ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে : আবার জেগে উঠেছে শিববাড়ি। রক্ত ঝরানো এক ইতিহাসের জন্ম দেয়ার পর আবারো কোলাহলমুখর পুরো এলাকা। শিববাড়ি বাজারের দোকানপাট খুলেছে। সচল হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এলাকাছাড়া মানুষ ফিরেছেন বাড়িতে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ পুরোপুরি স্বাভাবিক। দূরপাল্লার গাড়িও চলছে শিববাড়ির উপর দিয়ে।
এখন পুরোপুরি আগের মতোই শিববাড়ির জীবন প্রবাহ। তবে কাটেনি আতঙ্ক। আর তাই এলাকার মানুষও নিজেদের জন্যই আরো বেশি সতর্কতা অবলম্বন করছেন। বাসা ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে এখন থেকে তারা সব ধরনের সতর্কতা বজায় রাখবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ২৩শে মার্চ গভীর রাতে সন্ধান মেলে শিববাড়ি জঙ্গি আস্তানার। পরদিন বন্ধ করে দেয়া হয় গ্যাসসংযোগ। এরপর শুরু হয় দুর্ভোগ। বিদ্যুৎ আসে আর যায়।
পানি সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। ২৫ তারিখ সকাল থেকেই শুরু হয় মূল অভিযান। শিববাড়ি এলাকার সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। ঘুম নেই, খাওয়া নেই শিববাড়ি, পাঠানপাড়া, জৈনপুর, মোমিনখলা সহ কয়েকটি গ্রামের মানুষের। বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ সংকট পাশাপাশি গুলি-গ্রেনেডের লড়াইয়ে শিববাড়ির আশপাশের মানুষও এলাকা ছেড়ে চলে যান।
এ দিন সন্ধ্যায় ঘটে শিববাড়ি ট্র্যাজেডির। আতিয়া মহলের অদূরে ঘটে দুটি ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা। এ ঘটনায় মারা যান র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ, পুলিশের দুই ওসিসহ ৭ জন। আরো আতঙ্ক চেপে বসে শিববাড়িতে। গোটা এলাকায়ই হয়ে উঠে আতঙ্কময়। এলাকায় জঙ্গিদের অবস্থান থাকতে পারে- এমন আশঙ্কায় সব খানেই দেখা দেয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
অবশেষে ২৮শে মার্চ সেনাবাহিনী সফল অপারেশন টোয়াইলাইটের মাধ্যমে আতিয়া মহল জঙ্গিমুক্ত করে। আতিয়া মহল সমঝে দেয়া হয় পুলিশকে। সেনা সদস্যরা ফিরে যায় ব্যারাকে। যখন পুলিশ আতিয়া মহলের দায়িত্ব নেয় তখনই জঙ্গির ছিন্ন-ভিন্ন মরদেহ ছিল আতিয়া মহলে। ৫ দিন ধরে পুলিশ আর আতিয়া মহলের ভেতরে ঢুকেনি। প্রচুর বিস্ফোরক থাকায় পুলিশের পক্ষে ঢোকাও সম্ভব হয়নি। এখন আতিয়া মহল জুড়ে লাশপচা দুর্গন্ধ। অপেক্ষা বোমা ডিসপোজাল টিমের। কিন্তু ওই টিম আসছে না। দুই লাশের ছিন্ন-ভিন্ন অংশও সরানো যাচ্ছে না। দিন যতই যাচ্ছে দুর্গন্ধ আরো বাড়ছে। এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে সেই দুর্গন্ধ। রাস্তা পর্যন্ত গন্ধ ভেসে আসছে।
৩১শে মার্চ পুলিশের পক্ষ থেকে জারি করা ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। শিববাড়ি হয়ে সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু করে ওই দিন সন্ধ্যা থেকে। পুলিশের ব্যারিকেড সংকোচিত করা হয়। আতিয়া মহলকেন্দ্রিক ব্যারিকেড রাখা হয়েছে। দোকানপাট খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘ এক সপ্তাহ পর ফের সচল হতে শুরু করে শিববাড়ি। গত তিন দিনে শিববাড়ি এখন পুরোপুরি সচল। আবার জেগে উঠেছে। পাঠানপাড়া রুটের একটি স্কুল ছাড়া প্রায় সবক’টি স্কুলও খুলে দেয়া হয়েছে। রুট খুলে দেয়ায় শিববাড়ি দিয়েই যানবাহন চলছে।
গতকাল দুপুরে শিববাড়ি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কেবলমাত্র পাঠানপাড়া রাস্তা ছাড়া সব রাস্তাই চালু। আতিয়া মহলের আশপাশে গুলির খোসা ছড়িয়ে আছে। রয়েছে কিছু বিস্ফোরকের চিহ্নও। পাঠানপাড়া রুটে দোকানপাট খুলেনি। পুলিশ আছে পুরো রাস্তাজুড়ে। আতিয়া মহল বিস্ফোরকমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ওই রুট খুলে দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা। তারা জানিয়েছেন, আতিয়া মহল থেকে প্রায় ২০ গজ দূরে অবস্থান পুলিশের।
কারণ হিসেবে তারা জানান, ৫ তলা ওই ভবনের ভেতরে প্রচুর বিস্ফোরক রয়েছে। এ কারণে ভবনটি ঝুঁকিমুক্ত নয়। ফলে পুলিশও ভেতরে যাচ্ছে না। বোমা ডিসপোজাল টিম তল্লাশি করার পর হয়তো ঢোকা যাবে। আতিয়া মহলে ছিল ২৮ পরিবার। তারাও গত ১০ দিন ধরে বাইরে। বসবাস করছেন আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে। কেউ কেউ হোটেলে বসবাস করছেন। বাসাটি বিস্ফোরকমুক্ত না হলে তারা ভেতরে ঢুকতে পারছেন না। জিনিসপত্র কোন অবস্থায় রয়েছে সেটিও তারা জানেন না। পুলিশের পক্ষ থেকে ঢোকার অনুমতি পেলে তারা বাসায় ঢুকবেন।
এরপর মালপত্র সরাবেন। ওই মহলের বাসিন্দা কেউ-ই আর ফিরতে চান না। তারা বিকল্প হিসেবে অন্যস্থানে বাসা ভাড়া করে থাকবেন বলে জানান। শুধু আতিয়া মহলই নয় পাশের তিনটি বহুতল ভবনের বাসিন্দারাও গতকাল পর্যন্ত ফিরতে পারেননি। পুলিশ এখনো এলাকা ঘিরে রেখেছে। তারাও বসবাস করছেন আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে। এছাড়া ওই তিনটি ভবনেও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। আতিয়া ভবনের লাইনের সঙ্গে ওই তিনটি ভবনের গ্যাস লাইনের সংযোগ থাকায় তারাও গ্যাস পাচ্ছে না।
শিববাড়ি এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ছয়েফ খান গতকাল বিকালে জানিয়েছেন, এখন আর এলাকায় আতঙ্ক নেই। দোকানপাট খুলেছে। সবকিছু স্বাভাবিক হয়েছে। একটি স্কুল ছাড়া সব স্কুল খুলে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এলাকার যারা দুর্ভোগের কারণে বাড়ি ছেড়েছিলেন তারাও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ফিরে এসেছেন। আতঙ্কময় পরিস্থিতি কেটে গিয়ে শিববাড়ি আবার পুনর্জাগরণ হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
একই কথা জানিয়েছেন স্থানীয় পাঠানপাড়া এলাকার বাসিন্দা শেখ ওমর ফারুক বাবলুও। তিনি জানান, আতিয়া মহল থেকে এখন কেবল দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এটি একমাত্র সমস্যা। আর কোনো সমস্যা এলাকায় নেই বলে দাবি করেন তিনি। সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এমজমিন
০৩ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসবি