ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে : সিলেটের শিববাড়ির ‘অভিশপ্ত বাড়ি’ আতিয়া মহল। জঙ্গিবিরোধী অভিযানের কারণে দেশজুড়ে আলোচিত এ মহলের নাম। এক নামেই এ ভবনকে চিনেন সবাই। এ আতিয়া মহলেই জঙ্গিদের বিরুদ্ধে টানা চার দিন অভিযান চালিয়েছিল সেনাবাহিনীর কমান্ডো টিম।
এই আতিয়া মহলকে নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই সিলেটে। ইতিমধ্যে আতিয়া মহল মালিক উস্তার আলীর কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। মালিকের কাছে হস্তান্তরের পর জঙ্গি অভিযানের সময় বাইরে থাকা ভাড়াটিয়া এসে সব মালপত্র নিয়ে গেছেন। আর তারা আতিয়া মহলের বাসিন্দা হতে চান না। ওদিকে- আতিয়া মহল এখন দর্শনীয় ভবন হয়ে উঠেছে।
প্রতিদিনই সিলেটসহ দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আতিয়া মহল দেখতে আসেন। পরিদর্শনে যায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এত বড় জঙ্গিবিরোধী অভিযানের পর আতিয়া মহল এখন ‘পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়ি’। কোনো বাসিন্দা নেই আতিয়া মহলে। সুনসান নীরব-নিস্তব্ধ পুরো বাড়ি।
আতিয়া মহল সিলেট নগরীর শিববাড়ি এলাকায় অবস্থিত। সিলেটের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও সাবেক সরকারি কর্মচারী উস্তার আলী প্রায় ৬ বছর আগে নির্মাণ করেছিলেন এ বাড়ি। তার বাড়ি পার্শ্ববর্তী বন্দরঘাট এলাকায়। তিনি শিববাড়ির শিবমন্দিরের পাশের ডোবা প্রকৃতির জায়গায় পাশাপাশি দুটি বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন। এর দুটি ভবনের নামই হচ্ছে আতিয়া মহল। এরমধ্যে পাঠানপাড়া সড়কের পাশঘেষা যে ভবনটি রয়েছে সেটি হচ্ছে ৪ তলা। আর পাশেই নির্মাণ করা হয়েছিল ৫ তলা ভবন।
ওই ৫ তলা ভবনের নিচতলার বাম পাশের কর্নারের ফ্ল্যাটে গত জানুয়ারি মাসে বাসাভাড়া নিয়েছিল জঙ্গিরা। মর্জিনা নামের এক মহিলা ও কাউছার নামের এক পুরুষ নিজেদের স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। প্রায় ৩০টি ফ্ল্যাটের ওই বাসাটিতেই যে জঙ্গিরা লুকিয়ে রয়েছে সেটি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি ভবনের শতাধিক বাসিন্দা। ঘটনার পর যখন ভাড়াটিয়ারা বাড়ি ফিরেছিল, তখন তারা জানিয়েছিল- ‘ওই ফ্ল্যাটে বসবাসের সময় মহিলা বোরকা পরেই বাজার করতে বের হতো। মাঝেমধ্যে ওই মহিলা কেবল মহিলাদের সঙ্গেই কথা বলতো। তবে কখনো তারা মহিলার মুখ দেখতে পারেননি।’
আতিয়া মহলের বাসিন্দা ছিলেন বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ। ছিল পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বসবাসও। কিন্তু তারাও কোনো দিন জঙ্গিদের অবস্থান নিশ্চিত হতে পারেননি। আতিয়া মহলের জঙ্গিদের অবস্থান নিশ্চিত করেছিল ঢাকার পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সদস্যরা। ২৩শে মার্চ মধ্যরাতের পর থেকে আতিয়া ভবনে শুরু হয় রুদ্ধশাস অবস্থা। এরপর জঙ্গিদের অবস্থান সনাক্তের পর সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর দলের সদস্যরা ২৫শে মার্চ থেকে ২৮শে মার্চ বিকাল পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করেন।
ওই অভিযানে আতিয়া ভবনের নিচতলার ফ্ল্যাটে থাকা ৪ জঙ্গিই মারা যায়। মারা যাওয়া জঙ্গিদের মধ্যে একজন মহিলা ছিল। পরবর্তীকালে র্যাবের বোম নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটের সদস্যরা ৪ঠা এপ্রিল থেকে ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত তল্লাশি চালিয়ে ভবনকে নিরাপদ করে পুলিশের কাছে আতিয়া ভবন হস্তান্তর করে। পুলিশ ১০ই এপ্রিল আতিয়া ভবনের মালিক উস্তার আলীর কাছে ভবনটি হস্তান্তর করে। ওই দিন ভবনের ভাড়াটিয়া বাসিন্দারা ভেতরে ঢুকে তাদের মালামাল নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
আতিয়া মহলে জঙ্গি অভিযানে অনেক পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আতিয়া মহলের অভিযানে ভবনের নিচতলা পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর ভবনেই সামনে থেকে দাঁড়িয়ে তাকালেই চোখের পড়ে ধ্বংসের চিহ্ন। ভবনের সামনের অংশের নিচতলা থেকে ৫ তলা পুরোটাই বিধ্বস্ত হয়েছে। আর নিচতলার ভেতরে অসংখ্য গুলি ও গ্রেনেডের চিহ্ন রয়েছে। এখন আতিয়া মহল অভিশপ্ত বাড়ি। এ বাড়িটি এখনো এলাকাবাসীর কাছে আতঙ্ক। স্থানীয়রা অনেকেই আতিয়া মহলের দিকে ফিরেও তাকায় না। নাম শুনলেই অনেকেই আঁতকে ওঠে। তবে উৎসুক মানুষের অভাব নেই।
গত ১০ দিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা আতিয়া মহল দেখতে সিলেটসহ দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন দলে দলে আসছেন। তারা ভবনের ভেতর পর্যন্ত যেতে পারছেন। এখন আর আতিয়া মহলে পুলিশ মোতায়েন নেই। গোটা মহল ও আশপাশ এলাকাও বিস্ফোরকমুক্ত করা হয়েছে। নিরাপদ হয়ে গেছে আতিয়া মহল। এ কারণে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আতিয়া মহল পরিদর্শনে আসেন।
আতিয়া ভবনের পাশের দেশবন্ধু প্লাস্টিক কাটিংয়ের স্বত্বাধিকারী বদরুল ইসলাম গতকাল জানিয়েছেন, আতিয়া মহলে এখন দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ছে। প্রতিদিনই শ’ শ’ মানুষ জঙ্গি অভিযানের আলোচিত এ মহলটি দেখতে ছুটে আসছেন। কেউ কেউ ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ছবিও তুলছেন। তিনি বলেন, ভবনের ঠিক পাশেই তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সময় তার অনেক টাকার ক্ষতি হয়েছে।
সিলেটের মোগলাবাজার থানার ওসি খায়রুল ফজল গতকাল জানিয়েছেন, আতিয়া মহল মালিকের কাছে সমঝে দেয়ার পর দুই দিন সেখানে পুলিশ মোতায়েন ছিল। এখন আর পুলিশ নেই। তবে পুলিশি নজরদারি রয়েছে। এলাকায় যাতে কেউ আতঙ্ক না ছড়াতে পারে সে ব্যাপারে পুলিশ সতর্ক রয়েছে।
পাঠানপাড়া এলাকার বাসিন্দা ওমর ফারুক বাবলু জানান, ‘আতিয়া মহলের ঘটনাবলি মনে হলেই আঁতকে উঠি। এই ভবনের জঙ্গিবিরোধী অভিযানের কারণে এলাকার মানুষও ছিলেন সন্ত্রস্ত।’ আতিয়া মহলের ঘটনার পর এলাকার মানুষ আরো বেশি সচেতন হয়ে উঠেছেন বলে জানান তিনি।
আতিয়া মহলের পাশের শিববাড়ি বাজার এখন আগের মতোই স্বাভাবিক। ব্যবসায়ীরাও হয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত। শিববাড়ি বাজারের ব্যবসায়ী জুবায়ের আহমদ জুবেল জানিয়েছেন, আতিয়া মহলের অভিযানের সময় তারা বাজারে আসতে পারেননি। এখন সব কিছু স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু এলাকার মানুষের মনে কিছুটা আতঙ্ক রয়েই গেছে।
আতিয়া মহলের মালিক উস্তার আলী সব ভাড়াটিয়ারা চলে যাওয়ার পর এখন পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন করছেন ভবনটি। তবে এখনো কাজ শুরু করেননি। ইঞ্জিনিয়াররা ভবনটি সার্ভে করেছেন। তারা এখনো কিছুই বলেননি। তাদের পরামর্শ মতো ভবন নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এদিকে আতিয়া মহলের পাশে রয়েছে ৪ তলা আরেকটি ভবন। ওই ভবনে বাসিন্দারা উঠেছেন।
গতকাল আতিয়া মহলের মালিক উস্তার আলী জানিয়েছেন, ভবন নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। ইঞ্জিনিয়ার ভবনটি দেখে গেছেন। তিনি এখনো মতামত দেননি। ইঞ্জিনিয়ারের সিদ্ধান্ত জানার পর পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি। এমজমিন
২৩ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসবি