মহিউদ্দিন অদুল : নারী লোলুপ পাষণ্ডরা আসে অন্ধকারে। মধ্যরাতের নিস্তব্ধতায়। প্রাচীর টপকে। ঘরের বন্ধ দরজা খুলে হামলে পড়ে ঘুমন্ত কিশোরী শামীমা আক্তার (১৫)-এর ওপর। তার সম্ভ্রম লুটে নেয়ার চেষ্টায় প্রতিরোধ গড়েন তিনি। এক পর্যায়ে চিনেও ফেলেন দুর্বৃত্তদের। এরপর হাতে থাকা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে শামীমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে অপরাধীরা।
মাথায়, মুখে ও কপালে অসংখ্য আঘাত। আঘাত করা হয়েছে মুখের ভেতরেও। তাকে মৃত ভেবে রক্তাক্ত ও অচেতন অবস্থায় ফেলে আবার সীমানা প্রাচীর টপকে পালায় তারা। সম্ভ্রম রক্ষা হলেও এখন জীবন শঙ্কায় শামীমা। গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয়েছে শামীমার শরীরে। গত চার দিনেও তার সংজ্ঞা ফিরেনি।
তাই চিকিৎসকরা তাকে শঙ্কামুক্ত বলতে পারছেন না। হাসপাতালে সেদিনের বর্বর ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন শামীমার মা রহিমা আক্তার এবং ফুফা জাকারিয়া আল মামুন দুলাল। সোমবার বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের অপারেশন থিয়েটারের সামনে তাদের সঙ্গে কথা হয়। ভেতরে চলছিল অপারেশন।
ঘটনা গত শুক্রবার মধ্যরাতের। জয়পুরহাট জেলার কালাই থানার মাত্রাই ইউনিয়নের বানদীঘি গ্রামের কৃষক সাহেরুল ইসলামের বাড়িতে। চারদিকে উঁচু সীমানা প্রাচীর। তিন কক্ষের টিনশেড সেমিপাকা বাড়ি। অপর দু’সন্তান হযরত আলী শামীম (৯) ও আবু হুরাইরা (৬)কে নিয়ে এক কক্ষে শুয়েছিল সাহারুল ও রহিমা। পাশের কক্ষে মেয়ের উপর নারকীয় বর্বরতার কিছুই টের পাননি। ভোরে জেগে বিষয়টি টের পান। তাদের চিৎকারে এলাকাবাসী ছুটে আসেন। আহত অবস্থায় প্রথমে বগুড়া ও পরে ঢাকায় আনা হয় শামীমাকে।
গতকাল মঙ্গলবার ঢামেক হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের অপারেশন থিয়েটারে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলে তার অপারেশন। তাকে ঢুকানো হয় বেলা সোয়া একটায়। প্রায় তিনটার দিকে অপারেশন শেষ হয়েছে।
ঢামেক হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. অসিত চন্দ্র সরকার বলেন, শামীমাকে শক্ত লোহার বস্তু দিয়ে সজোরে আঘাত করা হয়েছে। তার মাথায় ৫টি আঘাত। মাথার পেছনে একটি গভীর ক্ষত। খুলি ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। কপালের ভ্রুতে, বাম চোখের পাশে ও মুখের ভেতরে জিহ্বার গোড়ায় একটি করে আঘাত রয়েছে। তার অপারেশন হয়েছে। এখন স্থিতিশীল রয়েছে। তবে স্বাভাবিকভাবে মানুষের জ্ঞান বা চেতনার মাত্রা ১৫ থাকে। কিন্তু শামীমার চেতনার মাত্রা এখন ৮। তবে তার চেতনা ফিরবে কিনা তা জানতে আরো ২ থেকে ৩ দিন অপেক্ষা করতে হবে। এর আগে কিছুই বলা যাবে না।
এদিকে অপারেশনের পর থেকে ওই বিভাগের পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে তাকে। স্বজনদের কাছ থেকে জানা যায়, শামীমার পিতা সাহারুল ইসলাম কৃষক। তিনি নিজের জমি চাষ করেন। মা রহিমা বেগম গৃহিণী। বাড়ির চারদিকে রয়েছে ইটের সীমানা প্রাচীর। বাড়িও ইটের তৈরি সেমিপাকা। উপরে টিন। তিন কক্ষের বাড়ি। এক কক্ষে সাহারুল ও রহিমা দুই ছেলেকে নিয়ে থাকেন। অপর কক্ষে কিশোরী মেয়ে শামীমা। অপর কক্ষে খাওয়া-দাওয়া হয়। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে শামীমা বড়। সে পড়াশুনার প্রতি বেশ আগ্রহী। পড়াশুনায়ও ভালো। পড়ে ইউনিয়নের মাত্রাই উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে। ১৮০ শিক্ষার্থীর মধ্যে তার ক্লাস রোল ৮।
কিছু দিন আগে তার নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তার ছোট ভাই শামীম গ্রামের বানদীঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছে। অপর ছোট ভাই আবু হোরাইরাও একই স্কুলে প্রথম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করেছে। পরীক্ষা শেষ করে তিন ভাই-বোনের সময় কাটছিল বেশ আনন্দে। গত শুক্রবার রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর যথারীতি প্রধান ফটক ও ঘরের দরজা বন্ধ করেই তারা ঘুমান।
ধারণা করা হচ্ছে, দুর্বৃত্তরা সংখ্যায় ২ থেকে ৪ জন হতে পারে। রাত ১২টার পর তারা সীমানা প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে। সকালেও বাইরের প্রধান ফটক বন্ধ পাওয়া গেছে। এরপর প্রথমে সাহারুল ও রহিমার কক্ষের দরজা বাইরে থেকে লক করে দেয়া হয়। তাও সকালে সে অবস্থায় পাওয়া যায়। এরপর শামীমার কক্ষের দরজা খুলে বা ছিটকিনি ভেঙে ভেতরে ঢুকে। তারপর তার মুখ চেপে ধরে তার সম্ভ্রম নেওয়ার চেষ্টা চালায়। ঘুম ভাঙার পর সে প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়। কিন্তু দুর্বৃত্তরা সংখ্যায় বেশি হওয়ায় নিঃশব্দে বার বার চেষ্টা চালাতে সমর্থ হয়। এক পর্যায়ে হয়তো তাদের সে চিনে ফেলে। তাই তারা ব্যর্থ হয়ে অপরাধের শাস্তির হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রাণে মেরে ফেলতেই উপর্যুপরি আঘাত করে।
আঘাতের সবগুলোই করা হয়েছে মাথায় ও মুখে। এই নিঃশব্দ নির্মমতার পর শনিবার ভোর ৪টার দিকে রহিমার ঘুম ভাঙে। তিনি দরজা খুলতে যান। দেখেন দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। ফুটো দিয়ে দেখেন পাশে মেয়ের কক্ষের দরজা খোলা। তখনই মেয়ের বিপদের আশঙ্কায় চিৎকার জুড়ে দেন। লোক ডাকাডাকি করতে থাকেন। তা শুনে প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢুকে তার দেবর মন্টু। তিনি বাইরে থেকে দরজা খুলে দিলে মেয়ের কক্ষে গিয়ে দেখেন মাথায় ও মুখে জখম নিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মেয়ে পড়ে আছে নিজের খাটে। খাট, তোষক ও মেঝেতে রক্তের দাগ।
এরপর তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর চিকিৎসকরা অপারগতা জানান। ঢাকায় নেয়ার পরামর্শ দেন। শনিবারই তাকে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালে সরিয়ে নেয়া হয়। পরদিন রোববার পর্যন্ত সেখানে চিকিৎসা চলে।
তাকে আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকদের পরামর্শে রোববার রাত ৯টায় ভর্তি করা হয় ঢামেক হাসপাতালে। জরুরি বিভাগে ভর্তির পর সাড়ে ৯টার দিকে তাকে নিউরোসার্জারি বিভাগের ইউনিট-২ এর ১ নম্বর শয্যায় নেয়া হয়। ওই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. অসিত চন্দ্র সরকারের তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা চলছে। গতকাল তার অপারেশনের পর তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে এই বিভাগের পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে।
শামীমার মা রহিমা আক্তার বলেন, প্রতিদিনের মতো আমরা পাশাপাশি কক্ষে ঘুমিয়েছিলাম। রাতে দুর্বৃত্তরা দেয়াল টপকে ঢুকে তার কক্ষে প্রবেশ করেছে। তার হয়তো সম্ভ্রম নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে মেরে ফেলার জন্য আঘাতের পর আঘাত করে আবার দেয়াল টপকে পালিয়ে গেছে। সকালে ঘুম ভাঙার পর তার কক্ষে গিয়ে দেখি আমার মেয়ে শেষ। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে আসি।
তিনি বিলাপ জুড়ে দিয়ে আরো বলেন, আমার মেয়ে পড়াশুনা করে ডাক্তার হতে চেয়েছিল। তাই সায়েন্স নিয়েছিল। তাকে উৎসাহ দিয়ে আমি ও তার বাবা বলতাম মা যত পড়তে চাস, তত পড়াবো তোকে। আমার সেই মেয়ে কী আমার কোলে ফিরে আসবে। আমাদের তো কোনো শত্রু নেই। কখনও কারো কোনো ক্ষতি করিনি। আমাদের এত বড় ক্ষতি কে করলো।
তার ফুফা জাকারিয়া আল মামুন দুলাল বলেন, হয়তো রাত ১২টা থেকে ৩টার মধ্যে দুর্বৃত্তরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। পাষন্ডদের সে চিনে ফেলায় জীবিত না রাখার জন্যই এভাবে তাকে ধারালো ও শক্ত দেশে তৈরি অস্ত্র দিয়ে মাথায় ও মুখে কুপিয়েছে। মেয়ের সঙ্গে কারো কোনো প্রেম, বিচ্ছেদ বা মনোমালিন্যের কথাও শুনিনি। মেয়ের বা পরিবারের কোনো শত্রু না থাকায় কাউকে সন্দেহও করা যাচ্ছে না। এ জন্য এখন পর্যন্ত মামলাও করা হয়নি। এমজমিন
২৭ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসবি