রবিবার, ১৫ মে, ২০১৬, ০৪:৪০:২৩

'নামাজ শরীর বা মনের প্রশান্তি লাভের শ্রেষ্ঠ ইবাদত' (শেষ পর্ব)

'নামাজ শরীর বা মনের প্রশান্তি লাভের শ্রেষ্ঠ ইবাদত' (শেষ পর্ব)

ইসলাম ডেস্ক : প্রিয় পাঠক! নামাজের বিশ্লেষণমূলক ধারাবাহিক এই আলোচনায় আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। "নামাজ, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায়" শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার এ সপ্তার আসর শুরু করছি সেই মহান আল্লাহর নাম নিয়ে, সমস্ত প্রশংসা ও গৌরব যার প্রাপ্য, যিনি সমস্ত ক্ষমতা, পূর্ণতা ও সৌন্দর্য্যের উৎস, যার বিরতিহীন বা অসীম প্রশংসাও তার অসীম মহত্ত্ব এবং পরিচিতির তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত। একজন নওমুসলিম মহিলার স্মৃতি-কথা উদ্ধৃত করে শুরু করবো আজকের মূল আলোচনা।

জাওয়াদ চেনারী তার লেখা "অবশ'রে রহমত" বা "রহমতের জলপ্রপাত" শীর্ষক বইয়ে নামাজ সম্পর্কে ত্রিশটি প্রবন্ধ লিখেছেন। এইসব প্রবন্ধের মধ্যে একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, "মানুষ বিভিন্ন ধরনের উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ও অশান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করছে। ফলে তারা মানসিক প্রশান্তির জন্য ব্যাকুল। মানুষ কষ্ট করে অথবা তেমন কষ্ট স্বীকার বা পরিশ্রম না করেই হয়তো তার বস্তুগত চাহিদাগুলো মেটাতে পারে। কিন্তু যখনই সে আত্মিক বা আধ্যাত্মিক চাহিদাগুলো পূরণের কথা ভাবে তখন সে নিজেকে রিক্ত-হস্ত দেখতে পায়। এ অবস্থায় কর্তব্য ও করণীয় বিষয়ে দিশাহারা মানুষের মনের মধ্যে বইতে থাকে অতৃপ্তি ও অশান্তির ঝড়। ফলে শেষ পর্যন্ত সে নিজের অজান্তেই এমন এক মহাশক্তি বা অতি-উন্নত সত্তার সন্ধান করতে থাকে যার ছায়াতলে তার আত্মা পাবে প্রশান্তি। মানুষ এ বিশ্ব চরাচরে এমন এক শান্তির নীড় বা ছায়াতল খুঁজছে যেখানে তার আত্মা নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতের হাত থেকে নিরাপদ থাকবে এবং হুমকির প্রবল ঝড়-ঝাপটাগুলো তাকে স্পর্শ করতে পারবে না।"
 
এরপর জনাব জাওয়াদ চেনারী উপসংহারে লিখেছেন, "এ অবস্থায় মানুষ নিজেকে বস্তুগত শক্তির উর্ধ্বের নৈর্ব্যক্তিক ও অনির্বচনীয় শক্তির মুখাপেক্ষী বলে মনে করে, ফলে স্রস্টা বা আল্লাহর স্মরণ তার অন্তরে জোগায় প্রশান্তি এবং আল্লাহর স্মরণে ভরপূর নামাজ হয়ে উঠে তার জন্য অমূল্য সম্পদ। নামাজ কেবল আল্লাহর স্মরণ নয়, একইসাথে তা আল্লাহর সাথে কথোপকথন। আর বার বার মহান আল্লাহর সাথে কথা বলার মাধ্যমে তাঁর সাথে মানুষের সম্পর্ক হয় সুদৃঢ় ও স্থায়ী। "

মানুষের সামাজিক জীবন তার প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তাই মানুষ একঘরে হয়ে জীবন-যাপন করতে পারে না। মানুষের সামাজিক জীবন ও অন্যদের সাথে সম্পর্ক বিভিন্নভাবে তার ওপর প্রভাব ফেলে। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সঙ্গী বা সাহচর্যের পরিণাম সম্পর্কে মানব-জাতিকে সতর্ক করে গেছেন। তিনি বলেছেন, "খারাপ সঙ্গীর চেয়ে একাকীত্ব উত্তম এবং ভালো বা সৎ সঙ্গী একাকীত্বের চেয়ে উত্তম।"

সামাজিক-জীবনে যেমন কিছু নিয়ম-শৃঙ্খলা ও রীতি মনে চলতে হয়, তেমনি প্রত্যেক কাজেরই কিছু রীতি ও নিয়ম মেনে চলা সাফল্য অর্জনের জন্য জরুরী। ধর্ম মানুষকে এই দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলে। নামাজও এ ধরনের নিয়ম ও রীতির ব্যতিক্রম নয়। নামাজের প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা ও এর আধ্যাত্মিক সাজ-সজ্জায় সজ্জিত হবার জন্য এর নিয়ম-শৃঙ্খলা, বিভিন্ন সূক্ষ্ম দিক ও রীতিগুলো খুব ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করা জরুরী। আর এর ওপরই নির্ভর করছে মানুষের পূর্ণতা। আর এ সব বিষয়ে উদাসীনতা ও অজ্ঞতা মানুষকে পশ্চাদপদ করে রাখে এবং তাকে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত করে।

নামাজের নিয়ম-রীতি তথা আদব-কায়দা ও প্রথা দু-ধরনের। বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ। নামাজের বাহ্যিক দিকের নিয়ম-রীতির দৃষ্টান্ত হিসেবে ওজু করা, নামাজের সময় হবার পর প্রথম দিকেই নামাজ আদায় করা, পবিত্র পোশাক পরা প্রভৃতির কথা বলা যায়। নামাজের নিয়ম-রীতি তথা আদব-কায়দার এসব বাহ্যিক দিক মানুষের জীবনে নানা কল্যাণ বয়ে আনে। যেমন, ওজু-করা, সুগন্ধী মাখা, শরীর ও পোশাক-পরিচ্ছদ সুসজ্জিত এবং পবিত্র রাখা- এসব বিষয় মানুষকে স্বাস্থ্য-সম্মত ও পবিত্র জীবন যাপনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। "নামাজের ওয়াক্ত বা সময়" মানুষের কাছে সময়ের গুরুত্ব ও নিখুঁত বা সুপরিকল্পিত জীবন যাপনের গুরুত্ব তুলে ধরে। কিন্তু নামাজের নিয়ম-রীতি তথা আদব-কায়দার বাহ্যিক দিকের চেয়ে অভ্যন্তরীন দিক বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

নামাজের এসব নিয়ম-রীতি তথা আদব-কায়দার ওপরই নির্ভর করে নামাজের প্রকৃত ঔজ্জ্বল্য এবং আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠতা বা নৈকট্যের সম্পর্ক। নামাজের অভ্যন্তরীণ মান অনেকাংশে নির্ভর করে মহান আল্লাহর মোকাবেলায় নামাজীর বিনয় ও নম্রতার গভীরতার ওপর। আর এই বিনয় ও নম্রতা হাসিলের জন্য নামাজের নিয়ম-রীতি তথা আদব-কায়দার অভ্যন্তরীণ দিক সম্পর্কে ভালো জ্ঞান ও সচেতনতা থাকা জরুরী। নামাজের এই অভ্যন্তরীণ জগতের পথ-পরিক্রমা মুসল্লীর মন থেকে সব ধরনের পদস্খলন ও দূর্নীতির চিন্তা নির্মূল করে। আর এ জন্যই মহান আলেম এবং ওলি-আওলিয়াগণ নামাজের অভ্যন্তরীণ নিয়ম-রীতি তথা আদব-কায়দা মেনে চলার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। মরহুম ইমাম খোমেনী (রহঃ)'র দৃষ্টিতে মহান আল্লাহর মহত্ত্বের সামনে নিজেকে তুচ্ছ দাস মনে করা নামাজের একটি সুপ্ত বা আত্মিক দিক এবং এই চেতনা মহান আল্লাহর মোকাবেলায় দাসের অবস্থান নির্ধারণ করে। অসীম ক্ষমতার মহাউৎস মহান আল্লাহর সামনে নামাজীর উচিত নিজেকে খুবই দূর্বল ও ছোট মনে করা, আর এভাবেই তার আমিত্বের পর্দা ছিন্ন হবে এবং এই চেতনা তাকে উর্ধ্ব জগতে উন্নীত করবে।

মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ)'র মতে, প্রশান্ত চিত্তে নামাজ আদায় করা উচিত। মানুষ যদি উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্যে এবং তাড়াহুড়া করে নামাজ আদায় করে তাহলে নামাজে একাগ্রতা ও অভিনিবেশ ক্ষুন্ন হয়। আর মনোযোগের ব্যাঘাতের ফলে নামাজে পঠিত বাক্যগুলো শব্দ ও শ্রুতির উর্ধ্বে উঠে না, ফলে সেগুলো নামাজীর অন্তরে কোনো প্রভাব ফেলে না।

শারীরিক অসুস্থতা ও মানসিক যাতনার সময় নামাজ আদায় না করে প্রফুল্লতার সময় নামাজ আদায় করা উচিত। মানসিক চাপের সময় নামাজ আদায় করা হলে ফলে নামাজের প্রতি এক ধরনের ভয় বা অস্বস্তি সৃষ্টি হতে পারে। এবাদতের নামে নিজের ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয়া বা অসহনীয় কিছু করা বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)'র দেয়া শিক্ষার পরিপন্থী।

নামাজে বিনম্রতা ও একাগ্রতা থাকলে সেই নামাজই কেবল মানুষকে অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখে। নামাজের মধ্যে একাগ্রতা বা হৃদয় ও মন নামাজে একাকার করে দেয়া বলতে নামাজে পঠিত বাক্যগুলোর অর্থ উপলব্ধিসহ নামাজ আদায় করাকে বোঝায়। হযরত ইমাম সাদেক্ব (আঃ) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, "যখন কেবলামুখি হয়ে নামাজে দাঁড়াবে, তখন পৃথিবীতে মানুষসহ যা কিছু আছে তার সব কিছুই ভুলে যাবে এবং স্মরণ করবে যে তুমি মহান আল্লাহর সামনে উপস্থিত হয়েছ। কিয়ামতের দিন বা বিচার-দিবসে তোমরা পৃথিবীতে যা করেছিলে তা প্রকাশ্যে দেখতে পাবে।"

বর্তমান যুগে মানুষ বহু সমস্যায় আক্রান্ত বলে তাদের মন প্রশান্ত বা স্থির নয়। তাই একাগ্রচিত্তে ও প্রশান্ত মনে নামাজ পড়া এ যুগের মানুষের জন্য সহজ নয়। কিন্তু মরহুম ইমাম খোমেনী (রঃ)'র মতে মানুষ জ্ঞান, প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের সহায়তায় তার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে। তবে এ জন্য শর্ত হল, জ্ঞান অর্জন এবং দয়াময় আল্লাহ সম্পর্কে জানা ও খোদায়ী বাস্তবতাগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা চালানো।
মানুষের উচিত মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনার হাত তুলে ধরা এবং নিজের আমিত্ব, আত্মকেন্দ্রীকতা ও স্বার্থপরতাকে মোকাবেলা করা। আর এ অবস্থায় নামাজ মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলবে এবং মানুষ সৌভাগ্য ও মুক্তির পথে এগিয়ে যাবে।
১৫ মে, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে