বিপুল সরকার সানি, দিনাজপুর : রামসাগরের মিনি চিড়িয়াখানায় নীলগাইসঙ্গী পেয়েছে দিনাজপুরের রামসাগর জাতীয় উদ্যানে থাকা মাদি নীলগাইটি। রাজশাহীর বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে পুরুষ নীলগাইটিকে শুক্রবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে এই উদ্যানে আনা হয়েছে। প্রাণী দুটোকে রাখা হয়েছে রামসাগরের মিনি চিড়িয়াখানায়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অন্তত ৮০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া নীলগাইকে আবারও বংশবিস্তারের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা দেখছে এখন বনবিভাগ।
দেশের উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, নওগাঁ, জয়পুরহাট ও আশেপাশের জেলাগুলোতে এক সময় নীলগাইয়ের অবাধ বিচরণ থাকলেও বনাঞ্চল উজাড় হওয়া ও শিকার প্রবণতার কারণে গত দুই শতকে প্রাণীটি আশঙ্কাজনক হারে কমতে থাকে। স্থানীয়দের বর্ণনা অনুযায়ী, গত শতকের পঞ্চাশের দশকে সর্বশেষ পঞ্চগড়ে একবার নীলগাই দেখা যায়। যদিও বাংলাদেশে দুর্লভ, তবে পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর সীমান্তের ওপারে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরসহ সংলগ্ন এলাকাগুলোর ছোট ছোট পাহাড়ঘেরা বনাঞ্চলে এখনও নীলগাই রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু এলাকাকে অভারণ্য ঘোষণা করে নীলগাই সংরক্ষণ করছে ভারত। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ভারতের উত্তরাঞ্চলের হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশ থেকে কর্ণাটক অঞ্চল পর্যন্ত এবং নেপাল ও পাকিস্তানের ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় নীল গাইয়ের দেখা মেলে।চীনেও নীলগাই পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও ও নওগাঁয় গত পাঁচ মাসের মধ্যে যে দুটি নীলগাই ধরা পড়েছে সে দুটো ভারতের সীমান্তবর্তী কোনও এলাকা থেকে এসেছে বলে বনবিদদের ধারণা।বিশেষ করে পুরুষ নীল গাইটি দলছুট হয়ে ভারতের বিহারের গঙ্গা তীরবর্তী এলাকা থেকে চলে এসেছে বলে ধারণা করছেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা।
এ বছরের ২২ জানুয়ারি নওগাঁর মান্দা উপজেলার জোতবাজার এলাকায় ধরা পড়ে পুরুষ নীলগাইটি। তার আগে ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার কুলিক নদীর ধারে স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়ে মাদি নীলগাইটি।
দিনাজপুর সামাজিক বন বিভাগের কর্মকর্তা ও রামসাগর জাতীয় উদ্যানের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুস সালাম তুহিন জানান, নীলগাই বিরল প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী। প্রাণীটি গাই হিসেবে পরিচিত হলেও এটি মোটেও গরু শ্রেণির নয় বরং এটি এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় হরিণ বিশেষ প্রাণী। যার বৈজ্ঞানিক নাম বোসেলাফাস ট্র্যাগোকামেলাস। একশ বছর আগে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় নীল গাই দেখা যেত। এখন আর বাংলাদেশে নীল গাই পাওয়া যায় না। তবে, ১৯৪০ সালের দিকে পঞ্চগড়ে একবার নীলগাই দেখা গিয়েছিল। এরপর বাংলাদেশে আরও কোথাও নীলগাই দেখতে পাওয়া যায়নি। গত ৪ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে মাদি নীলগাইটি ধরা পড়ার আগে বাংলাদেশে একটিও নীলগাই ছিল না। আর নওগাঁয় আরেকটি নীলগাই ধরা পড়ার পর এখন বাংলাদেশে এর সংখ্যা দুটি। এই দুটি নীলগাইকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে। তাদের মিলনের মাধ্যমে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বংশবৃদ্ধির সুখবর আসবে বলে আশা করছি।’
মিনি চিড়িয়াখানায় নীলগাইঅনেক আগেই আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) লাল খাতায় বাংলাদেশে বিলুপ্ত প্রজাতি হিসেবে নীলগাইয়ে নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলেও তিনি জানান।
আব্দুস সালাম তুহিন বলেন, ‘২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বরের আগে বাংলাদেশে এই প্রাণীটি ছিল না। ওই দিন বিকালে ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলায় এটি ধরা পড়ে। নেকমরদ ইউনিয়নের যদুয়ার গ্রামের পাশে বাংলাদেশ-ভারত সীমানায় বয়ে যাওয়া কুলিক নদীর ধারে মাদি নীলগাইটি দেখতে পান জেলেরা। পরে গ্রামবাসী মিলে এই প্রাণীটিকে আটক করেন। তখন গ্রামবাসীর হামলায় আহতও হয় প্রাণীটি। পরে বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন জানতে পারে। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় প্রাণীটিকে উদ্ধার করে পরের দিন দিনাজপুর রামসাগর জাতীয় উদ্যানে আনা হয়। রামসাগর জাতীয় উদ্যানের মিনি চিড়িয়াখানায় চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা হয়। সেই থেকে ৫ মাস ধরে এখানেই আছে মাদি নীলগাইটি।’
আব্দুস সালাম তুহিন বলেন, ‘গত ২২ জানুয়ারি নওগাঁর মান্দা উপজেলার জোতবাজার এলাকায় ধরা পড়ে আরেকটি নীলগাই এবং এটি পুরুষ। প্রাণীটিকে রাজশাহী বন্যপ্রাণী উদ্ধার ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে এনে চিকিৎসা দিয়ে বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন হস্তান্তর করে।’
গত বছর মাদি নীল গাইটি ধরা পড়ার সময় এটি গর্ভবতী ছিল বলে জানানো হয়েছিল।এরপরের খবর কী জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘ মাদি নীল গাইটি ধরা পড়ার সময় এর পেটে বাচ্চা ছিল। তবে অসুস্থতার চিকিৎসা করানোর সময় পেটেই এর বাচ্চাটি মারা যায়।’
তবে এখন যেহেতু মাদি নীলগাইটির বয়স দুই থেকে আড়াই বছর এবং পুরুষটির বয়স তিন থেকে সাড়ে তিনের মধ্যে এবং এরা যেগেতু খোলা অবস্থাতেই গড়ে ১৬ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত বাঁচে তাই অচিরেই প্রাণী দুটো বংশবিস্তারে যাবে বলে আশাবাদী আব্দুস সালাম তুহিন।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, 'নীলগাই দুটি যদি খুব বয়স্ক না হয়ে থাকে তবে তাদের প্রজননের ব্যাপারে আমি আশাবাদী। তাদের যেখানেই রাখা হোক না কেন এই অবস্থায় নীলগাই দুটিকে সুস্থ রাখা জরুরি। তাদের ঠিকমতো খাবার-দাবার দিয়ে যত্নের মধ্যে রাখতে হবে। তবেই তারা প্রজননের দিকে আগাবে।'-বাংলা ট্রিবিউন