জামাল উদ্দিন : ভয়াবহ ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার তদন্ত নিয়েও নানা নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। সাজানো হয়েছিল জজ মিয়া নাটক। ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের পট পরিবর্তনের পর ২১ আগস্ট হামলা মামলারও দৃশ্যপট পাল্টে যেতে থাকে। নতুন করে এ মামলার তদন্তের নির্দেশ দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় গেলে পুরোপুরি পাল্টে যায় মামলার তদন্তের ধারা। ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের পর ২০০৯ সালের ২৫ জুন আদালতের কাছে এ মামলার অধিকতর তদন্তের আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে ওই বছরের ৩ আগস্ট আদালত অধিকতর তদন্তের আবেদন মঞ্জুর করেন। অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দকে।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরদিন ২০০৪ সালের ২২ আগস্ট দণ্ডবিধির ১২০/বি, ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৩০২, ২০১, ১১৮, ১১৯, ২১২, ৩৩০, ২১৮, ১০৯ ও ৩৪ ধারায় মতিঝিল থানার এসআই শরীফ ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে একটি মামলা (নং-৯৭) দায়ের করেন। ২০০৮ সালের ৯ জুন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে অভিযুক্ত করে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে সিএমএম আদালতে দুটি চার্জশিট দাখিল করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সিনিয়র এএসপি ফজলুল কবির।
চার্জশিট দেওয়ার পরপরই ওই বছর মামলা দুটির কার্যক্রম ঢাকার দ্রুত বিচার আদালত-১-এ স্থানান্তর করা হয়। এ আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের ২৯/১১(হত্যা) ও ৩০/১১ (বিস্ফোরক) মামলা দুটির বিচার কার্যক্রম একসঙ্গে শুরু হয়। এখনও মামলাটির বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শাহেদ নূর উদ্দিন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে নাজিম উদ্দিন রোডে পিডব্লিউডির একটি পুরানো সরকারি ভবনকে অস্থায়ী আদালত ঘোষণা করে এ মামলার বিচার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
তদন্তের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়:
মামলা দায়েরের পর প্রথমে মতিঝিল থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করে গ্রেনেড হামলা ঘটনার। পরে মামলাটি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারা কিছুদিন তদন্ত চালানোর পর মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে। সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ পর্যায়ক্রমে তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়ে মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সিআইডি’র এ তিন কর্মকর্তাকেই অধিকতর তদন্তে আসামি করা হয়েছে মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অভিযোগে।
ডিবি থেকে সিআইডি’র কাছে তদন্তের দায়িত্বভার দেওয়ার পর তদন্ত শুরু করেন সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন। পরে সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ও সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ এ মামলার তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তদন্ত শুরুর কয়েকদিন পরই নোয়াখালীর সেনবাগের জজ মিয়া নামের এক যুবককে গ্রেফতার করে গ্রেনেড হামলার রহস্য উদঘাটনের দাবি করেন সিআইডি’র কর্মকর্তারা। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদসহ আরও কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামীলীগের ওই সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল বলে জজ মিয়া আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
তদন্তের তৃতীয় পর্যায়:
তদন্তের এ পর্যায়ে এসেই আসল ঘটনা বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ২০০৭ সালে ১/১১-এর পটপরিবর্তনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার নতুন করে এ মামলার তদন্তের নির্দেশ দেয়। ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের পর ২০০৯ সালের ২৫ জুন আদালতের কাছে এ মামলার অধিকতর তদন্তের আবেদন জানান রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে ওই বছরের ৩ আগস্ট আদালত অধিকতর তদন্তের আবেদন মঞ্জুর করেন। অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দকে।
অধিকতর তদন্ত শেষে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ ও চারদলীয় জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ আরও ৩০জনকে অভিযুক্ত করে ২০১১ সালের ২ জুলাই আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন আবদুল কাহার আকন্দ।
অধিকতর তদন্তে গ্রেনেড হামলার সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) পাশাপাশি হাওয়া ভবনের সংশ্লিষ্টতাও খুঁজে পান নতুন তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ। হাওয়া ভবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীরা হুজির জঙ্গিদের ব্যবহার করে এ হামলা চালিয়েছে বলে তিনি অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন। একইসঙ্গে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের প্রভাবশালী নেতা, মন্ত্রী ও কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান এবং সিআইডির কয়েকজন কর্মকর্তা মামলাটিকে ভিন্নখাতে নিতে জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছেন বলেও অভিযোগ আনেন এই তদন্ত কর্মকর্তা। হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ কয়েকজন জঙ্গি নেতার জবানবন্দিতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমানসহ অন্যদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় বলে অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন।
আদালতে অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দেওয়ার কয়েকদিন আগে তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহার আকন্দ এ মামলার সাবেক তিন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদের বিরুদ্ধে মামলার আলামত নষ্ট ও তদন্ত ভিন্নখাতে নেওয়ার অভিযোগে মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্র দেওয়ার দুদিন পর ২০১১ সালের ৪ জুলাই পুলিশের সাবেক আইজি আশরাফুল হুদা, খোদা বক্স চৌধুরী ও শহুদুল হক এবং ৬ জুলাই সিআইডির সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ও আবদুর রশিদ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তাদের প্রত্যেককেই তখন কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কয়েক মাস জেল খাটার পর তারা সবাই জামিনে মুক্তি পান।
সম্পূরক অভিযোগপত্রে আবদুল কাহার আকন্দ বলেন, ২০০০ সালের জুলাই মাসের শুরুর দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউনহল সুপার মার্কেট সংলগ্ন একটি অফিসে গোপন বৈঠক করে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার নীল নকশা চূড়ান্ত করে জঙ্গিরা। অন্যদিকে, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর সহোদর মাওলানা তাজ উদ্দিন লস্কর-ই-তৈয়্যেবা, তেহরিক-ই-জিহাদ আল ইসলামি এবং হিজবুল মুজাহিদিনের সঙ্গে জড়িত। তার সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জমান বাবরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ২০০৪ সালের প্রথম দিকে বনানীর হাওয়া ভবনে তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরীর সঙ্গে বিশেষ বৈঠক করে জঙ্গিরা। পরিকল্পনা অনুযায়ী এ বছরের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালায় তারা। ১৩ থেকে ১৪ টি আর্জেস গ্রেনেড সেদিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে বিস্ফোরিত হয়েছিল বলে জানান এই তদন্ত কর্মকর্তা।
অধিকতর তদন্তে আবদুল কাহার আকন্দ আরও বলেন, আওয়ামী লীগ, প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঘোর বিরোধী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ও সমমনা সাম্প্রদায়িক কিছু রাজনৈতিক দল পরিকল্পিতভাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে। আফগানিস্তানে গিয়ে তালেবানের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেওয়া মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মুফতি আবদুল হান্নান, মাওলানা শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা সাব্বির, মাওলানা শেখ ফরিদ, হাফেজ ইয়াহিয়া, মাওলানা আবু বকর, মাওলানা তাজ উদ্দিন, হাফেজ আবু তাহের ও হাফেজ জাহাঙ্গীর বদর এ হামলায় অংশ নেয়। হামলার সার্বিক সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেন মুফতি আবদুল হান্নান। -বাংলা ট্রিবিউন
২১ আগস্ট, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম