাদের ভালোবাসাটাই ছিল অন্যরকম। অচল-অক্ষম একটা মেয়েকে অন্ধের মতো ভালোবেসেছি, সেও ছিল আমার প্রেমে অন্ধ। ছিল পবিত্র প্রেম, তাই শারীরিকভাবে চলাচলে অক্ষম থাকলেও স্বাভাবিকভাবে একটি মেয়ে তার স্বামীর জন্য যতটুকু করে, রওশন তার চেয়েও বেশি কিছু করার চেষ্টা করে আমার জন্য। আমি তার ভালোবাসা আর গুণে মুগ্ধ।
রওশন বলেন, প্রতিবন্ধী বলে আমার ও তার পরিবারের সম্মতি ছিল না বিয়েতে। আমরা পালিয়ে বিয়ে করি। প্রথমদিকে সবাই বলাবলি করত সে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে; কিন্তু আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, সোহেল আমাকে ছেড়ে কখনো যাবে না। আমাদের সুখের সংসারে এক মেয়েসন্তান জন্মগ্রহণ করেছে।
সোহেল-রওশনের ভালোবাসার অনন্য নিদর্শন ও বন্ধন দেখে রীতিমতো অবাক স্বজন ও প্রতিবেশীরাও। তারা বলেন, আমরা প্রথম অবস্থায় সোহেলকে বিশ্বাস করতে পারিনি। ভেবেছিলাম প্রতিবন্ধী মেয়েকে বিয়ে করে হয়তো কিছুদিন পর তাকে ছেড়ে চলে যাবে সোহেল। কিন্তু তাদের প্রেমে যে এতটা গভীরতা তা আমরা বুঝতে পারিনি। সত্যিকারের প্রেম যে কারে কয়, তা তাদের দেখলেই বুঝা যায়। ভালোবাসা মানে একজনের কাছে আরেকজনের দায়বদ্ধতা। সুখে দুঃখে সব সময় পাশে থাকার দৃষ্টান্ত তাদের ১৪ বছরের দাম্পত্য জীবন।