শুক্রবার, ০৯ অক্টোবর, ২০১৫, ০৯:১৭:২৫

আটককৃতদের পরিবারের দাবি, ‘রাজনৈতিকভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা’

আটককৃতদের পরিবারের দাবি, ‘রাজনৈতিকভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা’

নিউজ ডেস্ক : রংপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে জাপানি নাগরিক কোনিও হোসি হ্ত্যার ক্লু ও মোটিভ পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন তদন্ত কমিটির প্রধান রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি হুমায়ুন কবির।

এদিকে ঘটনার পরপরই আটক ৪ জনের মধ্যে ১ জনকে এই হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলেও বাকি ৩ জনের বিষয়ে পুলিশ খোলাসা করে কিছু না বলায় উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় আছে তাদের পরিবার।

এছাড়াও এ মামলায় গ্রেফতার রিমান্ডে নেয়ার মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ উন নবী খান বিপ্লবের পরিবার দাবি করেছে রাজনৈতিক কারণেই তাঁকে এই মামলায় জড়ানো হয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র  সরফুদ্দীন আহম্মেদ ঝন্টু জানান,  বৃহস্পতিবার বেলা ১ টার দিকে জাপান দূতাবাস থেকে ফাস্ট সেক্রেটারী আমাকে ফোন করে বলেন, রংপুরে কোনিও হোসির লাশ দাফন করতে হলে কি করতে হবে। দাফন করার জন্য কী কী প্রসিডিউর। কী কী করতে হবে। আমি বলেছি মুসলমান হলে তার কাগজপত্র দিতে। এরপর জানাযা ও দাফন কিভাবে করতে হবে তা জানিয়েছি তাঁকে। জাপানী দূতাবাস যদি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও  যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তাহলে তাঁকে মুন্সিপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হবে। এজন্য প্রক্রিয়া শুরু হলে আজ তার লাশ দাফন হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে জানান মেয়র।

মেয়র আরও বলেন, আমি ওই ফোন কলারকে আরও বলেছি, আমি পত্রিকায় দেখেছি, টিভিতে দেখানো হয়েছে। সবই আমি দেখেছি। কিন্তু আমার কাছে কোন প্রমাণ নাই। উনি মুসলিম অর নট। প্রমাণ আমার হাতে পৌঁছালে ব্যবস্থা নেয়া হবে আগামী কালকে। স্ট্যাম্পের উপর লিখে নিয়ে অর্ডার দিয়ে দেব, ইয়েস তোমরা এখন দাফন করতে পার মুসলমান শরিয়াহ অনুযায়ী।

কোনিও হোসির লাশ ময়না তদন্ত শেষে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গের হিমঘরে রাখা হয়েছে।

এদিকে জাপানী নাগরিক কোনিও হোসি হ্ত্যা মামলায় স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেলের ছোট ভাই রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ উন নবী খান বিপ্লবকে রাজনৈতিক কারণে জড়ানো হয়েছে বলে দাবি করেছে তার পরিবার।

তার রিমান্ড বাতিল করে নিঃশর্ত মুক্তিও দাবি করেছেন তারা। বৃহস্পতিবার দুপুরে নগরীর গুপ্তপাড়ায় খান ম্যানসনে সাংবাদিক সম্মেলনে এ দাবি করেন বিপ্লবের মা বেগম আখতার বানু, স্ত্রী শিরিন আখতার দিপা ও কণ্যা সিদরাদুল মুনতাহা নেহা।

বেগম আখতার বানু সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, বিপ্লব ওপরে দোতালায় থাকে। বিকেল পর্যন্ত ঘুমায়। ওর ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। ওই দিন আমি ওকে একবার ডেকে খাওয়াই। পরে মেয়েটা স্কুল থেকে এসে উপরে যায়। কিন্তু বিকেল ৫ টার দিকে হঠাৎ করে দুইজন লোক পুলিশ পরিচয় দিয়ে ওকে তুলে নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার সময় বলে আপনারা থানায় দেখা করেন। আমরা তখন মনে করি তাকে রাজনীতির মামলায় জড়ানো হবে।

কিন্তু দুই দিন পর আমরা টিভির মাধ্যমে জানতে পারলাম আমার সন্তানকে জাপানি হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ও আমার ছোট ছেলে, আমাদের পরিবার রাজনৈতিক পরিবার হলেও ও রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় নই। ওই জাপানির সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের পরিবার বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়ার কারণে বিপ্লবকে ওই মামলায় জড়ানো হয়েছে বলে হুহু করে কাঁদতে থাকেন এই বৃদ্ধ মা।

সরকারী কুশলীর বক্তব্য ও মামলার এজহারে বর্ণিত কোনিও হোসি যেখানে খুন হয়েছে সেই আলুটারীতে বিপ্লবদের আগের বাড়ি সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বিপ্লবের মা বলেন, আমার শ্বশুড়বাড়ি জামালপুর, আমার মায়ের বাড়ি বগুড়ায়। আমার স্বামী খান সাহেব কারমাইকেল কলেজ গণিতের প্রফেসরি করার সুবাদে আমরা রংপুরে প্রথমে এসে উঠি কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসের কোয়ার্টারে।

পরে আমার স্বামী রিটায়ার্ড হয়ে গেলে গুপ্তপাড়ায় বাড়ি করি। এখানেই ৪০/৫০ বছর ধরে আছি। আলুটারীতে বাড়ি থাকা তো দূরের কথা ওই নামটিই আমরা জানলাম পত্রপত্রিকার মাধ্যমে। তিনি প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এই হত্যা মামলা থেকে বিপ্লবকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানিয়ে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করার আহবান জানান।

সাংবাদিক সম্মেলনে বিপ্লবের স্ত্রী স্থানীয় ইন্টারন্যাশনাল গ্রামার স্কুলের শিক্ষিকা শিরিন আখতার দিপা জানান, দীর্ঘ ২২ বছর ধরে আমি আমার স্বামীর সংসার করছি। প্রত্যেকটি বিষয়ে তার সাথে আমার শেয়ার হয়। ওই জাপানি ভদ্রলোককে আমার স্বামী কোনোদিন চিনতোও না, জানতোও না। তার সাথে আমার স্বামীর দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু বিএনপি পরিবারের সন্তান হওয়ার কারণেই বিপ্লবে ওই মামলায় জড়ানো হয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তার স্বামীর রিমান্ড বাতিল করে নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন।

বিপ্লবের একমাত্র কণ্যা রংপুর মিলেনিয়াম স্টারস স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী সিদরাতুল মুনতাহা নেহা বলেন, আমার বাবা ঘুমেই ছিলেন। আমি স্কুল থেকে এসে বাবাকে ওপরে জড়িয়ে ধরে নীচে নেমেছি। আমার বাবা টিভিও দেখেন নি। ওই জাপানি যে হত্যা হয়েছে সেটি তিনি জানেন না। কিন্তু তারা সরাসরি ওপরে গিয়ে বাবাকে তুলে নিয়ে গেলো। কাঁদতে কাঁদতে নেহা বলেন, আমার বাবা অসুস্থ । প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি আমার বাবাকে যেন রিমান্ড বাতিল করে নি:শর্ত মুক্তি দেয়া হয়।

এদিকে রংপুরে দুর্বৃত্তদের গুলিতে জাপানি নাগরিক কোনিও হোসি হ্ত্যার ক্লু ও মোটিভ পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন তদন্ত কমিটির প্রধান রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি হুমায়ুন কবির। তিনি বলেছেন, হত্যাকান্ডের ক্লু পাওয়া গেছে, যার সুত্র ধরে তদন্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। খুব শীঘ্রই এই মামলার মোটিভ পরিষ্কার করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। তবে কি ক্লু ও মোটিভ পাওয়া গেছে তারা জড়িত এ বিষয়ে তদন্তের স্বার্থে অপেক্ষা করতে বলেছেন সাংবাদিকদের।

অন্যদিকে ঘটনার পরপরই আটক ৪ জনের মধ্যে ১ জনকে এই হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হলেও বাকি ৩ জনের বিষয়ে পুলিশ খোলাসা করে কিছু না বলায় উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় আছে তাদের পরিবার। শনিবার রংপুর মহানগরীর উপকণ্ঠে কাউনিয়ার কাচু আলুটারী এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন জাপানী নাগরিক কোনিও হোসি।

ঘটনার পরপরই আটক করা হয় ভাড়াবাসার মালিক জাকারিয়া বালা, হোসির ব্যবসায়িক অংশিদার হুমায়ুন কবির হীরা রিকশা চালক মোন্নাফ ও ঘটনাস্থলের পাশের বাড়ির মালিকের ছোট ভাই মুরাদকে।

এরমধ্যে হীরাকে সোমবার ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে ১০ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয। এছাড়াও একই মামলায় গ্রেফতার ও  রিমান্ডে নেয়া হয় ঘটনার দিন বিকেলে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া রংপুর মহানগর বিএনপির সদস্য রাশেদ উন নবী খান বিপ্লবকে। ঘটনার পর আটক জাকারিয়া বালা অসুস্থ্য হয়ে রংপুর মেডিক্যালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আর মুরাদ ও মোন্নাফের বিষয়ে কিছুই জানতে পারছেন না তাদের পরিবার। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আর আতংক বিরাজ করছে এসব পরিবারে।

আটক মুরাদের ভাবি নুরজাহান বেগম জানান, আমার স্বামী ব্যবসার কাজে বাইরে থাকে। সব কিছু দেখাশুনা করে আমার দেবর মুরাদ। ঘটনার সময় আমার দেবর বাড়ির অদূরে গরুকে ঘাস খাওয়াচ্ছিলেন। কিন্তু পুিলশ তাকে তুলে নিয়ে গেছে। আমাদের সব মোবাইলও নিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত আমরা মুরাদের কোন খোঁজ পাই নি। তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কোথায় রাখা হয়েছে কিছুই জানি না আমরা। থানায় খোঁজ নিয়েও কোনো সন্ধান পাই নি। তিনি অবিলম্বে মুরাদকে মুক্ত করে বাড়িতে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান।

অন্যদিকে পাটবাড়ি এলাকার রেললাইনের বস্তির বাসিন্দা রিকশাওয়ালা মোন্নাফের মা ছকিনা বেওয়া জানান, মোন্নাফ রিকশা চালায়। শহর থেকে রিকশায় উঠেছে। তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কোথায় রাখা হয়েছে। আমরা কিছুই জানি না। মোন্নাফকে আটক করার কারণে পরিবারটি খেয়ে না খেয়ে জীবন যাপন করছে। একমাত্র রোজগারের মানুষ ছিলেন তিনি।

মোন্নাফের স্ত্রী জানান, আমার স্বামী নির্দোষ। রিকশা চালিয়ে চাল ডাল কিনে আনে। তার পর সন্তান সন্ততিসহ রান্না করে খাই। পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে কোথায় রাখলো। আমরা কোনো খোঁজ খবর পাচ্ছি না। অবিলম্বে তাঁকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান এই স্ত্রী।
৯ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে