বৃহস্পতিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৬, ০১:৫৯:৩৫

এবারের পিএসসিতে পরীক্ষা দিবেন ৬৫ বছরের বৃদ্ধা

এবারের পিএসসিতে পরীক্ষা দিবেন ৬৫ বছরের বৃদ্ধা

মেহেরপুর: সাদা চুল। ভাঁজ পড়েছে চেহারায়। চোখে ঠিকমতো দেখতেও পান না। এমনই এক বৃদ্ধা বই-খাতা নিয়ে গ্রামের মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে যাচ্ছেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সঙ্গে দুজন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। প্রথম দেখাতেই মনে হতে পারে নাতনিদের স্কুলে পৌঁছে দিতে তিনি যাচ্ছেন তাদের সঙ্গে। কিন্তু ঘটনাটি তার উল্টো। যাদের সঙ্গে যাচ্ছেন তারা তার সহপাঠী। তিনিও পঞ্চম শ্রেণির নিয়মিত ছাত্রী।

আগামী ২০শে নভেম্বর সারা দেশে একযোগে শুরু হতে যাওয়া প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় (পিএসসি) অংশ নিতে যাচ্ছেন তিনি। এই পিএসসি পরীক্ষার্থীর নাম বাসিরন খাতুন। বয়স ৬৫ বছর। মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে গাংনী উপজেলার হোগলবাড়িয়া গ্রামের মাঠপাড়ায় তার বাড়ি।

ওই গ্রামের মৃত রহিল উদ্দিনের স্ত্রী তিনি। ৩৫ বছর আগে স্বামীহারা হয়েছেন। এক ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে তার। একমাত্র ছেলে মহির উদ্দিনের সঙ্গে থাকেন তিনি। ছেলে মেয়েদের সন্তানরাও বড় হয়েছে। তারা এখন বিভিন্ন কলেজে ও বিদ্যালয়ে লেখা পড়া করে। লেখাপড়া প্রচণ্ড আগ্রহ থেকে তিনি নতুন করে আবার লেখাপড়া শুরু করেছেন। বাড়ি থেকে প্রতিদিন এক কিলোমিটার মেঠোপথ হেঁটে বিদ্যালয়ে যান তিনি।

হোগলবাড়িয়া পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশের বেড়া দেয়া ছোট ছোট চারটি কক্ষের একটিতে সহপাঠীদের সঙ্গে লেখাপড়ায় ব্যস্ত বাসিরন। বাংলা বইটি চোখের খুব কাছে নিয়ে আপন খেয়ালে বইয়ের পাতায় আঙুল দিয়ে পড়ে যাচ্ছেন বাসিরন। পড়ার সময় ঘন ঘন চোখের পলক ফেলছেন।

বাসিরনের আগ্রহ দেখে শিক্ষকরাও অধিক গুরুত্বের সঙ্গে তাকে খেয়াল রাখেন। স্কুলের টিফিন বিরতিতে সহপাঠীদের সঙ্গে নানারকম খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করেন বাসিরন। কখনো এক্কা দোক্কা, কখনো কপাল টোক্কা। সহপাঠীরাও তাকে পেয়ে বেশ আনন্দিত জানালেন  স্কুলের শিক্ষকরা।

হার না মানা অদম্য আগ্রহী বাসিরন খাতুন জানান, ছোট থেকেই তার লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক ছিল। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে সংসার সন্তান নিয়ে লেখাপড়া করা হয়নি তার। সন্তানদের তিনি চেষ্টা করেছিলেন তারা যেন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। এর মধ্যেই মারা যায় তার স্বামী। ফলে সন্তানরা লেখাপড়া বেশি করতে পারেননি।

তিনি আরো জানান, এরপর যখন নাতি নাতনিরা লেখাপড়া শুরু করলো তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এবার লেখাপড়া শুরু করবো। ছয় বছর আগে স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য বার বার স্কুলে যাওয়া আসা করে কিন্তু তখন মাস্টাররা তাকে ভর্তি করাননি। পরের বছর যখন আবার কয়েকদিন স্কুলে যায় তার পর আমার আগ্রহ দেখে সে বছর ভর্তি করে আমাকে।

অনেকেই ঠাট্টা বিদ্রূপ করলেও কর্ণপাত করেননি তাতে। বরং অনেকের উৎসাহে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বাসিরন বলেন, আমি তো মানুষ সব মানুষে যদি লেখাপড়া করতে পারে তাহলে আমি পারবো না কেন। হয়তো আমি একটু কম পারবো। কিন্তু পারবো তো। লেখাপড়া শিখে কি করার ইচ্ছা এমন প্রশ্নের জবাবে বাসিরন বলেন, আমি পিএসসি পাস করার পর গ্রামে গার্লস স্কুলে (মাধ্যমিক বালিকা) ভর্তি হবো। নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি গ্রামের গরিব ছেলে মেয়েদের বিনাপয়সায় পড়া শেখাবো।

বাসিরন নেছার ছেলে আকবর আলী ও মহির উদ্দিন জানান, অল্প বয়সে বিয়ে হবার কারণে স্কুলে যেতে পারেননি। লেখাপড়ার প্রবল ইচ্ছা ছিল তার। এ বয়সে এসে বিদ্যালয়ে গেলে অনেকেই নানা কথা বলে। নিষেধ করেও লাভ হয়নি। এখন আর তাকে কেউ বাধা দেয় না। পরীক্ষার ফিসসহ সকল প্রকার সহযোগিতা করেন তারা।

এখন মাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন পরিবারের সদস্যরা। দাদির বয়সী বাসিরনের নিয়মিত স্কুলে আসা দেখে তার সহপাঠীরাও অনুপ্রাণিত হয়। সহপাঠী মৌ জানায়, বাসিরন তার দাদির বয়সী হলেও তাকে বান্ধবীর মতো করে দেখতে হয়। লেখাপড়া নিয়ে কোনো সমস্যা মনে হলে একে অপরকে সহযোগিতা করেন।

সে আরো বলে, বাসিরনকে স্যাররা পড়া ধরতে দেরি করলে তার মন খারাপ হয়ে যায়। তখন সে আমার পড়া ধরেন। আমি পারছি কিনা বুঝবো কি করে। সংসারে কেমন বাসিরন প্রশ্নের জবাবে বৌমা জাহানারা বেগম বলেন, আমার আর দুটি সন্তানের মতো শাশুড়িও লেখাপড়া করে। তার আগ্রহের কারণে তাকে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করি।

সারাদিন সে লেখাপড়া নিয়েই থাকে। মাঝে মধ্যে সাংসারিক কাজে সহযোগিতা করে। বৌমাকে নিয়েও খুশি বাসিরন। বাসিরন তাকে বৌমা দেখিয়ে বলে আমার দুটি পরের বাড়িতে গেছে। পরের মেয়ে আমার বাড়িতে এসেছে। তাকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমারই।

প্রতিবেশী পারভিন খাতুন বলেন, বাসিরন তাদের মায়ের বয়সি। আমরা লেখাপড়া করতে পারিনি। এই বয়সের বাসিরনের আগ্রহ দেখে আমাদেরও মাঝে মধ্যে লেখাপড়া করতে মন চাই।
বাসিরনের মেয়ের ছেলে জসিম উদ্দিন বলেন, পরিবারের সকলকে অবাক করে দিয়ে নানী এই বয়সে পিএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। তার আগ্রহ দেখে আমি বিশ্বাস করি সে পাস করবে।

প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দিন বলেন, বাসিরন খাতুন ২০১০ সালে স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য কয়েকবার এসেছিলেন। বয়স্ক মানুষ মনের বাসনায় ভর্তি হতে এসেছেন। পরে ক্লাস করবে কি না এভেবে সে বছর তাকে ভর্তি করানো হয়নি। পরবর্তীতে যখন সে আবার আসে ২০১১ সালে তাকে ভর্তি করি। ভর্তি করার পর থেকে তার আগ্রহ দেখে অবাক হয়েছি। প্রতিটি দিন সে ঠিকমতো স্কুলে আসে। এমনকি বৃষ্টির দিনেও সে অনুপস্থিত হয়নি।

গত বছর তার পিএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম না তাকে পরীক্ষা দেয়াবো কিনা। এবছর উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে বাসিরনের আগ্রহের কথা জানালে তারা পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি দেন। আমার বিশ্বাস সে পিএসসি পাস করবে। ক্লাসের অন্য শিক্ষার্থীদের মতো বাসিরনকে প্রতি ক্লাসে পড়া ধরতে হয়।

না ধরলে সে রাগ করে জানিয়ে সহকারী শিক্ষিকা আনার কলি জানান, বাসিরনের ক্লাস শুরু হয় সাড়ে ১১টায়। কিন্তু সে স্কুলে চলে আসে ১০টার মধ্যে। তার বিভিন্ন সমস্যাগুলো সে তখন বুঝে নেয়ার চেষ্টা করে। কোনো কিছু লিখতে দিয়ে ভুল করলে সেটি কেটে দিলে কষ্ট পায় সে। তখন সে বলে না কেটে সঠিকটা বলে দেয়ার জন্য। তখন সে সঠিকটা শুনে আবার লিখে দেয়।

প্রতিবেশী কোরবান আলী পেশায় একজন হাউজ টিউটর। তিনি জানান, তার ছোট বোনও এবার পিএসসি পরীক্ষা দিবে। বাসিরন অনেক সময় বই খাতা নিয়ে তার বোনের কাছে পড়তে যায়। এ সময় কোনো সমস্যা হলে বাসিরন আমার সঙ্গে সমাধান করে নেয়। তিনি আরো বলেন, বাংলা অঙ্কসহ অন্যান্য বিষয়গুলো ভালোভাবে আয়ত্ব করতে পারে সে। তবে ইংরেজিতে তার একটু সমস্যা হয়।

গাংনী মটমুড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সোহেল আহমেদ বলেন, খবর পেয়ে আমি তার বাড়িতে ছুটে গিয়েছি। তার বয়স তার আগ্রহের কাছে হার মেনেছে। বাসিরন সারা দেশের বয়স্ক মানুষদের জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তাকে দেখে অনেকেই অনুপ্রাণিত হবে। আমার ইউনিয়ন এলাকায় এ ধরনের বয়সের কেউ লেখাপড়া করতে চাইলে তাকে পরিষদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

গাংনী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আকবর আলী জানান, শিক্ষার কোনো বয়স নাই। এ বয়সের একজন পিএসসি পরীক্ষা দিবে শুনে আমি আনন্দিত। তাকে দেখে বয়স্ক মানুষ লেখাপড়াই আগ্রহী হবে। সরকারের ভিশন নিরক্ষর মুক্ত বাস্তবায়নে সহজতর হবে।-এমজমিন

১৭ নভেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে