মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৯, ০৪:২৪:৩১

যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত আইএসের সন্ত্রাসের নতুন অধ্যায় শুরু

যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত আইএসের সন্ত্রাসের নতুন অধ্যায় শুরু

টিম লিস্টার : মাত্র ৫৯ সেকেন্ডের একটি ভিডিও। তাতে আটজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে। তারা হাত একত্রিত করেছে। আনুগত্য দেখাচ্ছে ‘বিশ্বাসীদের আমীরের’ প্রতি এবং মুসলিম খেলাফতের প্রতি। খবর সিএনএন অনলাইনের।

শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ এক সিরিজ হামলা চালাতে যাচ্ছিল তারা। ওই সিরিজ হামলায় কমপক্ষে আড়াই শত মানুষের প্রাণ গিয়েছে। একই সঙ্গে তারা যেন এই ঘোষণা দিয়েছে, বৈশ্বিক হুমকি হিসেবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া থেকে আইসিস বা আইএস অনেক দূরে। 

হামলার কয়েক দিনের মধ্যেই আইসিসের অনলাইন প্রকাশনা আল নাবা যেন হুংকার দিলো নতুন এলাকায় তাদের খেলাফতের ব্যানারের বিষয়ে। এই ভিডিওটি প্রকাশ করে আইসিস সংশ্লিষ্ট একটি বার্তা সংস্থা।

শ্রীলঙ্কা হামলার নেপথ্যে থাকা সংগঠন সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানার আছে। কিন্তু সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষজ্ঞরা একটি বিষয়ে একমত। তাহলো, বাইরের সহায়তা ছাড়া এত জটিল একটি হামলা কিছুতেই ইসলামপন্থি একটি ছোট গ্রুপের পক্ষে চালানো সম্ভব নয়। 

কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনে সন্ত্রাসবিরোধী বিশ্লেষক ব্রুস হফম্যান বলেন, রোববারের ওই হামলাগুলো কোনো চরমপন্থি গোষ্ঠীর জন্য সাংগঠনিক ও যৌক্তিক দক্ষতা পরিমাপের একটি আদর্শিক উত্থান হিসেবে দেখা যেতে পারে। 

এর ফলে বেশ কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। তাহলে কি সফলতার সঙ্গে আইসিস বোমা তৈরির কারিগরদের বা বিশেষজ্ঞদের অন্যত্র স্থানান্তর করছে, তারা কি সফলতার সঙ্গে অর্থ সংগ্রহ করছে এবং যেখানে তাদের মূল ভূমি ছিল তা থেকে অনেক দূরে সদস্য সংগ্রহ করছে? তারা এত উর্বরতা কোথায় পাচ্ছে? কিভাবে মূল ভূমি থেকে এত দূরে একটি হামলা সংগঠিত করা ও পরিচালনা করতে এতটা সক্ষম হচ্ছে আইসিসের কেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিরা? 

দূরে সরে যাওয়া

আইসিসের সর্বশেষ অবস্থান নিয়ে রিপোর্ট করতে প্রায় দুই মাস সিরিয়ার উত্তরে বাঘোজে অবস্থান করছিলেন সিএনএনের সিনিয়র আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রতিনিধি বেন ওয়েডেম্যান। 

তিনি বলেছেন, আরেক স্থানে যুদ্ধ করতে অনেক জঙ্গি, হতে পারে শত শত পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) যখন বাঘোজ ঘিরে ফেললো তখন পালিয়ে যাওয়ার প্রচুর সুযোগ ছিল। তুলনামূলকভাবে এসডিএফ যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল অনেক কম। আর যে এলাকা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে তা ছিল অনেক বড়।

অনেকে এখনও ইরাক ও সিরিয়ায় আন্ডারগ্রাউন্ডে আছে। আমরা ইরাকের আইসিসকে পরিবর্তিত রূপে নিম্ন মাত্রার বিদ্রোহ বা জঙ্গিপনা হিসেবে এরই মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। তারা অ্যাম্বুস করছে। এ বছর সুন্নি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে সরকারি বাহিনী ও শিয়া যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে হত্যা মিশন চালিয়েছে। এ বছরের শুরুতে জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রাদেশিক পর্যায়ে সেলুলার অবকাঠামোতে গড়ে তোলা হয়েছে এই নেটওয়ার্ক। তাতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মূল কার্যক্রম যেন প্রতিফলিত হচ্ছে। 

জানুয়ারিতে আইসিসের একটি স্লিপার সেল সিরিয়ার মানবিজে আত্মঘাতী একটি হামলা চালাতে সক্ষম হয়। তাতে চারজন মার্কিনি সহ কমপক্ষে ১৪ জন নিহত হয়েছেন। গত সপ্তাহেই আইসিস যোদ্ধারা পালমিরার কাছে মরু এলাকায় আল কাওমে একটি বিস্ময়কর হামলা চালিয়েছে। ১৯৯৬ সালে আল কায়েদায় যোগ দিয়েছিলেন আমিন দিন। তিনি এখন বৃটিশ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য একটি বড় সম্পদে পরিণত হয়েছেন। 

আমিন দিন সিএনএনকে বলেছেন, তার হিসাবে এখনও ওই এলাকায় প্রায় ৫০০০ আইসিস যোদ্ধা পলাতক অবস্থায় অবস্থান করছে। তবে বেশির ভাগ হিসাব বলে যে, শত শত না হয়ে হাজার হাজার আইসিস যোদ্ধা ও পরিকল্পনাকারী ২০১৭ সালে রাকা ও মসুলে তাদের পরাজয়ের পর খেলাফত ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গিয়েছে। 

জাতিসংঘে আইসিস/আল কায়েদা/তালেবান মনিটরিং টিমের সমন্বয়ক এডমুন্ড ফিটন-ব্রাউন বলেন, কি পরিমাণ আইসিস যোদ্ধা মারা গেছে আমরা জানি না। তবে আমরা মনে করি, এখনও কমপক্ষে শতকরা ৫০ ভাগ যোদ্ধা জীবিত আছে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অনুমান এর চেয়ে বেশি হবে। 

গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছেন, অনেকে ইরান হয়ে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে অথবা আফগানিস্তানে চলে গেছে। তাদের প্রপাগাণ্ডা বলে দেয় যে, আইসিস ভারতকে তাদের প্রতিশ্রুত ভূখণ্ড হিসেবে দেখছে এবং সেখানে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে উত্তেজনার দিকে তাদের দৃষ্টি রয়েছে। অন্যরা চলে গেছে জর্ডান এবং সৌদি আরবে। 

কলম্বোতে যেদিন সন্ত্রাসী বোমা হামলা হয়, সেই একই দিনে আইসিস আদর্শে উদ্বুদ্ধ হামলা হয়েছে সৌদি আরবে। উপকূলীয় শহর সিরতে থেকে উৎখাত হওয়ার পর লিবিয়ায় আইসিস নেটওয়ার্ক নতুন করে পুনর্গঠিত হচ্ছে। তারা পুনর্গঠিত হয়ে এ বছর লিবিয়ার অন্যান্য গ্রুপের ওপর বেশ কয়েকটি হামলা চালিয়েছে। 

ফিলিপাইনে আইসিস পন্থি একটি গ্রুপ ২০১৭ সালে ৫ মাস ধরে মারাবি শহরের বিভিন্ন অংশ তাদের দখলে রাখে। এ গ্রুপে ছিল বেশ কিছু বিদেশি যোদ্ধা। আমিন দিন বলেন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, মিশর, সৌদি আরব ও জর্ডান- এসব দেশে ফিরে আসা জঙ্গিরা নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। 

খেলাফতের আন্দোলনে বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের প্রতি অনেক উগ্রপন্থি অনলাইন সংগঠন আছে এবং উগ্রপন্থি ধর্ম প্রচারক আছে। তারা তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখায়। খেলাপতের পতন হয়তো আইসিসের আবেদনকে ম্লান করে দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আমরা খেলাফতের শতকরা ১০০ ভাগের বেশি নিয়ন্ত্রণ নিয়েছি।

তবে এটা সুনির্দিষ্ট যে, পুরোপুরি তাদেরকে ধ্বংস করা যায় নি। আইসিসের নেতৃত্ব দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েছে তাদের টিকে থাকার এই নতুন পথ বের করতে। ড্রোন হামলায় আইসিসের মুখপাত্র আবু মোহাম্মদ আল আদনানি মারা যাওয়ার আগে বলেছিলেন, আঞ্চলিক পরাজয়ের অর্থ এই নয় যে আইসিসের খতম হয়ে যাচ্ছে। 

আইসিস ব্যাংকের মাধ্যমে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা পায়। ফিটন ব্রাউনের মতে আইসিসের অর্থের পরিমাণ কমে ৫০ কোটি থেকে ৩০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। অন্যরা মনে করেন এই অঙ্ক আরো বেশি। খেলাফতের রাজস্ব বিনিয়োগ হয়েছে বৈধ ব্যবসা ও অর্থ পাচারে। এসব করা হয়েছে ব্যাংকের মাধ্যমে, মানি লন্ডারদের মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন হলো শ্রীলঙ্কার হামলা নিয়ে। 

বলা হচ্ছে, তাদেরকে কে অর্থ দিয়েছে। আমিন দিন আন্দাজ করেন, ওই অপারেশনে খরচ হয়েছে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার ডলার। এত অর্থ কে দিয়েছে এবং তারা কিভাবে এই অর্থ পেয়েছে? প্রশ্ন রাখেন আমিন দিন। এক সপ্তাহ আগে রিয়াদে একটি হামলার পর সম্প্রতি গড়ে তোলা একটি ভবনে তলাশ্লি চালায় সৌদি কর্তৃপক্ষ। 

আমিন দিনের সূত্র তাকে বলেছেন, ওই ভবনটি নির্মাণে খরচ হয়েছিল প্রায় দুই লাখ ডলার। ওই ভবনে প্রচুর নগদ অর্থ ও অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল। তাই আইসিস নেতৃত্ব এখনো বড় অঙ্কের অর্থ বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব অর্থ ইরাক ও সিরিয়ার বাইরে পাঠানো হয়েছে অবশ্যই। নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার অন্য স্থানে স্থানান্তর করা হয়েছে। আমিন দিন মনে করেন, অর্থের বিষয়টি সংগঠনের ভিতরে কোনো একটি কর্তৃপক্ষ দেখাশোনা করে সব সময়। তিনি বলেন, আইসিস হলো সন্ত্রাসের ব্যাংক।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক সিএনএন। 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে