বৃহস্পতিবার, ০১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০৬:০০:৫৯

'আমার সদ্যোজাত মেয়েকে হয়ত এই চক্রই পাচার করেছিল'

'আমার সদ্যোজাত মেয়েকে হয়ত এই চক্রই পাচার করেছিল'

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কিছু সন্তানহারা দম্পতি অভিযোগ করেছেন ওই রাজ্যে সদ্যোজাত শিশুপাচারের যে বড় চক্রের হদিশ পাওয়া গেছে তারাই সম্ভবত তাদের সদ্যোজাত শিশুদের পাচার করে দিয়েছে।

সিআইডির কাছে দায়ের করা এধরনের অভিযোগে এসব দম্পতি বলেছেন বিশেষত যেসব চিকিৎসক বা নার্সিং হোম এই চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে খবর বেরচ্ছে, সেইসব চিকিৎসকের হাতে বা নার্সিং হোমেই তাদের সন্তান প্রসব হয়েছিল আর সে কারণেই তাদের মনে এই ধারণা দৃঢ় হচ্ছে।

এরকমই একজন দম্পতি, উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার মসলন্দপুরের বাসিন্দা আশিষ সরকার এবং কানন সরকার। মিঃ সরকার সিআইডি-র কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন যে ওই চক্রে জড়িত সন্দেহে ধৃত তপন বিশ্বাস নামের কথিত ডাক্তার তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর চিকিৎসা করেছিলেন এবং তার হাতেই মিসেস সরকার সন্তানের জন্ম দেন।

সংবাদপত্রে মিঃ বিশ্বাসের আটক হওয়ার খবর দেখেই তিনি সিআইডি-কে গোটা ঘটনা জানিয়েছেন।

"আমার স্ত্রী যখন সন্তানসম্ভবা ছিলেন, তখন একজন চিকিৎসক তাকে দেখছিলেন। কয়েকবার আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করা হয়েছিল। পেটের বাচ্চা আর আমার স্ত্রী দুজনেই সুস্থ আছে বলে সেই ডাক্তার জানিয়েছিলেন," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন আশিষ সরকার।

"কিন্তু আমার একজন আত্মীয়ের দুটি সন্তানই প্রসব করায় তপন বিশ্বাস নামের এক ডাক্তার। তাই তাকে আমাদের বাড়িতেও নিয়ে এসেছিলাম স্ত্রীকে পরীক্ষা করাতে। সেটা ২০১৪ সালের মাঝামাঝি।"

প্রসবের নির্ধারিত দিনের বেশ কয়েকদিন আগেই মিসেস সরকারের মাঝরাতে হঠাৎ করে বেদনা ওঠে বলে জানান মি. সরকার।

"পরিবারের লোকেরা তপন বিশ্বাস নামের ওই কথিত ডাক্তারকে ডেকে আনে। সে বাড়ি থেকে অনেক দূরের একটি ছোট নার্সিং হোমে নিয়ে গিয়ে প্রসব করায়।"

সদ্যোজাত শিশুকন্যা এবং তার মা - দুজনেই সুস্থ ছিল, তবে পরের সকালে এক শিশু বিশেষজ্ঞকে দেখানো হয় বলে তিনি জানান।

মি. সরকারের কথায়, "সেই ডাক্তারই প্রথম বলে যে বাচ্চার হার্টে সমস্যা আছে, কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। যে তপন বিশ্বাস ধরা পড়েছে পুলিশের কাছে, তাকে সঙ্গে নিয়েই আমার আত্মীয়রা আর স্ত্রী রওনা হয় কলকাতার দিকে।"

তিনি বলেন যতই তাদের বলা হচ্ছিল বাচ্চাকে কলকাতায় শিশুদের বড় সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে, ততই তারা বেহালা অঞ্চলের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন এবং সেখানে যখন বেশ রাতে তার স্ত্রী পৌঁছন, তখনও একজন ডাক্তার দেখে বলেছিলেন যে শিশুটির কোনও সমস্যা নেই।

"তখন ধৃত তপন বিশ্বাস একজন ডাক্তারকে ডেকে আনেন - এখন জানতে পারছি তার নাম নিত্যানন্দ বিশ্বাস, যিনি বুধবার গ্রেপ্তার হয়েছেন।"

ওড়িশায় কর্মরত মি. বিশ্বাস তখনই সবে কলকাতায় ফিরে হাসপাতালে সরাসরি পৌঁছেছেন।

মি. সরকার জানান ওই দুজন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মি. সরকারের পরিবারকে জানায় সদ্যোজাত শিশুটির হার্টের সমস্যার জন্য তার অপারেশন করতে হবে আর একটা পরীক্ষাও করাতে হবে। বাচ্চা আর তার মাকে হাসপাতালে রেখে দিয়ে বাকিদের বাড়ি চলে যেতে বলা হয় বলে তিনি জানান।

ভোর রাতে মসলন্দপুরে বাড়ি ফিরতেই খবর আসে কলকাতার হাসপাতালে যেতে হবে, বাচ্চার অবস্থা খারাপ হচ্ছে।

"আমি আবার এতটা পথ ফিরে এসে সকাল নটার সময়ে স্ত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। তখনই নার্সদের কাছে জানতে পারি যে আমার সদ্যোজাত মেয়েটা নাকি রাত বারোটায় মারা গেছে! অথচ তার আধ ঘন্টা আগে আমরা হাসপাতাল থেকে বেরিয়েছি। হাসপাতাল আমাদের কিছুই জানায় নি। নার্স বলেছেন ডাক্তার নিত্যানন্দ বিশ্বাসকে নাকি তারা জানিয়ে দিয়েছিলেন। অথচ আমরা কোনও খবর পেলাম না," বলছিলেন আশিষ সরকার।

মি. সরকারের সন্দেহ তার স্ত্রীকে ঘুমের ইঞ্জেকশান দেওয়া হয়েছিল আর তিনি ঘুমিয়ে পড়ার পরেই জীবিত কন্যসন্তানটিকে পাচার করে মৃত শিশুর দেহ রেখে দেওয়া হয়।

যে মৃত শিশুটিকে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, তাকে দেখে মি. সরকারের পরিবারের তখনই সন্দেহ হয়েছিল যে একদিন বয়সের শিশু ওটি নয়। কিন্তু পুলিশের কাছে জানালে যদি আবার তাদেরই উল্টে হয়রান হতে হয়, সেই আশঙ্কায় তারা কোনও অভিযোগ দায়ের করেন নি বলে বিবিসি বাংলাকে জানান মি. সরকার।

সদ্যোজাত সন্তান মারা যাওয়ার দুবছরেরও বেশি সময় পর কেন সিআইডি-র কাছে অভিযোগ জানালেন - এই প্রশ্নের জবাবে মি. সরকার বলেন, "এখন তো টিভি-তে আর খবরের কাগজে সব বেরচ্ছে - এই চক্রটা কীভাবে কাজ করত । তখনই মনে হল যে আমাদের সঙ্গেও তো ঠিক এই ঘটনাই হয়েছিল। তারপরে যখন তপন বিশ্বাসকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দেখলাম, তখনই আমার মনে হল সিআইডি-কে জানানো দরকার।"

"আমাকে সিআইডি দপ্তরে ডেকে পাঠিয়েছিল। তপন বিশ্বাসকে শনাক্তও করে এসেছি আমি। আমার সামনেই তিনি সিআইডি-র কাছে স্বীকার করেছেন যে আমার বাচ্চাটাকে তিনি পাচার করে দিয়েছিলেন।"

বেহালার মোহনানন্দ ব্রহ্মচারী শিশু সেবা প্রতিষ্ঠানের সুপারিনটেন্ডেট সুনীল নাগ সাংবাদিকদের কাছ স্বীকার করেছেন তিনি ঘটনা যথাযথ যাচাই না করেই শিশুটির ডেথ সার্টিফিকেটে সই করেছিলেন।

মি. আর মিসেস সরকার এখন চান আড়াই বছর আগে তাদের ঘরে জন্ম নেওয়া সন্তানটিকে ফিরে পেতে।

কিন্তু তাদের শিশুকন্যাকে কোথায় পাচার করে দেওয়া হয়েছে বা কার কাছে দত্তকের জন্য দিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটা খুঁজে বার করা এবং পরিবারের সঙ্গে সেই বাচ্চাটির ডিএনএ মেলে কীনা সরকারের তা খতিয়ে দেখে বাচ্চাটিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

যে এলাকা থেকে প্রথম সদ্যোজাত শিশু পাচার চক্রের সন্ধান পায় সি আই ডি, সেই বাদুড়িয়া আর মসলন্দপুর অঞ্চলের আরও কিছু দম্পতি মি. সরকারের মতোই অভিযোগ করছেন যে তাদের সন্তানও হয়তো পাচার করে দিয়েছে এই চক্রটি। বিবিসি বাংলা

১ ডিসেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে