বৃহস্পতিবার, ১২ মে, ২০১৬, ০৪:৪৮:৪১

'নামাজ মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের শ্রেষ্ঠ উপায়' (১৭ তম পর্ব)

'নামাজ মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের শ্রেষ্ঠ উপায়' (১৭ তম পর্ব)

ইসলাম ডেস্ক : প্রিয় পাঠক! নামাজের বিশ্লেষণমূলক ধারাবাহিক এই আলোচনায় আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। 'নামাজ, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়'-শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার আজকের আসর শুরু করছি সেই মহান আল্লাহর নাম নিয়ে, সমস্ত প্রশংসা ও গৌরব যাঁর প্রাপ্য, যিনি সমস্ত পূর্ণতা ও সৌন্দর্য্যের উৎস, যিনি পাখির কন্ঠে জাগিয়ে তোলেন আনন্দের সুর-লহরী, ফুলের বক্ষে ছড়িয়ে দেন সুগন্ধ এবং যিনি নিখিল বিশ্বের সৃষ্টি, এর সুন্দর ফুল-ফল, লতা-পাতা থেকে শুরু করে নদী, সাগর, মহাসাগর, আকাশ ছোঁয়া পাহাড়-পর্বত, ঝর্ণাধারার মিষ্টি কলতান- এসব কিছুর ধারাবাহিক বিকাশ ও সংরক্ষণে ক্লান্ত হন না।

কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সেই মহান আল্লাহর যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং সৃষ্টির পর আমাদের জন্য সব ধরনের জীবন-উপকরণের ব্যবস্থা করেছেন, দিয়েছেন সুঠাম দেহ, দিয়েছেন বুদ্ধিবৃত্তি বা সত্য ও মিথ্যাকে যাচাই করার জ্ঞান, দিয়েছেন সঠিক পথ লাভের মাধ্যম হিসেবে পবিত্র কোরআন ও সত্যিকারের হেদায়াতের বাস্তব ব্যাখ্যাকারী হিসেবে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর পবিত্র আহলে-বাইত (আঃ)'র রেখে যাওয়া আদর্শ।

মহান আল্লাহর দেয়া নেয়ামতগুলোর যথাযথ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সমস্ত সৃষ্টিকূলের পক্ষেও অসম্ভব, বিশেষ করে নামাজের মত মহানেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মত ভাষা ও সাধ্য মানবকূলের জন্য খুবই সিমীত। এই নামাজের মাধ্যমে হেদায়ত বা সুপথে অবিচল থাকার ব্যাপারে আমরা আমাদের অঙ্গীকারগুলো দৈনিক ৫ বার নবায়ন করি এবং নতুন করে শক্তি সঞ্চারিত করি সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে বা মহান আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বা মিশনগুলো বাস্তবায়নের তৎপরতায়। মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই হেদায়ত, যার ওপর অবিচল থাকার জন্য আমরা সব সময়ই আল্লাহর দয়ার মুখাপেক্ষী এবং এমনকি নবী-রাসূল ও পবিত্র ইমামগণও আল্লাহর সাহায্যের মুখাপেক্ষী ছিলেন সব সময়। হেদায়াত ছাড়া শুধু জ্ঞান পাগলের হাতে ছুরি থাকার মতই ভয়ানক, কিংবা চোরের হাতে আলো থাকার মতই বিপজ্জনক। তাই হেদায়াত বা সুপথে অবিচল থাকার জন্য নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা জরুরী।

এভাবে বলা যায় নামাজ ইসলাম ধর্মের প্রধান স্তম্ভ। কোনো কোনো বর্ণনায় নামাজকে শরীরের মাথার মত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আধ্যাত্মিক উচ্চতর দিগন্তগুলোর উন্মোচক এই নামাজ মুমিনের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ। প্রকৃত খোদা প্রেমিক যখন আযান শুনেন তখন তার মধ্যে খোদা-প্রেমের গভীর আকুলতা ও শিহরণ অন্তরে যেন ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। সুরভিত ফুলের মতই নামাজ মানুষের অন্তরকে করে পবিত্র, ফুলেল ও সুরভিত। তাই পবিত্রতার ফুলেল সৌরভ ও প্রেমময় আকুলতা নিয়ে নামাজ আদায় করা উচিত। নামাজ মহান আল্লাহর সাথে বান্দার দূরত্ব মোচন করে এবং বান্দা বা দাস নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর দাসত্বের প্রত্যক্ষ পুলক অনুভব করেন।

গেলো সপ্তার আলোচনায় আমরা নামাজের সাথে শৈশব ও কৈশরের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছি। আমরা বলেছি, শৈশব থেকেই শিশুকে নামাজের মত ধর্মীয় বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত করা এবং নামাজের প্রতি তাদের ভালবাসাকে বদ্ধমূল করা সম্ভব। আজকের আলোচনায়ও আমরা এ বিষয়ে বিশ্লেষণ অব্যাহত রাখবো।

শিশু-কিশোরদেরকে নামাজের প্রতি আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে পরিবার, স্কুল ও গণমাধ্যমের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রশিক্ষণ দেয়া বা শিক্ষিত করা বলতে কেবল তথ্য সরবরাহ করাকেই বোঝায় না। ব্যক্তির চিন্তাধারা ও বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা এবং এ জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করাও প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত। শিশু-কিশোরদের মধ্যে ধর্মের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টির জন্য তাদেরকে ধর্মের কল্যাণ বা উপকারিতা সম্পর্কে ধারণা দেয়া জরুরী। বিশেষ করে নামাজের আধ্যাত্মিক চেতনা শিশু-কিশোরদের মনে বদ্ধমূল করা নামাজের সংস্কৃতি বিস্তারের জন্য অপরিহার্য। নামাজসহ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বা বিষয়গুলো তখনই শিশু-কিশোর ও যুবক-যুবতীদের মনে গভীর আকর্ষণ সৃষ্টি করবে যখন তা হবে আনন্দময় বা তৃপ্তিদায়ক।

ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও এবাদত মানুষের সর্বোত্তম বা সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক চাহিদাগুলো পূরণ করে। শিশু-কিশোর বা যুবক-যুবতীরা যদি স্বাভাবিক অথচ আকর্ষণীয় পরিবেশে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও এবাদতের সাথে পরিচিত হয় তাহলে তাদের মধ্যে এ সম্পর্কে সুন্দর ধারণা সৃষ্টি হবে এবং ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক বিশ্বাসগুলোকে তারা অন্তর দিয়ে ভালবাসবে। তাই শুধু অভিভাবকদের পক্ষ থেকে উপদেশ দিয়ে বা সতর্কবাণী শুনিয়ে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও এবাদতের দিকে আকৃষ্ট করা যায় না, বরং সহৃদয় আচরণ এক্ষেত্রে বেশী জোরালো বা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ধর্মীয় বিষয়ের শিক্ষক অথবা মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের আচরণ যদি খুব রুক্ষ হয়, কিংবা তারা যদি খুব কর্কষভাষী হন তাহলে কিশোর বা তরুণ বয়সীরা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও এবাদতের দিকে আকৃষ্ট হবে না। অন্যদিকে তাদের আচরণ যদি হয় সুন্দর এবং তারা মিষ্ট-ভাষী হন, তাহলে কিশোর, বয়সীরা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও এবাদতের দিকে আকৃষ্ট হবে সহজেই। গণমাধ্যমে অর্থসহ পবিত্র কোরআনের সুমধুর তেলাওয়াত এবং নামাজের হৃদয়-স্পর্শী জিকিরগুলোর প্রচার শিশু-কিশোর বা তরুণ-তরুণীদের ও যুবক-যুবতীদের মধ্যে ধর্মের প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে পারে।
শিশু-কিশোররা যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হয়, তখন তাদের মধ্যে ধর্ম ও নৈতিকতার প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। এ সময় তাদের জানার আকাঙ্ক্ষাও প্রবল থাকে।

তাই এ সময় মানসিক প্রশান্তি এবং অসীম রহমত ও শক্তির উৎসের সাথে তাদের সংযোগ স্থাপন খুবই জরুরী। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, যৌবনে উপনীত হবার পর শিশু-কিশোরদের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে জাগরণ দেখা দেয়। এমনকি যারা অতীতে ধর্মের প্রতি আগ্রহী থাকে না, তারাও যৌবনে উপনীত হবার পর ধর্ম বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠে। এই যে পরিবর্তন, তা তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশেরই অংশ। ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সে তরুণ ও যুবকরা ধর্মের আহ্বান অথবা বীরত্বের চেতনায় প্রভাবিত হয়। তারা এ সময় নতুন করে এমন এক বিশ্ব গড়ে তুলতে চায় যেখানে থাকবে না কোনো অন্যায়, অন্ধকার বা অজ্ঞতা, বরং থাকবে পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার।

ধর্মীয় অনুভূতি আত্মিক প্রশান্তি ও তৃপ্তির সাথে সম্পৃক্ত। কিশোর বা তরুণরা প্রকৃতিগতভাবেই এ ধরনের অনুভূতির জন্য তৃষ্ণার্ত। ধর্মীয় আনন্দের সাথে বস্তুগত আনন্দের পার্থক্য হল, বস্তুগত আনন্দ লাভের পর সে বিষয়ে আর মানুষের আগ্রহ থাকে না, কিন্তু মানুষের আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় আনন্দ এমনই যে তার চাহিদা দিনকে দিন বাড়তেই থাকে।

বিশ্ব রসায়ন অলম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় মেডেল অর্জনকারী প্রতিভাবান ইরানী যুবক জনাব সাবেরী নামাজের আনন্দ সম্পর্কে তার অনুভূতি তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, মহাকৌশলী ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আমাকে অর্থহীনতার দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছে, যে অর্থহীনতায় বন্দী বর্তমান বিশ্বের অনেক যুবক। আমি যখন নামাজ আদায়ে মশগুল হই তখন যেন এমন একটি শক্তি-কেন্দ্র থেকে শক্তি পেতে থাকি, যার সাথে আমি সংযুক্ত এবং তখন আমি বিশেষ ধরনের আনন্দ পেতে থাকি। আল্লাহর প্রেম ও তাঁর কাছে প্রার্থনার আনন্দকে অন্য কোনো কিছুর সাথেই তুলনা করা যায় না। আমি খুব ভালোভাবেই এটা উপলব্ধি করছি যে, প্রার্থনার সময় একজন যুবকের চোখ থেকে যে পবিত্র অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, তা তার অন্তরকে আলোকিত করে এবং তার অন্তর দয়া ও ভালবাসায় টইটুম্বর হয়। একজন যুবকের জন্য এটা অনেক বড় অর্জন।

এভাবে নামাজ যুবক-যুবতীদের জীবনে ধ্রুবতারার মত আলোর স্থায়ী উৎসে পরিণত হতে পারে এবং তাদের জীবনে ঘটাতে পারে মহাবিপ্লব। ইউরোপীয় নওমসুলিম সাবেক ম্যারী বা বর্তমান ফাতেমা মনে করেন, পবিত্র কোরআনের বাণীগুলো মানুষের জীবন সম্পর্কে নতুন অর্থ তুলে ধরেছে, যার সাথে অন্য কোনো কিছুর তুলনা হয় না। নামাজ সম্পর্কে নিজের আনন্দের অনুভতি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেছেন, " দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা ও পড়াশুনার পর শেষ পর্যন্ত উজ্জ্বল এক বিন্দুতে উপনীত হলাম। আমার মুসলমান বন্ধুদের উৎসব অনুষ্ঠানের সেই রাতে আমি তাদের আধ্যাত্মিকতা ও পবিত্রতার সমাহারে আকৃষ্ট হয়েছিলাম। পবিত্র কোরআনের হৃদয়গ্রাহী বাণীর সুমধুর শব্দ, আযানের সূর এবং নামাজীদের কাতারে তাদের মধ্যে ঐক্য বা সমন্বয়ের দৃশ্য আমাকে বদলে দিল। আমি যেন এক নতুন জগতে প্রবেশ করলাম। আমার সমস্ত অস্তিত্ব ভরে উঠলো মিষ্টি অনুভূতিতে। প্রকৃত সৌন্দর্য্যরাশির এক দিগন্ত বা জানালা আমার সামনে খুলে গেল। সে সময়ই আমি আমার অন্তরের আহ্বানে স্বাধীনভাবে সাড়া দিলাম, বিমুগ্ধ ও স্তম্ভিত হয়ে নিজেকে নামাজীদের সারিতে খুঁজে পেলাম। যদিও আমি জানতাম না নামাজে কি বলতে হবে, কিন্তু আমার আত্মা যেন খাঁচা থেকে মুক্ত হওয়া পাখীর মত এক বেহেশতী পরিবেশে পাখা ও পালক মেলে ধরলো।"
১০ মে, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে