সোমবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৬, ০২:৩২:০৫

‘কেউ বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে আত্মহত্যা করব’

‘কেউ বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে আত্মহত্যা করব’

মোন্নাফ আলী:  'আমি এখন বিয়ে করমু না, আগে পড়ালেখা শেষ করে ডাক্তার হয়ে নিজে যেদিন সমাজে যোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবো, তার পর বিয়ে করব। তার আগে কেউ বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে আত্মহত্যা করব। তবুও বিয়ে করব না। কথাগুলো বরগুনা সদর উপজেলার ফুলঝুড়ি ইউনিয়নের ছোট গৌরীচন্না গ্রামের ১৫ বছরের কিশোরী তানজিলার। তার মুখেই কথাগুলো মানায়। কারণ, ওই কিশোরী নিজের বিয়ে ঠেকাতে মা-বাবার বিরুদ্ধে মামলা করতেও পিছপা হয়নি। অবশেষে তার মেলে বাল্যবিয়ে থেকে মুক্তি।


কিন্তু উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার গল্পটা ঠিক এর উল্টো, করুণ, হতাশা আর আতঙ্কের। এখানে নেই প্রতিবাদী তানজিলা। আছে বাল্যবিয়ের শিকার লাভলী, মহারানী ও শরীফার মতো কয়েকশ' মেয়ে। এই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের অধিকাংশ মেয়েই ১২ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হচ্ছে। স্বামীর সংসারে গিয়ে লেখাপড়া বন্ধ হচ্ছে। জোর করে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তাদের চঞ্চলতা। কোলে থাকা শিশুকে দেখে তাই ভাই কিংবা বোন ভেবে ভুলও হতে পারে! কিন্তু বাস্তবতা এমনই, 'শিশু হচ্ছে শিশুর মা।' বাল্যবিয়ের প্রভাবে বেড়েছে নির্যাতন, বিচ্ছেদ, বহুবিয়ে, পরকীয়া, আত্মহত্যা, পুষ্টিহীন ও প্রতিবন্ধী শিশু প্রসব এবং গর্ভজনিত মৃত্যু। এ ধরনের বিয়ের পর নির্যাতনের ঘটনায় উলিপুর আদালতে অন্তত ৫০টি মামলা হয়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর উলিপুর উপজেলায় ছয় শতাধিক বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটে। এর ফলে চার শতাধিক শিক্ষার্থী ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত জেএসসি, জেডিসি, দাখিল ও এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারেনি। স্বামীর চাপে অথবা সংসার করতে গিয়ে তাদের পড়ালেখা বন্ধ রয়েছে। এক বছরে এত সংখ্যক বাল্যবিয়ের কারণে উপজেলার কয়েকটি স্কুলে ছাত্রী সংকটও দেখা দিয়েছে।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, কৌশল পাল্টেছেন অভিভাবকরা। আগে কাজির সহায়তায় ভুয়া কাগজে বয়স বাড়িয়ে বিয়ে নিবন্ধন করা হতো। কিন্তু এখন তারা এসব ঝামেলায় যাচ্ছেন না। নিবন্ধন ছাড়াই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন!


নিজ গ্রামে বাধা পেলে লুকিয়ে অন্য গ্রামে নিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন। উপজেলায় প্রশাসন ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার নারী নির্যাতন ও বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কর্মশালা ও সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম কাজে দিচ্ছে না। এ অবস্থায় কুড়িগ্রাম-৩ (উলিপুর ও চিলমারী) আসনের সংসদ সদস্য কে এম মাঈদুল ইসলাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে তিনি উপজেলায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।


২০১৫ সালে একটি বেসরকারি সংস্থা কুড়িগ্রাম জেলায় বাল্যবিয়ে নিয়ে জরিপ চালায়। তাদের প্রতিবেদনে দেখা যায়, জেলার মধ্যে উলিপুর উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। সচেতনতা সৃষ্টিতে বিভিন্ন কার্যক্রম থাকলেও ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে মা-বাবা তাদের মেয়েকে অল্প বয়সেই বিয়ে দিচ্ছেন।


উলিপুরের তবকপুর চাচিয়ারপাড় গ্রামের আঞ্জু মনোয়ারার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। সে বালাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ত। উচ্ছল মেয়েটি পড়ালেখায় বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু দরিদ্র বাবা আ. লতিফ ২০১৫ সালের জুন মাসে তার বিয়ে দেন। পাত্র গুছাইগাছ পশ্চিম কালুডাঙ্গা গ্রামের আ. হাকিমের ছেলে চাঁদ মিয়া (২৪)। বিয়েতে ছেলেপক্ষের দাবি অনুযায়ী ৫০ হাজার টাকার মধ্যে ৩৫ হাজার টাকা ও একটি সাইকেল যৌতুক দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই যৌতুকের বাকি টাকার জন্য শুরু হয় আঞ্জু মনোয়ারার ওপর নির্যাতন। নির্যাতন সইতে না পেরে ডিসেম্বরে সে বিষপানে আত্মহত্যা করে। বাল্যবিয়ের পর আত্মহত্যার ঘটনা শুধু একটি নয়, এমন উদাহরণ আরও রয়েছে।


উপজেলা মহিলা ও শিশুবিষয়ক অধিদপ্তর অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালে বাল্যবিয়ের শিকার উপজেলার ৭০ মেয়ে বিয়েবিচ্ছেদ করতে বাধ্য হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা হয়েছে ৫০টি। ১১টি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে পাঠানো হয়েছে। ১৯টি মামলার অধিকতর তদন্ত চলছে।


বিয়ের পর লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্রী সংকটও দেখা দিয়েছে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, বাল্যবিয়ের কারণে গত বছর উপজেলার ৪০টি মাদ্রাসার ১৩০ জন জেডিসি ও ৫০ জন দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। এ ছাড়া ২০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৬০ জন জেএসসি ও ৭০ জন এসএসসি পরীক্ষা দেয়নি। এর মধ্যে থেতরাই উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়েরই ৪২ ছাত্রী রয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে উপজেলার পাণ্ডুল, দলদলিয়া, থেতরাই ও হাতিয়া ইউনিয়নে স্কুল ও মাদ্রাসাপড়ূয়া ২৮ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়।


উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্রীর সংখ্যা এমনিতেই কম। তার ওপর বাল্যবিয়ের ফলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া বন্ধ করে দিচ্ছে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ না করা গেলে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্রী সংকটে পড়বে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) এ এইচ এম জামেরী হাসান বলেন, বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।


কুড়িগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য কে এম মাঈদুল ইসলাম বলেন, 'এলাকায় অনেক স্কুল-কলেজ হয়েছে। সেখানে মেয়েরা পড়ছে। পাশাপাশি বৃত্তিমূলক শিক্ষার কারণে মেয়ে শিক্ষার হারও বেড়েছে। আগে এ এলাকার মানুষ ঠিকমতো খেতে পারত না; কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। বাল্যবিয়ে যে বন্ধ হয়েছে, তা বলছি না, তবে আগের তুলনায় কমেছে।' বাল্যবিয়ের কারণে এক বছরে তিন শতাধিক ছাত্রীর স্কুল ছাড়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাঈদুল ইসলাম বলেন, 'পরিসংখ্যান যে পুরোপুরি সঠিক, তা আমার মনে হয় না। কারণ, অনেকে উলিপুর ছেড়ে ঢাকায় এসে গার্মেন্টে চাকরি নিয়েছে। তারাও তো স্কুল ছেড়েছে। আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে তালিকা চেয়েছি; কিন্তু উনি তা দিচ্ছেন না। তালিকা হাতে পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।' তিনি আরও বলেন, 'পাহারা বসিয়ে তো আর বাল্যবিয়ে ঠেকানো যাবে না। সবাইকে সচেতন হতে হবে। আমরা সে কাজটিই করার চেষ্টা করছি।-সমকাল

২৫ এপ্রিল,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে