ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে : সিলেটের জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেনা কমান্ডোরা। অভিযানে চার জঙ্গি নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে এক নারীও রয়েছে। অভিযান পুরো শেষ হয়নি জানিয়ে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ভেতরে আর জীবিত জঙ্গি নেই বলেই তাদের কাছে মনে হয়েছে। অভিযানের বাকি প্রক্রিয়া শেষ করে সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে।
বিস্ফোরকে ভরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন থেকে জঙ্গিদের খুঁজে বের করে মারার ঘটনাকে সেনাবাহিনীর জন্য বড় সাফল্য বলে উল্লেখ করেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান। তিনি বলেন, ‘এই অভিযানে আমাদের কোনও সদস্য কেউ আহত হয়নি। আমরা সফল।’
সিলেটে শিববাড়ির জঙ্গি আস্তানাটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল উল্লেখ করে ফখরুল আহসান বলেন, ‘কখনোই পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি।’ কমান্ডোদের কোনও ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি উল্লেখ করে এই সেনা-কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, ‘জঙ্গিরা এক্সপ্লোসিভ ফাটিয়েছে, গ্রেনেড চার্জ করেছে, স্মল আর্মস ব্যবহার করেছে। তাদের যা ছিল সব ব্যবহার করেছে।’
নিহত চারজন ভালো প্রশিক্ষিত বলে উল্লেখ করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান আরও বলেন, ‘জঙ্গিদের খুঁজে বের করে মারা হয়েছে। এটা কিন্তু বিশেষ করে সেনাবাহিনীর জন্য একটা বড় সফলতা বলে মনে করি। আমাদের অভিযান এখনও চলমান, আরও হয়তো কিছু সময় লাগতে পারে।’
নিহত দুই জঙ্গির লাশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছেন সেনা সদস্যরা। বাকি দুই জনের লাশ ঘটনাস্থলেই ছিল। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানিয়েছেন সেনাবাহিনী সদর দপ্তরের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান।
তিনি বলেন- বিকালের দিকে জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহল দখলে নিয়েছে সেনাবাহিনী। এরপর তল্লাশি চালিয়ে ৪ জনের লাশ পাওয়া যায়। প্রতিটি লাশের শরীরে সুসাইড ভেস্ট বাঁধা ছিল। আর কোনো জঙ্গি রয়েছে কী না- সে কারণে তল্লাশি অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন- উদ্ধার হওয়া চারটি লাশের মধ্যে ৩ জন পুরুষ ও একজন মহিলা। রোববার দুই জন মারা যাওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল। সোমবার বিকাল পর্যন্ত সর্বশেষ ৪ জনের লাশ মিলল। আর কোনো লাশ রয়েছে কী না- সেটি তল্লাশির পর জানা যাবে বলে জানান তিনি। তবে- কেউ জীবিত নেই বলে ধারণা করছেন অভিযানকারীরা।
শনিবার সকাল থেকে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো দলের সদস্যরা জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু করেন। অভিযানের প্রথম দিন গুলি, বিস্ফোরণে প্রকম্পিত ছিল আতিয়া মহল। রোববারও দিনভর অভিযান চলে। বিকালে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দুই জঙ্গি মারা যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত করা হয়। গতকালের অভিযান ছিল গত দুই দিনের চেয়ে জোরালো। সকাল থেকে টের পাওয়া যাচ্ছিল অভিযানের তীব্রতা। গুলির শব্দ শোনা যায় থেমে থেমে। আসে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ। এতে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। তবে বেলা সাড়ে ৩টার পর থেকে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ কমে আসে।
সন্ধ্যায় এ নিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান বলেন- শনিবার সকাল থেকে শুরু হওয়া অপারেশন টোয়াইলাইট এখনো চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে ওই বাড়ি পুরোটাই দখল করা হয়েছে। এর মধ্যে চার জনের লাশ মিলেছে। এর মধ্যে একজন মহিলাও রয়েছে। তিনি বলেন- গতকাল বিকাল পর্যন্ত জঙ্গিরা প্রতিরোধ গড়েছে। ভেতর থেকে গ্রেনেড, স্মল আর্মসের গুলি দিয়ে ফায়ার করেছে। একপর্যায়ে সেনা সদস্যরা বাড়ির ভেতরে অবস্থান নিয়ে তল্লাশি চালান। তল্লাশিকালে চার জনের লাশ মিলেছে। আরো কোনো লাশ ভেতরে আছে কী না এজন্য তল্লাশি চলছে। নিহত জঙ্গিদের মধ্যে শীর্ষ জঙ্গিদের কেউ আছে কী না- সেটি পুলিশ দেখবে বলে জানান তিনি। তিনি জানান- অভিযান অব্যাহত রয়েছে। শেষ হওয়ার পর সর্বশেষ তথ্য জানিয়ে দেয়া হবে।
তিনি বলেন, পুরো বিল্ডিং-এ যে পরিমাণ এক্সপ্লোসিভ আছে এগুলো যদি বিস্ফোরণ হয় তাহলে এই বিল্ডিংয়ের অংশ বিশেষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যে অবস্থায় আছে, এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ এবং সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে। দুপুরের পর আতিয়া মহল থেকে ধোঁয়া ওড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে যে পরিমাণ ফায়ারিং হয়েছে, গ্রেনেড চার্জ করা হয়েছে, ভেতরে বাসিন্দাদের লেপ-কাঁথায় আগুন ধরাটা অস্বাভাবিক কিছু না। যে কোনোভাবে আগুন লাগতেই পারে। আমরা আগুন নিভিয়েছি।
এদিকে- সন্ধ্যায় নিহত দুই জঙ্গির লাশ সিলেট মহানগর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছেন সেনা সদস্যরা। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার জেদান আল মুছা মানবজমিনকে জানিয়েছেন- দুই জঙ্গির লাশ তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সুরতহাল রিপোর্টের পর লাশ দুটির ময়না তদন্তের জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হবে। আর কোনো লাশ এখনো তাদের কাছে দেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি। লাশ দুটি একেবারে পুড়ে গেছে বলে জানান তিনি।
গতকাল সকালে তেমন কোনো সাড়া শব্দ মিলেনি আতিয়া মহলে। সকাল ১০টার পর শুরু হয় গোলাগুলি। গুলির তীব্রতায় প্রকম্পিত হয়ে শিববাড়ি। থেমে থেমে আসছিল গ্রেনেডের আওয়াজ। এই গুলি বিনিময়ের ঘটনা চলে দুপুরের পর পর্যন্ত। গুলি চলার সময় গোটা শিববাড়ি এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। দুপুরের খানিক বিরতি দেওয়ার পর ফের শুরু হয় গোলাগুলি। এ সময় কয়েকটি গ্রেনেডের শব্দ ভেসে আসে ভেতর থেকে। সাড়ে ৩টার দিকে প্রচণ্ড শব্দে একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দ আসে। এরপর কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আতিয়া মহলের উপরে। অনেক দূর থেকে সেই ধোঁয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। এরপর থেকে আর কোনো গুলির শব্দ শোনা যায়নি। বিকাল ৪টার দিকে সেখানে পৌঁছে সিআইডির ক্রাইম সিনের দুটি গাড়ি।
৫ জন উদ্ধার: সকাল তখন সোয়া ১০টা। এমন সময় আতিয়া মহলের পাশের ভবন থেকে বের করে আনা হয় ৫ জনকে। এর মধ্যে তিনটি শিশু ও দুই জন মহিলা। তারা গত চার দিন ধরে আতিয়া মহলের একশ গজ দূরের বহুতল এক বাসায় অবস্থান করছিলেন। অভিযান শুরু হওয়ার পর পরই তারা বাসার ভেতরে আটকা পড়েন। গতকাল সকালে তাদের স্বজনরা আটকে থাকার খবরটি পুলিশকে অবগত করলে পুলিশ অভিযানিক দলকে অবগত করে। পরে সকাল সোয়া ১০টার দিকে তাদের বের করে আনা হয়। পরে তাদের মূল সড়ক দিয়েই হুমায়ূন রশীদ স্কয়ারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
এলাকা ছেড়ে যায় অনেকেই : আতিয়া মহলের চারদিকে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ। এমনটি জানিয়েছে খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এরপর অনেকেই একটু দূরের বাসায় অবস্থান করছিলেন। গতকাল এলাকা থেকে অনেক পরিবারকে বের হয়ে চলে যেতে দেখা গেছে। বিকাল ৪টার দিকে মোমিনখলা এলাকা থেকে একটি পরিবার বের হয়ে পুলিশি ব্যারিকেডের কাছে আছে।
এ সময় পুলিশকে তারা জানায়- বাসায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস নেই। তিন দিন ধরে তারা কেবল শুকনো খাবার খেয়ে বেঁচে আছে। এ কারণে বাসা তালা দিয়ে তারা বেরিয়ে এসেছেন। পরে চেকপোস্টে থাকা পুলিশ সদস্যরা তাদের বের করে দেন। যাওয়ার সময় তারা সাংবাদিকদের জানান- আত্মীয়ের বাসায় যাচ্ছেন। অভিযান শেষ হলে তারা বাড়ি ফিরবেন। এভাবে বেশ কয়েকটি পরিবার গতকাল বিভিন্ন সময় এলাকা ছেড়ে চলে যান।
২৮ মার্চ ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসবি