নিউজ ডেস্ক: গায়ে তার চকচকে শার্ট, গলায় টাই, পায়ে সু, চোখে চশমা, কানে ইয়ারফোন। তবে তিনি কোন কর্পোরেট অফিসার নয়, রাজধানীর শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বসা একজন ঝালমুড়ি বিক্রেতা। এই পথের নিয়মিত যাত্রিদের পরিচিত মুখ জুলহাস হাওলাদার।
এখানে ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন পাচ বছর ধরে। ঝালমুড়ির স্বাদ নয় পরিপাটি পোশাকের জন্যই তার জনপ্রিয়তা। তবে প্রশ্ন হলো কে এই টাই পড়া জুলহাস, কেন তিনি এই বেশে ঝাল মুড়ি বিক্রি করছেন? খোঁজ নিলে মেলে কিছু তথ্য।
সবসময় পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করেন জুলহাস। এটাই তার বিশেষত্ব। ফুটপাথে মুড়ি বিক্রি করলেও পাশেই রাখেন ময়লার ঝুড়ি। সাথে রাখেন সাবান, পানি ও টিস্যু। জুলহাস জানান, ব্যবসা নয় মানুষের ভালোবাসা পাওয়াই তার মূল লক্ষ্য। তাই সবসময় নিজেকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে ব্যস্ত থাকেন। প্রতি মাসে তিন-চারবার পোশাকের ধরণ পরিবর্তন করেন উল্লেখ করে বলেন, ১৫ দিন পর তাকে বর্তমান স্টাইলে আর পাওয়া যাবে না ।
সব সময় কানে ইয়ারফোন থাকে জুলহাসের। কোন ধরনের গান শুনতে পছন্দ করে জানতে চাইলে বলেন, বিরহের গানই বেশী শোনা হয়। তবে হিন্দি গানও শোনেন তিনি। তবে গানের চেয়েও বেশি শোনেন বঙ্গবন্ধুর ভাষন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষন শুনলে মনটা ভালো লাগে। তাই মন খারাপ থাকলে ভাষন শোনেন। বঙ্গবন্ধুকে কতটা ভালোবাসেন তা তার দোকানের সামনে গেলেই বোঝা যায়। মুড়ির বস্তার সামনে সব সময় লাগানো থাকে বঙ্গবন্ধুর ছবি। ছবিতে টানানো থাকে তাজা ফুলের মালা।
জুলহাসের মতে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। সব ক্ষেত্রেই চোখে পড়ার মত উন্নতি হচ্ছে। এমন অবস্থায় তিনি কেন পিছিয়ে থাকবেন। তার স্লোগান ‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, জুলহাস কেন পিছিয়ে থাকবে?’ তাই তিনি নিজেকে পরিপাটিভাবে উপস্থাপন করেন। নিজেকে উন্নত বালাদেশের একজন মডেল মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, কোন কাজই ছোট না। তাই যে কাজই হোক না কেন প্রত্যেকের উচিৎ নিজেকে সুন্দরভাবে উপাস্থাপন কারা।
নিজের প্রতি মানুষের আগ্রহের বিষয়টাকে উপভোগ করেন জুলহাস। আগ্রহের সাথে বলেন, বিভিন্ন চ্যানেল, সংবাদপত্রের লোকজন আসে তার সাথে কথা বলতে। তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক পত্রিকায়। একবার নাকি মুড়ি খেতে এসেছিলেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। খুশি হয়ে দিয়ে গেছেন ১০০০ টাকা।
শরীয়তপুর জেলার ডামুড্যা উপজেলার ধানকাটি ইউনিয়নে জুলহাসের পৈতৃক নিবাস। জীবিকার তাগিদে এসেছেন ঢাকায়। পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি শপিং মলের পেছনে ছোট একটি বাসা ভাড়া করে থাকেন জুলহাস। নয় বছরের প্রতিবন্দী ছেলে সোলায়মান, সাত বছরের মেয়ে জিতনি ও স্ত্রীকে নিয়ে তার পরিবার। পাচ জনের পরিবারের অন্য জোগাতে প্রতিদিনই কাজে বের হতে হয় তাকে।
প্রতিদিন ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা বিক্রি করেন তিনি। সামান্য আয় দিয়েই চালাতে হয় সংসার। জুলহাস বলেন, ‘সংসারের খরচতো কম না। তার উপর প্রতিদিন শার্ট-প্যান্ট স্ত্রি করতে হয়। দামি জুতা, দামি পোশাক, মেয়ের লেখা-পড়ার খরচ। তাই অসুস্থ্য থাকলেও মুড়ি নিয়ে বেড় হতে হয়। কাজ না করলে এসব চলবে কিভাবে?’
নিজেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন জুলহাস হাওলাদার। ১৯৭১ সালে ২০ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন জুলহাসের বাবা তছলিম হাওলাদার। জুলহাস বলেন, ‘আমাদের গ্রামে আমার বাবাই একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের সময় ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, দেশ স্বাধীন করেছেন। এমন বাবার সন্তান হওয়া সকলের জন্যই ভাগ্যের ব্যাপার।’ তাই বাবার মুক্তিযুদ্ধের সনদপত্র সব সময় লাগিয়ে রাখেন মুড়ির বস্তার সাথে।
মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে নিয়মিত ভাতা পায় জুলহাসের মা। পেয়েছেন জমিও। তাই নিজের জন্য আর কিছূ চাওয়ার নাই তার। জুলহাসের একটাই চাওয়া সরকার সব মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য যেন কোন না কোন কাজের ব্যবস্থা করে। তিনি বলেন, ৭১ সালে বেশিরভাগ গরীব মানুষই দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। তাদের ত্যাগের ফলেই আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ।
২০ জানুয়ারি ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/এইচআর