মঙ্গলবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০২:৩১:৫৫

আরসা’র এই লড়াই রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই!

আরসা’র এই লড়াই রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : মিয়ানমারের রাখাইনের  একটি গ্রামের মসজিদে ইমাম হিসেবে দাহিত্বরত ছিলেন নাজির হোসেন। গত মাসের এক সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের সময় মুসল্লিদের নিয়ে জড়ো হয়েছিলেন। কয়েক ঘণ্টা পর এই গ্রাম থেকেই আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) বেশ কয়েকজন সদস্য হাতে তৈরি অস্ত্র দিয়ে পাশের একটি পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালায়।

তিনি বলেন, ‘একজন ইমাম হিসেবে আমি তাদের অনুপ্রেরণা দেই, যেন তারা লক্ষ্য থেকে সরে না যায়। আমি তাদের বলি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যদি তোমরা লড়াই চালিয়ে না যাও, তাহলে সেনারা গ্রামে আসবে এবং তোমাদের পরিবার, স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করবে।’

সংগঠনটির কয়েকশ সদস্য ২৫ আগস্ট সমন্বিত হামলা চালায় মিয়ানমারের নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর। হামলার পাল্টা আঘাতও এসেছে ভয়াবহভাবে।

চার বছর আগে, শুরুতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে ছোট আকারের প্রতিরোধ গড়ে তোলে আরসা। স্থানীয়ভাবে হারাকাহ আল-ইয়াকিন বা ধর্মীয় আন্দোলন বলে পরিচিত এই আরসা। এরপর তারা মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর দু’টি বড় ধরনের হামলা চালিয়েছে। এ বছরের ২৫ আগস্টের হামলারও আগে গত বছরের অক্টোবরেও বড় একটি হামলা চালায় তারা।

বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গারা সংখ্যালঘু। রোহিঙ্গাদের নতুন প্রজন্ম চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ায় রাখাইনের পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।

মিয়ানমারের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য হচ্ছে রাখাইন।মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে আরসা সদস্যরা নিজেদের সম্প্রদায়ের মানুষকেও নিশানা বানিয়ে ফেলেছে। আর তাতে করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে রোহিঙ্গা উৎখাতের একটি অস্ত্রও তুলে দিয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখন বলতে পারছে, তারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। যদিও সেনা সদস্যরা এই লড়াইয়ের নামে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে, প্রাণভয়ে পালাতে থাকা নারী ও শিশুদের পর্যন্ত গুলি করে হত্যা করছে।

আশঙ্কা করা হচ্ছে, হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া রোহিঙ্গা ছাড়াও সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের শিবিরে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে। রোহিঙ্গাদের স্থানীয় সংগ্রামকে বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কাজে লাগাতে পারে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো।

২৫ বছরের রোহিঙ্গা সশস্ত্র বিদ্রোহী নুর আলম। মংডুর বিভিন্ন গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার পর তার পরিবার আশ্রয় নিয়েছে মিয়ানমারের জঙ্গলে। তার ভাষ্য, ‘এই সংগ্রাম শুধু আমার বা আমার নিজের পরিবারের জন্য নয়। এই লড়াই রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার। আমাদের শিশুরা যদি শান্তিতে বেড়ে উঠতে পারে, সেটার জন্য জীবন দিতে হলেও আমরা তা দিতে রাজি।’

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রায় অর্ধ-শতাব্দী দেশটি শাসন করেছে। রোহিঙ্গাদের উৎখাত ও নির্মূল করতে পরিকল্পিত উপায়ে দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বও বাতিল করা হয়েছে।

গত বছর থেকে দেশটিকে নেতৃত্ব দেওয়া অং সান সু চি’র বেসামরিক সরকার রাখাইনে চলমান সহিংসতায় সেনাবাহিনীর পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। সু চি সরকারের দাবি, সেনাবাহিনী ‘চরমপন্থী বাঙালি সন্ত্রাসী’দের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছে। ইতিহাস অনুযায়ী রোহিঙ্গারা অনেক আগে থেকেই রাখাইনে বাস করলেও মিয়ানমার সরকারের দাবি, রোহিঙ্গারা সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী।

ব্যাংককভিত্তিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ফরটি রাইটস’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা ম্যাথিউ স্মিথ বলেন, ‘চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ার এই ঝুঁকি নিয়ে আমরা গত কয়েক বছর ধরেই আলোচনা করছি। আমাদের দৃষ্টিতে চরমপন্থা ও উগ্রবাদের ঝুঁকি থামানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে রোহিঙ্গাদের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সেটি করছে না।’

আরসার বিরুদ্ধে হিন্দু বা বৌদ্ধদের মতো রাখাইনের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীদের হত্যার অভিযোগ রয়েছে। মিয়ানমার সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২৫ আগস্টের পর থেকে ৩৭০ রোহিঙ্গা সদস্যর পাশাপাশি অন্তত ১২ জন অ-রোহিঙ্গা বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে।

বাংলাদেশে ঘনবসতিপূর্ণ রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা নিজেদের উগ্রবাদী মনোভাব লুকিয়ে রাখছে না। গত অক্টোবরে হামলার পর মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের পাহাড়ি জঙ্গলে তিন মাস লুকিয়ে ছিল ৩২ বছর বয়সী মাদ্রাসা শিক্ষক ও আরসা সদস্য আবুল ওসমান। তার ভাষায়, ‘আমি যদি বাড়িতেও থাকি, তাহলে সেনাবাহিনী আমাকে হত্যা করতে পারে। ফলে অধিকারের জন্য লড়াই করে মৃত্যুই শ্রেয়, যেমন আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ। আমার আত্মত্যাগ আমাকে বেহেশতে পৌঁছে দেবে।’

বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবির ও রাখাইনের অবরুদ্ধ গ্রামগুলোতে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা মানবেতর পরিস্থিতিতে দিন কাটাচ্ছে। এ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর কর্মী সংগ্রহের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। গত সপ্তাহে কোনও কোনও আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করলেও এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার নয়।

ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর ইসলামি জঙ্গিবাদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি কিভাবে গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলোকে জঙ্গিরা কুক্ষিগত করেছে। আইনি অধিকার না থাকা, কয়েক হাজার মানুষের বেপরোয়া ও বিপর্যস্ত মনোভাব, উগ্রবাদী আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা, সংঘর্ষে জড়িত পক্ষের শক্তির ভারসাম্যহীনতা ও ধর্মীয় দিক— সবমিলিয়ে সংকটটি উগ্রবাদের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করছে।’

দক্ষিণ ফিলিপাইনের কথা উল্লেখ করে আলী রীয়াজ জানান, স্থানীয় একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামিক স্টেট (আইএস) নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে, বিদেশি সদস্যদের স্থান দিচ্ছে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার সরকার কিংবা আঞ্চলিক শক্তিগুলোর রোহিঙ্গাদের এমন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া উচিত হবে না।’

জানা যায়, আতাউল্লাহ নামের এক রোহিঙ্গা ব্যক্তির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় আরসা। আতাউল্লাহর জন্ম পাকিস্তানে, বেড়ে ওঠা সৌদি আরবে। তবে এই মুহূর্তে আরসার কাছে খুব বেশি আগ্নেয়াস্ত্র নেই, যা এশিয়ার অন্যতম বড় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। ২৫ আগস্টের হামলায় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা অংশ নিয়েছে। কিন্তু মাত্র এক ডজনের মতো নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যকে হত্যা করতে পেরেছে তারা। এর আগে, গত বছর অক্টোবরের হামলায় আরসা ৯ পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছিল।

বিপরীতে মিয়ানমারের অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠী যারা কয়েক দশক ধরে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তাদের হামলা ছিল অনেক বেশি সহিংস। সেনাবাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, রাখাইনের আরাকান আর্মি গত বছর প্রথম ছয় মাসে অন্তত ৩শ সেনাকে হত্যা করে। তবে আরাকান আর্মি বা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর জঙ্গি দলগুলোকে আরসার মতো সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেনি মিয়ানমার সরকার।

বাংলাদেশে বসবাসকারী বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক রোহিঙ্গা দিল মোহাম্মদ (আগের নাম) জানায়, ‘‘বার্মা (মিয়ানমার) কেন আমাদের সন্ত্রাসী বলতে যাবে? একটি শব্দই যথেষ্ট: ‘ইসলাম’।’’

চার বছর আগে রোহিঙ্গা ও রাখাইন জাতির মধ্যে সংঘর্ষের জের ধরে আরসা গঠিত হয়। ওই সময় কয়েকশ মানুষ নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগ ছিল মুসলমান। এরপর থেকেই অনেক রোহিঙ্গাকে তাদের গ্রাম ছাড়তে বাধা দেওয়া হয়। ওই সময় তরুণদের জন্য কোনও কাজের ব্যবস্থা ছিল না। মসজিদ ও মাদ্রাসা গুঁড়িয়ে দেয় সেনাবাহিনী।

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা আরসার সদস্যদের মতে, গত অক্টোবরে হামলার পর সেনাবাহিনীর বড় ধরনের অভিযান ছিল আরসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাঁক বদলের সময়। এরপর থেকে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি রোহিঙ্গা গ্রামে আরসার অন্তত ১০ সদস্যের শাখা রয়েছে।

আরসা সদস্যদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, হামলার সময় আরসা বিদ্রোহীরা সাধারণত কালো পোশাক পরে এবং উচ্চস্বরে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে নিজেদের অনুপ্রাণিত করে। শপথ নেওয়ার সময় সদস্যরা অঙ্গীকার করে যে, তারা যদি শহীদ হয় তাহলে তাদের পরিবার আপত্তি করবে না।

অস্ত্রের অভাব, ঘরে তৈরি বিস্ফোরক, ভোঁতা ছুরি— রোহিঙ্গা সদস্যদের এমন মৃত্যুর সুযোগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

রোহিঙ্গা মোহাম্মদ জালালের এক জ্ঞাতি ভাই তাদের গ্রামের আরসা প্রধান। জালাল জানায়, এখনও তার ভাই রাখাইনে যুদ্ধ করছে। লক্ষ্যের জন্য সে তার ছেলেকেও ছেড়ে যেতে প্রস্তুত। জালালের ভাষায়, ‘এটি বিপজ্জনক। কিন্তু সে যদি তার মানুষ ও ভূমির জন্য মারা যায়, তাহলে এটি আল্লাহর ইচ্ছা।’

জালালের পাশে বসা ১০ বছরের হারুন এই কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে সায় বলে, ‘আমিও যুদ্ধে যাব। আমি ভীত নই।’
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে