মুহিত চৌধুরী: ওসমানী মেডিকেল কলেজের আবু সিনা ছাত্রাবাসকে ভেঙ্গে ফেলে সিলেট জেলা হাসপাতাল নির্মাণ করা এবং এটিকে ঐহিত্য হিসেবে সংরক্ষণ করা নিয়ে সিলেটে চলছে তুমুল বিতর্ক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে বিস্তর কথাবার্তা।
একটি পক্ষ বলছেন, এটি একটি পুরনো ভবন ঐতিহ্যের অংশ তাই এই ভবনটি সংরক্ষণ করা উচিত। অন্যদিকে সিলেটের তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা চাচ্ছেন ২৫০ শয্যার ‘সিলেট জেলা হাসপাতাল’ তৈরি করার সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছেন সেটি বাস্তবায়িত হোক।
উভয় পক্ষের বক্তব্য যুক্তি-তর্ক পর্যালোচনা করে আমার নিজের মনেও প্রশ্ন জেগেছে- আমাদের আসলে কিসের প্রয়োজন? ঐহিত্য সংরক্ষণ? না সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য হাসপাতাল?
কেউ কেউ অবশ্য ঐহিত্য সংরক্ষণের বিষয়টিকে আমাদের দেশের আর্ত-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে এটিকে এক ধরনের বিলাসীতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবার মান এখনও অনেক নিম্নে অবস্থান করছে। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের একটি ডাটা অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি ৩০০০ জনের জন্য একটি হাসপাতাল বেড রয়েছে।
আট জনের মধ্যে একজন গর্ভবতী নারী ডাক্তারি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ব্যক্তির নিকট প্রসবকালীন সেবা গ্রহন করেন এবং এবং মোট গর্ভবতী মায়ের অর্ধেকেরও কম গর্ভকালীন স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেন। স্বাস্থ্য সেবায় সকলের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার কারনে বর্তমানে মাতৃ যত্নে বৈষম্যতা কমেছে। বাংলাদেশে প্রতি ১,০০০ জীবন্ত বাচ্চা প্রসবে ৮জন ধাত্রী থাকে এবং গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে প্রতি ১১০জন এ ১জনের।
হাসপাতালের অপ্রতুলতার কারনে এখনও আমাদের মা বোনদেরকে রাস্তার মধ্যে সন্তান প্রসব করতে হয়।
২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে এধরনের একটি লজ্জাজনক ঘটনার জন্ম হয়েছিলো। পারভীন নামের এক যুবতিকে ঢাকার রাস্তায় সন্তান প্রসব করতে হয়। প্রসব ব্যথা নিয়ে হতদরিদ্র পারভীন গিয়ে ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।পারভীনের সন্তান স্বাভাবিকভাবে পৃথিবীতে আসছে না। প্রয়োজন পড়বে সিজারের। কিন্তু সিজারের জন্য টাকার প্রয়োজন। টাকা নাই তাই ঢাকা মেডিকেল স্টাফরা ব্যথায় কাতর পারভীনকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যেতে পরামর্শ দেয়।
কয়েকজন পথচারী হতদরিদ্র পারভীনকে সেখানে নিয়ে যায়। দেড় হাজার টাকা দিতে না পারায় সেখান থেকেও বিনা চিকিৎসায় চলে আসতে হয় পারভীনকে। পথচারী লোকটি এবার তাকে নিয়ে যান আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু কার্ড কিংবা রেজিস্ট্রেশন না থাকার অজুহাতে সেখানেও তাকে ভর্তি করা হয়নি। ব্যথায় কাতর পারভীন শেষ পর্যন্ত রাস্তায় প্রসব করেন তাঁর সন্তান। তবে সে সন্তান জন্মের মিনিট খানেকের মধ্যেই মারা যায়।
এবার ভাবুন দেশের স্বাস্থ্য সেবার অবস্থা নিয়ে। যে দেশে মাত্র দেড় হাজার টাকার অভাবে জন্মের পরপরই মৃত্যুবরণ করতে হয় নবজাতক সন্তানকে! সে দেশে ঐহিত্য সংরক্ষণ নামক বিলাসিতার কারনে হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধ রাখার দাবী শিশুসুলভ বাচালতা ছাড়া আর কী হতে পারে।
সিলেটে হাসপাতাল নির্মাণের কথা প্রয়োজন তা সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গেলেই বোঝা যাবে।এই হাসপাতালের কোথায় তিল ধারণের ঠাঁই নেই।
বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে প্রাচীন স্থাপনা সংরক্ষণের জন্য আইন রয়েছে বিশেষ করে ব্রিটেনে রানী ভিক্টোরিয়ার আমলে তৈরি করা সকল ভবন সংরক্ষণ করা করা হয়। এখন আমরা যদি ব্রিটেনের সামাজিক অবস্থা, মানবিক মূল্যবোধ, মানব অধিকার, এ সকল বিষয়গুলো নিয়ে পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো আমাদের থেকে তারা কতটা এগিয়ে আছে।
আমাদের স্বাস্থ্য সেবার মান এবং সুযোগ যদি ব্রিটেন কিংবা ভারতের মতোই হত তা হলে নির্দ্বিধায় এই ভবনটি সংরক্ষণের স্বপক্ষে অবস্থান নেয়া যুক্তিযুক্ত হতো।
প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২৫০ শয্যার ‘সিলেট জেলা হাসপাতাল’ ভবন নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি। বর্তমানে কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। হঠাৎ করে এর বিরোধিতা কেন? যারা ভিন্নমত পোষণ করছেন তারা যদি এটি শুরুতে করতেন তাহলে হয়তো বিকল্প একটি স্থান নির্ধারণের সুযোগ থাকতো।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন সিলেট জেলা হাসপাতালের কাজ বন্ধ হয়ে গেলে এর জন্য যে বরাদ্দ সেই অর্থ চলে যাবে সুতরাং পরবর্তীতে এই হাসপাতাল নির্মাণ অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে যা কারোই কাম্য নয়।
যারা এই হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করছেন তারা বলছেন সিলেটে কোন জাদুঘর নেই তাই আবু সিনা ছাত্রাবাসের ভবনে একটি জাদুঘর নির্মাণের ও প্রস্তাব দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কে নিয়ে এসে তাঁর নামে জাদুঘর নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী তাদের এই প্রস্তাবে সবুজ সংকেত দিয়েছেন যদিও তিনি ইতোপূর্বে হাসপাতাল নির্মাণের পক্ষে অটল ছিলেন। জাদুঘর নির্মাণের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে সেটি সিলেটের অন্য কোন স্থানে হতেই পারে অথবা স্মৃতি হিসেবে আবু সিনা ছাত্রাবাসের আংশিক অক্ষুন্ন রেখে জেলা হাসপাতাল নির্মাণ করা যেতে পারে। তবে এই যাদুঘর কেন সাবেক অর্থমন্ত্রী নামে করার প্রস্তাব করা হলো এনিয়েও অনেকের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। সিলেটে জাদুঘর নির্মাণের দাবী নতুন কোন বিষয় নয়। ১৯৭৭ এবং ১৯৭৮ সালে সিলেটে জাদুঘর নির্মাণের দাবী উঠে। দাবীর প্রেক্ষিতে তৎকালীন সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের সচিব এবিএস সফদর জাদুঘরের জায়গা খুজতে সিলেট সফরে আসেন।
এসময় সিলেট বিভাগীয় মিউজিয়াম কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন সাপ্তাহিক সিলেট সমাচার পত্রিকার সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ খান। তিনি মিউজিয়ামের জন্য বাজেটে বরাদ্দ দেবার নিমিত্তে অর্থমন্ত্রনালয়ে পত্র প্রেরণ করেন। ২০০৬ জাসাসের পক্ষ থেকে সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের কাছে দেওয়ান মাহমুদ রাজা জাদুঘর নির্মাণের দাবী তোলে ধরেন।
জনগুরুত্ব বিবেচনায় পৃথিবীর অনেক কিছুই ওলট-পালট করা হয়েছে বহুবার। ইতিপূর্বে সিলেট শহরের অনেক হেরিটেজ ধ্বংস করা হয়েছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে- আমাদের নগরীর শিবগঞ্জ সাদিপুর সৈয়দ হাতিম আলি হাই স্কুল যেখানে রয়েছে সেখানে সিলেটের প্রথম রায়বাহাদুর ও একমাত্র রাজা খেতাব প্রাপ্ত গিরিশ চন্দ্রে রায়ের বেশ কিছু ভবন ছিল তারমধ্যে দেবতাঘর, রঙ্গশালা এবং একটি সুদৃশ্য গেইট ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ১৯৭৪ সালে এসব ভবন ভেঙ্গে এখানে স্কুল নির্মাণ করা হয়। আর চুন সুড়কির তৈরি প্রাচীন গেইটটি ১৯৮৫ সালে ভেঙ্গে ফেলা হয়।
১৯৪৭ সালে তৈরি কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের ভবনটিও ভেঙ্গে ইতোমধ্যে বহু তলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
পীর মহল্লায় হযরত শাহজালাল (র.)-এর সময়ের তৈরি মসজিদটি প্রয়োজনের তাগিদে ভেঙ্গে ফেলে সেখানে নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয় হযরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে যে প্রাচীন গেইট ছিল সেটিও ভেঙ্গে সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান সেখানে নতুন একটি গেইট নির্মাণ করেন।
আমরা যদি সারা দেশের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাবো এ ধরনের হাজার হাজার প্রাচীন স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনের তাগিদে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেট কিছুটা অবহেলিত সুতরাং হেরিটেজ এর কথা বলে গণমানুষের স্বার্থের এই হাসপাতালটি নির্মানের সুযোগ হাতছাড়া করা কোন অবস্থাতেই সুচিন্তিত কর্ম নয়।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক সিলেট ডটকম ও সভাপতি, সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাব।