শুক্রবার, ১৩ মে, ২০১৬, ০৪:৪৮:০৩

'নামাজ মানুষকে পৃথিবীর মায়ায় ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করে' (১৮তম পর্ব)

'নামাজ মানুষকে পৃথিবীর মায়ায় ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করে' (১৮তম পর্ব)

ইসলাম ডেস্ক : প্রিয় পাঠক! নামাজের বিশ্লেষণমূলক ধারাবাহিক এই আলোচনায় আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। 'নামাজ, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়'-শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার আজকের আসর শুরু করছি সেই মহান আল্লাহর নাম নিয়ে, সমস্ত প্রশংসা ও গৌরব যাঁর প্রাপ্য, যিনি সমস্ত পূর্ণতা ও সৌন্দর্য্যের উৎস, যিনি পাখির কন্ঠে জাগিয়ে তোলেন আনন্দের সুর-লহরী, ফুলের বক্ষে ছড়িয়ে দেন সুগন্ধ এবং যিনি নিখিল বিশ্বের সৃষ্টি, এর সুন্দর ফুল-ফল, লতা-পাতা থেকে শুরু করে নদী, সাগর, মহাসাগর, আকাশ ছোঁয়া পাহাড়-পর্বত, ঝর্ণাধারার মিষ্টি কলতান- এসব কিছুর ধারাবাহিক বিকাশ ও সংরক্ষণে ক্লান্ত হন না।

প্রার্থনা ও মুনাজাতের বিশাল উদ্যানে এসো আমাদের সাথে
যেসব উদ্যানে বয়ে যায় বেহেশতী হাওয়া,
যে হাওয়া সুরভিত ঈমানের সুবাসে।
আমাদের সাথে চল দোয়া ও নামাজের জলসায়
দু-রাকাত প্রেমময় নামাজ পড়বো সেথায়
শুভ্র পিটিউনিয়া ফুল তুলে দু-হাত ভরে তোলো খোদার রহমতের নূরে।

ইরানের পবিত্র শহর মাশহাদে রয়েছে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আঃ)'র পবিত্র মাজার। এই মাজারের সাথেই রয়েছে গওহরশাদ মসজিদ নামের এক বিখ্যাত মসজিদ। ইতিহাসে এসেছে, এই মসজিদে ছিল আহমদ নামের এক কর্মী বা খাদেম। একদিন সে যখন কাজে মশগুল, তখন এই মসজিদ নির্মাণের খরচ বহনকারী গওহরশাদ খাতুন নামের এক পূণ্যাত্মা মহিলা মসজিদের কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য সেখানে আসেন। এক মুহূর্তের জন্য গওহরশাদ খাতুনের চেহারা থেকে নেক্বাব বা চাদর সরে গেলে তার সুন্দর চেহারার ওপর আহমদের দৃষ্টি পড়ে ।

ফলে আহমদের হৃদয়ে জন্ম নেয় গওহরশাদ খাতুনের প্রতি প্রবল অনুরাগ। দিনকে দিন এই অনুরাগ গভীরতর হতে থাকে এবং এই আকর্ষণ তাকে অসুস্থ ও শয্যাশায়ী করে ফেলে। আহমদের মা ছেলের এ অবস্থার কারণ জানার পর গওহরশাদ খাতুনের শরণাপন্ন হলেন, যদিও আহমদের মা জানতেন এ ধরনের শিশুসুলভ আকাঙ্ক্ষা অবাস্তব স্বপ্ন মাত্র । গওহরশাদ সব ঘটনা শুনে বললেন, তোমার ছেলেকে বল, সে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তা গ্রহণ করবো, তবে শর্ত হ'ল, তাকে ৪০ দিন ধরে মসজিদের মেহরাবে নামাজ ও এবাদতে মশগুল হতে হবে এবং এসব এবাদতের সওয়াব আমাকে মোহরানা হিসেবে দিতে হবে।

আহমদের মা গওহরশাদ খাতুনের এই প্রস্তাবের কথা আহমদকে জানালেন। আহমদ গওহরশাদ খাতুনের প্রস্তাব শুনে শয্যা থেকে উঠে পবিত্র কোরআন নিয়ে মসজিদের মেহরাবে নামাজে মশগুল হল। সে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে নামাজ আদায় করতে লাগলো এবং খোদার প্রেমে তার চোখ দুটি থেকে প্রবাহিত হত অশ্রু। এভাবে নিদ্রাহীন অবস্থায় আহমদ শক্তিহীন বা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে এবাদতের আনন্দ তার মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে উঠলো এবং তার কাছে মনে হলো এবাদতের মত আনন্দদায়ক আর কিছু নেই। এভাবে ৩৯ দিন কেটে গেল এবং ৪০ তম দিনে গওহরশাদ খাতুনের দূত আহমদের শর্ত পূরণের খবর নিতে এল।

সে আহমদকে জিজ্ঞেস করলো:
তুমি কি গওহরশাদ খাতুনের দেয়া শর্ত পূরণ করেছ?
বদলে-যাওয়া আহমদ বললো: ঐ মহিলাকে বলবেন, তাকে পাবার জন্য আমি আমার প্রকৃত প্রেমাস্পদ ও প্রিয়তমকে হাতছাড়া করতে প্রস্তুত নই। গওহরশাদের প্রতি ভালবাসা ছিল অপ্রকৃত ভালবাসা। আমি এর চেয়েও উচ্চতর বাস্তবতার সন্ধান পেয়েছি।

এভাবে গওহরশাদ খাতুন আহমদ নামের ঐ যুবকের অন্তরের চোখ খুলে দিতে ও তাকে প্রকৃত প্রেমাস্পদের দিকে পরিচালিত করতে সক্ষম হয় যাতে খোদার প্রেমের স্বাদ আস্বাদন করে সে বস্তুগত ও পার্থিব আনন্দকে বর্জন করে।

আসলে এবাদতের আনন্দ ও মাধুর্য্য তুলনাহীন। ওলি-আওলিয়া বা আল্লাহর প্রিয় বান্দাগন এবাদতের আনন্দ ও মাধুর্য্য আস্বাদনের সুযোগ দিতে দয়াময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন।

পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, সমস্ত সৃষ্টি ও অস্তিত্ব মহান আল্লাহর তাসবীহ বা প্রশংসা করে। সূরা নূরের ৪১ নম্বর আয়াতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, 'তোমরা কি দেখ না আকাশ ও ভূ-মন্ডলের সব কিছুই আল্লাহর প্রশংসা করছে এবং উড্ডীয়মান পাখীরাও আল্লাহর প্রশংসা করছে? তাদের প্রত্যেকেই আল্লাহর প্রশংসা, পবিত্রতা বা মহিমা ঘোষণা ও নামাজের পদ্ধতি জানে এবং ওরা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত।'

মানুষের সীমিত দৃষ্টি অন্য জীবের এবাদত ও বন্দেগীকে উপলব্ধি করতে না পারলেও তারা এটা বোঝেন যে সর্বশক্তিমান এবং মহাকৌশলী আল্লাহ এবাদত ও প্রশংসার যোগ্য। মহান আল্লাহ দয়া, রহমত ও সৌন্দর্য্যের উৎস । তাই মহান আল্লাহর মহত্ত্বের ও শ্রেষ্ঠত্বের মোকাবেলায় সবারই বিনম্র এবং নতজানু থাকা উচিত। কারণ, পবিত্র কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী আকাশ ও ভূ-মন্ডলে যা কিছু আছে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা বা প্রশংসা করে, কিন্তু মানুষ তাদের এইসব প্রশংসা বা তাসবীহ উপলব্ধি করতে পারে না।

এই আয়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হ'ল প্রত্যেক সৃষ্টি সর্বশক্তিমান আল্লাহর মোকাবেলায় বিনম্র এবং সব কিছুই আল্লাহর অসীম মহত্ত্বের সম্মুখে শ্রদ্ধায় মাথা নত করে। এরই আলোকে অনেকেই মনে করে বাতাসের শো শো শব্দ বা হাওয়ার গান, সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ বা নদীর ঢেউয়ের ছলাৎ-ছল ধনি, বুলবুলি বা অন্য পাখীদের কলতান এবং বৃষ্টির ছন্দময় পতনের ধ্বনি-এসবই আল্লাহর তাসবীহ বা প্রশংসা মাত্র। মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ)'র দৃষ্টিতে সৃষ্টিকূল মহান আল্লাহর এইসব প্রশংসা বা খোদার তাসবীহ সচেতনভাবেই করে থাকে। তাঁর মতে প্রতিটি অস্তিত্ব মহান আল্লাহ সম্পর্কে সচেতন।

যাই হোক, নামাজ আল্লাহর সামনে বিনীত হবার সবচেয়ে সুন্দর মাধ্যম। পূর্ণতাকামী মানুষের জন্য নামাজ মহান আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, প্রেম বা অনুরাগ ও গভীর বিশ্বাসের প্রকাশ। নামাজের নূর ও আল্লাহর দাসত্বে উজ্জীবিত ব্যক্তিরা প্রকৃতপক্ষে আমিত্বের সব ধরনের প্রকাশ তথা অহংকার থেকে নিজেকে মুক্ত করেছেন। মানুষের মধ্যে যদি বিন্দুমাত্র অহংকারও থেকে থাকে তাহলে তা তাকে খোদাদ্রোহীতার দিকে টেনে নেয়। নামাজী বা মুসল্লীরা রুকু ও সিজদার মাধ্যমে আল্লাহর প্রশংসা ও গুণগানে মশগুল হয়ে মূলত অন্যান্য সৃষ্টির তাসবিহ পাঠের কনসার্ট বা খোদাপ্রেমের সম্মিলিত সংগীতে যোগ দেন।

খোদার গুণগান বা আল্লাহর প্রেমের আকুতিতে ভরা প্রশংসা মানুষের মনকে করে প্রশান্ত, আন্তরিক, পবিত্র, সুস্থির ও দৃঢ়-চিত্ত বা আত্মবিশ্বাসী। সমসাময়িক যুগের খ্যাতনামা ইসলাম-বিশেষজ্ঞ ও সুইস চিন্তাবিদ মার্শাল বাওয়াজার বলেছেন, "নামাজ আল্লাহর মহত্ত ও একত্বের কথা বার বার স্মরণ করিয়ে দেয় এবং নামাজের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর দলে শামিল হবার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জনের আগ্রহ প্রকাশ করে। নামাজের মাধ্যমে এই যে পরিবর্তন এর স্থায়ী অবস্থা বা স্থায়ীত্ব মানুষকে পার্থিব বা বস্তুগত বিষয়ে নিমজ্জিত হওয়া থেকে রক্ষা করে।"
১৩ মে, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে