বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১, ১০:১৬:৪৩

শিক্ষককে বাড়ি উপহার দিলেন প্রাক্তন ছাত্ররা

শিক্ষককে বাড়ি উপহার দিলেন প্রাক্তন ছাত্ররা

একেবারে ছোটবেলা লেখাপড়ায় হাতেখড়ি মায়ের কাছে। এরপরই শিক্ষকের কাছে। ওরা আমাকে বাড়ি বানিয়ে দিছে, আমি খুব খুশি। ওরা খুব ভালো। তোমরা যে যেখানেই থাকো, তোমাদের আল্লাহ ভালো রাখুক।’ অসুস্থ শিক্ষক মাওলানা শাহ আলম শিক্ষার্থীদের দেওয়া বাড়ি উপহার পেয়ে এভাবেই দোয়া করছিলেন। এসময় তার চোখে আনন্দাশ্রু দেখা যায়।

কথায় আছে, ‘সন্তান আপনার, মানুষ গড়ার দায়িত্ব আমাদের’। এই মূল্যবান প্রবাদটি শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই বলা হয়। ছোট থেকে বড় করার দায়িত্ব পরিবার কিংবা মা-বাবারই থাকে। কিন্তু সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সামাজিকীকরণ করতে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। তাই, একজন শিক্ষক অবসর নেওয়ার পরেও ছাত্ররা ভুলে যায়নি শিক্ষকের ভালোবাসা ও বদান্যতার কথা।

২০১২ সালে অবসর গ্রহণের পর স্যার চলে যান নিজ বাড়িতে। বেশ কয়েকবার কঠিন রোগের আক্রান্ত হন। আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার সুযোগ হয়নি।

উত্তর চট্টগ্রামের হাটহাজারি উপজেলার গড়দুয়ারা গ্রামে ড. শহিদুল্লাহ একাডেমি নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৯৭৯ সালে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন মাওলানা শাহ আলম। শিক্ষকতা জীবনে অত্যন্ত নির্লোভ, নিরহংকার, সহজ-সরল প্রকৃতির একজন মানুষ ছিলেন। তাঁকে সবাই ‘হুজুর স্যার’ বলে সম্বোধন করতেন। নিজ বাড়ি চট্টগ্রামের বাঁশখালির শিলকূপে। বিদ্যালয় থেকে বাড়ি দূরে হওয়ায় শিক্ষার্থীদের বাড়িতে লজিং থাকতেন।

তিনি সম্মানি বা বেতন হিসেবে যা পেতেন, তা দিয়েই সংসার চালাতেন। মা-বাবা, ভাই-বোন, সন্তান নিয়ে থাকতেন যৌথ পরিবারে। পুরো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। ১৯৬০ সালে তার বাবা নিজ বাড়িতে একটি মাটির ঘর তৈরি করেন। পরিবারের সবাই মিলে সে মাটির ঘরেই থাকতেন। স্কুলের সামান্য বেতনে পরিবারের ব্যয়ভার গ্রহণ করায় ঘরটি আর মেরামতের সুযোগ পাননি। ৩৩ বছর শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি চলে যান নিজ গ্রাম বাঁশখালিতে। আর থাকেন সেই জীর্ণশীর্ণ ঘরেই।

তার চার ছেলে এবং দুই মেয়ে। বড় ছেলে নিজ গ্রামে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন, মেঝো ছেলে মাদ্রাসার ছাত্র, তিন নম্বর ছেলে টেইলার্সে কাজ করেন আর ছোট ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। স্যারের দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে অবিবাহিত।

২০১২ সালে ব্রেইন স্ট্রোক করেন মাওলানা শাহ আলম। খবর পেয়ে প্রাক্তন কিছু ছাত্র স্যারকে দেখতে যান। এই সময় তারা তাদের প্রিয় স্যারের মাটির ঘরের অবস্থা দেখে খুবই মর্মাহত হন। আমেরিকা প্রবাসী এবং ওই বিদ্যালয়ের ১৯৯৪ ব্যাচের মোজাফফর আহমদ একটি ফেসবুক গ্রুপ খোলেন। যেখানে স্যারের চিকিৎসার জন্য অর্থ সংগ্রহের কথা জানান।

২০২১ সাল পর্যন্ত স্যার আরও তিনবার স্ট্রোক করেন বলে জানান প্রাক্তন ছাত্ররা। সর্বশেষ অসুস্থতায় পড়লে সাবেক শিক্ষার্থী এরশাদ, নাসির, ফারুকসহ আরও কয়েকজনের অনুরোধে আমেরিকা প্রবাসী মোজাফফর আহমেদ আবারও দেশ-বিদেশে থাকা কয়েকজন সাবেক ছাত্রকে সাথে নিয়ে অর্থ সংগ্রহ শুরু করেন।

গত সেপ্টেম্বরে দেশে অবস্থানরত কিছু শিক্ষার্থী স্যারকে তার গ্রামের বাড়িতে দেখতে যান। প্রায় ৭০ বয়সী স্যার ভালো করে কথা বলতে পারছেন না, হাঁটাচলাও আগের মতো নেই। ঘরটি কয়েকবছর আগে যেমন দেখেছেন, তার থেকেও বেশি খারাপ অবস্থায় আছে। এই পরিবেশে স্যার আরও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে বলে তাদের ধারণা।

সাবেক শিক্ষার্থীর মধ্যে বেলাল তালুকদার জানান, সবার পরামর্শক্রমে সংগ্রহ করা অর্থের মধ্য থেকে স্যারের হাতে ৫০ হাজার টাকা দেন। আর বাকি টাকা তাদের হাতে জমা রাখেন। যাতে স্যারকে এক বেডের একটি ঘর উপহার দিতে পারেন। যেখানে তিনি আরামে থাকতে পারবেন।

অবস্থানরত সাবেক শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৯৯৩ ব্যাচের শহিদ চৌধুরী নামের একজন প্রকৌশলী ছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ একটি বাড়ির ড্রয়িং করে স্থানীয় একজন মিস্ত্রিকে বুঝিয়ে দেন বলে জানান সাবেক শিক্ষার্থী বেলাল তালুকদার। বিষয়টি আমেরিকা প্রবাসী মোজাফফর আহমেদকে জানানো হয়। তিনি প্রবাসে থাকা আরও কয়েকজনের সাথে এ ব্যাপারে পরামর্শ করেন।

স্যারের বাড়ি বানানোর কথা শুনে প্রবাসে অবস্থানরত সাবেক কিছু শিক্ষার্থী জানান, স্যারের বাড়ি বানানোর জন্য যত অর্থ লাগে তারা তা দেবে। এতে মাত্র ৭দিনেই ৫ লাখ টাকার একটি ফান্ড জমা হয়। যেখানে ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাতসহ প্রবাসে থাকা প্রায় ১৫০ জনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়।

সাবেক একজন ছাত্রের মধ্যে ফারুক সিকদার বলেন, ‘স্যারের বাড়ি এখান থেকে অনেক দূরে হলেও ভালোবাসার কাছে এগুলো কিছুই না। আমরা স্যারের ঘরের জন্য স্থানীর বাজার থেকে রড, সিমেন্ট, বালি দিয়ে কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করি…।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে