আন্তজার্তিক ডেস্ক : রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার ঘটনায় বিশ্ব জুড়ে প্রচণ্ড চাপের মুখে রয়েছেন দেশটির নেত্রী অং সান সু চি। রোহিঙ্গা নিধনকে ‘মানবিক বিপর্যয়’ও ‘পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্থনিও গুটেরেস।
তিনি মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নিপীড়ণ বন্ধ করে রাখাইন রাজ্যে তাদের নিজ নিজ বাসস্থানে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। গত মাসের ২৫ তারিখ থেকে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা সহিংসতায় ৪ লাখের বেশি মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এ ঘটনায় সুচির ওপর ক্রমান্বয়ে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। এরই প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল করেছেন তিনি।
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংস্থা এবং বিশ্ব নেতাদের কোনো আহ্বানেই সাড়া দিচ্ছেন না সু চি। এ ধরনের সমালোচনাকে পাত্তা দিচ্ছে না তার দল ন্যাশনাল লীগ অব ডেমোক্রেট পার্টিও। সামরিক যুগের মতই তারা পাশবিকভাবে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যূত করা অব্যাহত রেখেছে।
এই পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে এখনও কোনো মন্তব্য করেননি সু চি। এমনকি যেসব স্থানে মুসলিম সংখ্যালঘুরা বৌদ্ধ ও সেনাদের হামলার স্বীকার হয়েছে সেগুলো পরিদর্শনেও যাননি। বিরত রয়েছেন সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করা থেকেও। তার এই নীরবতার পিছনের কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে ভারতের সংবাদ বিশ্লেষকধর্মী দৈনিক ‘ডেইলি ও’।
১.রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতার অভাব: ডেইলি ও মনে করছে, মিয়ানমারের এই জনগোষ্ঠীর প্রতি কোনোরকম মমতা অনুভব করেন না মিয়ারমান নেত্রী অং সান সুচি। যে কারণ একবারও তিনি এ সহিংসতা নিয়ে কোনোই মন্তব্য করেন নি। ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের সময়ও রাখাইনের সহিংসতা সযতনে এড়িয়ে গেছেন সু কি। নির্বাচনের আগে আগেই রাখাইনদের ওপর ব্যাপক পাশবিকতা চালিয়েছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।
২.দলে সমালোচনার আশঙ্কা: অং সান সুচি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিজ দলকে প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। তার দল এনএলডি কখনই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা মনে করেন, রোহিঙ্গারা তাদের দেশের নাগরিক নয়। তারা বহিরাগত বাঙালি। তাই তাদের মিয়ানমারে থাকার কোনো অধিকার নেই। যদিও কয়েক শ বছর ধরে তারা সেখানেই বসবাস করছে।
গতবছর মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিয়ানমার সফরের সময় তিনি সংখ্যালঘু এই গোষ্ঠীটিকে রোহিঙ্গা বলে উল্লেখ না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং সু চি। সুচির দল মনে করে, সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে গিয়ে রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা বললে এতে দলটির রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই। বরং ক্ষতি হবে। যে কারণে ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে একটি আসনেও কোনো মুসলিম প্রার্থী দেয়নি এনএলডি।
৩. বৌদ্ধ জাতীয়বাদীদের সঙ্গে বিরোধের আশঙ্কা: মিয়ানমারে বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দিনে দিনে জোরদার হচ্ছে। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী এ সংক্রান্ত এক গবেষণায় দেখেছেন, দেশটির নিম্ন পর্যায় থেকেই শুরু হয়েছে অর্থ সামাজিক আন্দেলন। বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা কায়দা করে তরুণ বৌদ্ধদের মধ্যে ছড়াচ্ছেন জাতিগত বিদ্বেষ। যদিও এইসব গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সু চি’র কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এসব ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে তিনি সমর্থন না করলেও তাদের সঙ্গে বিরোধী জড়াতে রাজি নন সু চি। এজন্যই সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা নিধন সম্পর্কে মুখে তালা এঁটেছেন মিয়ানমার নেত্রী।
৪. সেনাবাহিনীর ওপর সীমিত প্রভাব: মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর সু চি’র তেমন কোনো প্রভাব নাই বললেই চলে। দেশে গণতন্ত্রের দাবিতে দীর্ঘদিন কারাবন্দি থাকা সু চি’কে বিশ্বাস করে না সেনাবাহিনী। একই সঙ্গে তিনি এটাও বিশ্বাস করেন যে, রাখাইনের মুসলমানদের ওপর তার দেশের সেনারা যে বর্বরতা চালাচ্ছে তা বন্ধ করার কোনো ক্ষমতা তার নেই। তিনি হলেন সরকারের ডি ফেক্টো নেতা।
অনেক ক্ষমতা এখনও সেনাপ্রধান মিন অং হিলায়িং’র হাতে যিনি সু চি সরকারের গৃহীত যে কোনো সিদ্ধান্তকে বাতিল করতে পারেন। মিয়ানমারের সংবিধান দেশটির সেনাবাহিনীকে সামরিক বাজেট প্রণয়নসহ যে কোনো নিরাপত্তা ইস্যুতে মন্ত্রীদের চাইতে বেশি ক্ষমতা দিয়েছে। তারওপর পার্লামেন্টের ২৫ ভাগ আসন সেনাবাহিনীর হাতে। এই অবস্থায় সু চি সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইছেন না। প্রকারন্তরে তিনি সামরিক নেতোদের এক প্রকার সমীহই করে থাকেন। তাই তার দলের বেশির ভাগ নেতারা রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিয়ে চিন্তিত নয়।
৫. সু চির একগুয়েমি: দীর্ঘদিন সু চি’কে নিয়ে কাজ করেছেন বিবিসি’সাংবাদিক ফেরগাল কিয়ানে। তিনি বলছেন, সু চি কোনো বিদেশি সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। গত ডিসেম্বরে মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি বিজয় নামবিয়া অং সান সু চি’কে রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনের দাবি জানালে তা প্রত্যাখান করেছিলেন মিয়ানমার নেত্রী।
এ সম্পর্কে তার এক উপদেষ্টা বলেছেন, তাদের নেত্রী বাইরের কারো নির্দেশ শুনতে পছন্দ করেন না। তার এই একগুয়েমি রাখাইনের সংখ্যালঘুদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু তার মনে থাকার কথা একসময় সু চি যখন গৃহবান্দি ছিলেন, জাতিসংঘসসহ বিভিন্ন অধিকার গোষ্ঠী এবং বিশ্ব নেতারা তাকে সমর্থন দিয়েছেন কয়েক দশক ধরে। তার মুক্তির জন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ওপর চাপ প্রয়োগ করেছেন। আজ সেই বন্ধুদের কথাই অগ্রাহ্য করছেন অতীত বিস্মৃত সুচি। পূর্বপশ্চিম।
এমটিনিউজ/এসএস