শনিবার, ১৪ মে, ২০১৬, ০৪:৩৪:১৯

'নামাজ থেকে বড় শান্তির ইবাদাত আর নেই' (১৯তম পর্ব)

'নামাজ থেকে বড় শান্তির ইবাদাত আর নেই' (১৯তম পর্ব)

ইসলাম ডেস্ক : প্রিয় পাঠক! নামাজের বিশ্লেষণমূলক ধারাবাহিক এই আলোচনায় আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। "নামাজ, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়" শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার এ সপ্তার আসর শুরু করছি সেই মহান আল্লাহর নাম নিয়ে, সমস্ত প্রশংসা ও গৌরব যার প্রাপ্য, যিনি সমস্ত ক্ষমতা, পূর্ণতা ও সৌন্দর্য্যের উৎস, যার বিরতিহীন বা অসীম প্রশংসাও তার অসীম মহত্ত্ব এবং পরিচিতির তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত। একজন নওমুসলিম মহিলার স্মৃতি-কথা উদ্ধৃত করে শুরু করবো আজকের মূল আলোচনা।
 
" আমার খুব ইচ্ছে হত বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পরিচিত মুসলিম বন্ধু ফাতেমার মত নামাজ পড়তে। আমি জানতাম না নামাজ কি? একদিন ফাতেমার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাইলে সে বলল, "নামাজ তো পড়া হয়নি,আগে অবশ্যই এই নামাজ পড়তে হবে।" আমি অপেক্ষা করছিলাম, আর ফাতেমা গভীর মনোযোগ ও অনুরাগ নিয়ে নামাজ পড়তে লাগলো। তার মন এত একনিষ্ঠ যে আমি যেন তার কাছে একেবারেই অপরিচিত। সে প্রশান্ত চিত্তে ও বিনম্রভাবে নামাজের বাক্যগুলো উচ্চারণ করছিল। সে যখন সিজদায় যেতো ও সিজদা থেকে মাথা তুলতো, তখন তার চোখে এক ঔজ্জ্বল্য এবং চেহারায় এক বিশেষ আধ্যাত্মিক ভাব ফুটে উঠতো। আমার মনে এ প্রশ্ন জাগলো যে, ও কার সাথে কথা বলছে যে তার মধ্যে এমন পরিবর্তন দেখা দিয়েছে? যখন নামাজ আদায়রত ফাতেমার দিকে তাকাতাম, তখন নামাজের প্রতি একটা মিষ্টি টান অনুভব করতাম। ইচ্ছে হত ওর নামাজের দৃশ্য বার বার দেখি। এর পর থেকে নামাজ সম্পর্কে ফাতেমার কাছে একের পর এক প্রশ্ন করতাম। সেও খুব সাগ্রহে ও দয়াদ্রচিত্তে নামাজের রহস্য তুলে ধরতো। ফলে প্রার্থনা সম্পর্কে আমার আগ্রহ দুনির্বার হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে বিশ্ব সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল। কিছুকাল ইসলাম সম্পর্কে গবেষণার পর ঐশী এ ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ও নামাজ আদায় করে আমি আলোর জগতে প্রবেশ করি।"

গেলো সপ্তায় আমরা বলেছিলাম নামাজ মানুষের জন্য সব সময়ই জরুরী বিষয়। মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নামাজের চেয়ে জোরালো অন্য কোনো মাধ্যম নেই। তাই ইসলামের মহান নবী (সাঃ)কে দেয়া আল্লাহর এ উপহারের গুরুত্ব আমাদের বোঝা উচিত। গবেষকদের মতে, নামাজ মানুষের অন্তরকে পরিশুদ্ধ করার এবং তাকে উন্নত আধ্যাত্মিক ও নৈতিক স্তরে পৌঁছে দেয়ার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। নামাজের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণ হল, প্রথমতঃ এই এবাদত মানুষকে পাপ বর্জন করতে বলে।
দ্বিতীয়তঃ নামাজ মানুষের মধ্যে এবাদতের চেতনা জাগায়।
তৃতীয়তঃ নামাজ মানুষের মনে প্রশান্তি জোগায়।

নামাজ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, প্রার্থনা ও তার দাসত্বের পরিপূর্ণ প্রকাশ। নামাজ থেকে বড় শান্তির ইবাদাত আর নেই এই এবাদত মানুষকে বস্তুজগতের অন্ধকার, অজ্ঞতা ও সংকীর্ণতার কারাগার থেকে মুক্ত করে এবং মানুষের কূপ্রবৃত্তি ও আত্মম্ভরিতা বা ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ জন্যে ঐশী ধর্মগুলোতে নামাজ ধার্মিকতা ও ঈমানের প্রধান লক্ষণ হিসেবে স্বীকৃত এবং ইসলামে প্রচলিত নামাজ হচ্ছে নামাজের পরিপূর্ণ বা পূর্ণাঙ্গ রূপ।

অনেকে নামাজের বাহ্যিক দিককে বেশী গুরুত্ব দেন। তাই তারা নামাজের রাকাতের সংখ্যা বৃদ্ধির দিকে বেশী আগ্রহী। কিন্তু ঈমান ও আমলের সাথে জ্ঞান বা প্রজ্ঞার সংযোগ থাকা বেশী জরুরী। ইসহাক বিন আম্মার হযরত ইমাম সাদেক্ব (আঃ)কে বলেছিলেন, আমার এক প্রতিবেশী অনেক নামাজ আদায় করেন, বিপুল পরিমাণ সদকা দেন, বহুবার হজ্বে গেছেন এবং তার মধ্যে কোনো দোষ দেখি নি। তখন ইমাম প্রশ্ন করলেন, তার বুদ্ধি বা জ্ঞান কি রকম? জবাবে ইসহাক বললেন, তার বুদ্ধিতে ঘাটতি আছে। ইমাম বললেন, তাহলে সে সফল হবে না।
চিন্তাশীলতার মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টিশীল অনেক জ্ঞান অর্জন করতে পারে। সফল মানুষেরা কথা কম বলে বা বেশীরভাগ সময় নীরব থেকে আধ্যাত্মিক সম্পদ অন্বেষণ করতেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, চিন্তাসহকারে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা সারা রাত জেগে (চিন্তাহীন) এবাদত-বন্দেগী করার চেয়ে উত্তম। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (অঃ) বলেছেন, জ্ঞান ও আল্লাহর ওপর নির্ভরতা বা ইয়াক্বীন নিয়ে ঘুমানো অজ্ঞতা এবং সন্দেহ নিয়ে নামাজ পড়ার চেয়ে উত্তম।
 
তাই ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও ওলী-আওলিয়াগণের দৃষ্টিতে চিন্তাযুক্ত তথা জ্ঞান ও প্রজ্ঞাপূর্ণ এবাদতই গ্রহণযোগ্য হয়। একজন বিজ্ঞ মুসলিম আলেম তার সন্তানকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেন, "হে আমার সন্তান! চিন্তাশীলতা মানুষের আত্মাকে জাগিয়ে তোলার এবং আত্মিক পরিশুদ্ধির সবচেয়ে বড় মাধ্যম। চিন্তাশীলতা মানুষের কূপ্রবৃত্তি নির্মূলে ও চিরন্তন আবাসের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বর্ণনায় এসেছে, মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও মহত্ত্ব সম্পর্কে চিন্তাভাবনা সবচেয়ে বড় এবাদত। এবাদতের চেয়েও চিন্তাশীলতা যে গুরুত্বপূর্ণ সে সম্পর্কে বলা হয়েছে, চিন্তাশীলতা মানুসেকে মহিমাময় খোদার কাছে পৌঁছে দেয়, আর এবাদত তার জন্য এনে দেয় খোদায়ী পুরস্কার। তাই তুমি যেন চিন্তাশীলতাকেই বেশী গুরুত্ব দাও।"

সচেতনভাবে ও চিন্তা-ভাবনার মধ্য দিয়ে নামাজ পড়ার সুফল হল, এর ফলে নামাজ হয়ে ওঠে আধ্যাত্মিক বা প্রেমময়। এ অবস্থায় নামাজে উচ্চারিত বাক্যগুলোর অর্থের দিকে মনোযোগ নিবদ্ধ থাকে এবং খোদাপ্রেমের আনন্দ-অনুভূতিতে নামাজীর মন ভরে থাকে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেছেন, যারা এবাদতে অনুরক্ত এবং এবাদতকে মনে প্রাণে ভালোবাসে তারা তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এ ধরনের মানুষ এবাদত সম্পন্ন করার সময় পৃথিবীর সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। এ ধরনের মানুষ পার্থিব জীবনে আরামে আছে না কষ্টে আছে সে দিকে কোনো লক্ষ্য রাখে না।

নামাজ আদায়ের মাধ্যমে নামাজী মহান আল্লাহর সাথে যে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন ও খোদায়ী অনুগ্রহ লাভ করেন তার সুবাদে নামাজীর মধ্যে সুপ্ত আধ্যাত্মিক শক্তিগুলো বিকশিত হয়। এর ফলে সৎকর্ম ও মানুষের জন্য কল্যাণকরা কাজ করার ব্যাপারে তার ইচ্ছে দৃঢ়তর হয়। নামাজি আল্লাহ সম্পর্কে যত বেশী জানেন ততই সে বিনম্র ও বিনীতভাবে নামাজ আদায় করেন। পবিত্র কোরআনের সূরা মুমিনুনের প্রথম দুই আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, বিশ্বাসীরা অবশ্যই সফলকাম হয়েছে যারা তাদের নামাজে বিনম্র।

ইসলামী ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, "মানুষ সব সময়ই বিভিন্ন ধরনের ভুলের ফাঁদে রয়েছে। ছোট, বড়, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ও যুবক-যুবতী নির্বিশেষ সব ধরনের মানুষই নানা ভুল করেন এবং তারা বিভিন্ন ধরনের পাপাচারের শিকার হন। এ অবস্থায় মানুষ যদি জীবনের মহাযাত্রায় সফল হতে চায় তাহলে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে সে তার ভুল-ত্রুটি ও পাপগুলোর ক্ষতিপূরণ করতে পারে। কারণ, মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সূরা হুদের ১১৪ নম্বর আয়াতে বলেছেন, তোমরা দিবসের দুই অংশে এবং রাতের প্রথম দিকে নামাজ আদায় কর। কারণ, সৎ কাজ অসৎ কাজগুলোকে বিলীন করে দেয়।"

তাই আমাদের উচিত প্রফুল্ল-চিত্তে নামাজ আদায়ের চেষ্টা করা। আমরা যদি নামাজের গুরুত্ব এবং নামাজে পঠিত বাক্য ও শব্দগুলোর অর্থ ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারি তাহলে আমরা দেখবো যে নামাজ কত আনন্দময় ও মধুর ব্যাপার। আর তখনই "নামাজের দিকে ছুটে আস" বা "হাইয়া আলাস সালাহ" নামক বেহেশতী আহ্বান মধুর চেয়েও মিষ্টি মনে হবে এবং আমাদের সমগ্র অস্তিত্ব মহান আল্লাহর দরবারে প্রেম ও প্রার্থনা বা আত্ম-নিবেদনের জন্য প্রস্তুত হবে।-আইআরআইবি
১৪ মে, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে