রবিবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৫, ০১:০৪:৪৩

কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জে সরকার

কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জে সরকার

জুলকার নাইন : সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া জটিল কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ সাবলীলভাবে মোকাবিলা করার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ফের একই ধরনের চ্যালেঞ্জে পড়েছে। মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে দুই বিদেশি নাগরিক খুন হওয়া, আইএসের কথিত দায়স্বীকারের বহুল প্রচার এবং আগাম তথ্যের ভিত্তিতে একের পর এক বিদেশি দূতাবাসের ভ্রমণ সতর্কতার পরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতেই এ চ্যালেঞ্জের শুরু। বিশ্লেষকরা বলছেন, যতটা স্বাভাবিকভাবে সাধারণ অপরাধ প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত করে পরিস্থিতির উত্তরণের চেষ্টা করা হচ্ছিল তা আর হচ্ছে না। চোখে পড়ার মতো তৎপরতা শুরু করেছে প্রভাবশালী কয়েকটি পশ্চিমা রাষ্ট্র।

ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় দুই খুনের ঘটনার ব্যাপক প্রচারে বিদেশিদের কাছে বাংলাদেশের অস্থিতিশীলতার বার্তা পৌঁছে গেছে। পাশাপাশি সব ধরনের নিরাপত্তার আশ্বাস ও ব্যবস্থা নিয়েও আশ্বস্ত করা যাচ্ছে না বিদেশিদের। যেখানে সরকার আশা করছিল রাষ্ট্রগুলো তাদের ভ্রমণ সতর্কতা সরিয়ে নেবে, সেখানে নতুন করে নির্বিচারে হামলার শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। আবার সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার বাংলাদেশে আইএস নেই বলে দাবি করা হলেও এই ভয়ঙ্কর জঙ্গি সংগঠনের কানেকশনের কথাই সামনে আনছে পশ্চিমারা।

সরকারের একটি অংশ মনে করছে, ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবেই পশ্চিমা প্রভাবশালী রাষ্ট্রের এমন অবস্থান। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য থেকেই এ ধরনের অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারকে সামনে আসা নতুন চ্যালেঞ্জ অনানুষ্ঠানিক কূটনৈতিক প্রক্রিয়াতেই মোকাবিলা করতে হবে। এক্ষেত্রেও বিশ্ব কূটনীতির বিদ্যমান মেরুকরণ প্রভাব বিস্তার করবে বলে মনে করছেন তারা। সেই সঙ্গে সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, সবার আগে অতি দ্রুত চিহ্নিত করতে হবে প্রকৃত খুনিদের। নিশ্চিত করতে হবে যেন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি বলেছেন, এটা কোনো সংকট নয়। এটা সাময়িক সমস্যা। খুব দ্রুতই এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। প্রয়োজনে বিদেশি কূটনীতিকদের ডেকে আবার কথা বলে পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করা হবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিদেশি রাষ্ট্রগুলো কোনো রেড অ্যালার্ট জারি করেনি। তারা ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে। আর এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের আরও অনেক দেশেই হামলার আশঙ্কায় এই সতর্কতার কথা বলা হয়েছে।

সূত্রের খবর, বিদেশিদের নিরাপত্তা নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যেও আছে মেরুকরণ। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ার ভ্রমণ সতর্কতার সারিতে যোগ দেয়নি রাশিয়া, চীন ও মুসলিম বিশ্ব। জাপান তার নাগরিক মৃত্যুর পর উদ্বিগ্ন হয়ে সতর্কতা জারি করলেও অন্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে একসঙ্গে কোনো তৎপরতায় নেই। তারা নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থা গ্রহণ করে চলেছেন। চীনের রাষ্ট্রদূত স্পষ্ট করেই ঘোষণা দিয়েছেন, নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সতর্কবার্তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই তার দেশের।

মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের আরব ডিপ্লোমেটিক কোরও মনে করে, বাংলাদেশে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। আবার যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া প্রায় অভিন্ন অবস্থানে থেকে আইএসের সম্পৃক্ততায় জোর দিলেও অন্যরা তা মনে করে না। আরব দেশগুলোও মনে করে না বাংলাদেশে আইএস আছে। আর ভারতের গোয়েন্দারা তো এই দুই ঘটনার পেছনে জামায়াতের ইন্ধন দেখছেন বলে নয়াদিলি্লর গণমাধ্যম খবর দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব কূটনীতিক ওয়ালিউর রহমানের মতে, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো যে নিরাপত্তা ঝুঁকির কথা বলে উদ্বিগ্ন হচ্ছে এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্র একটি ঝুঁকি দেখছে। ওয়াশিংটনের গোয়েন্দা তথ্য মতে, এই অঞ্চলের দেশগুলোতে পশ্চিমা স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট স্থাপনা বা ব্যক্তিদের ওপর হামলা হতে পারে। তাই এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য চাপ ভাবার সুযোগ নেই। তবে বাংলাদেশকে সতর্ক হতে হবে। আরও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কর্তব্য পালন করতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

তিনি বলেন, এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেন কোনো ক্ষতিকর প্রভাব না ফেলে সেজন্য অবশ্যই সরকারকে জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ঘটনা থেকে বিশ্বের প্রভাবশালী কেউ কেউ লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের অপতৎপরতাকে ঠেকাতে হবে আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন বলেন, এই দুই ঘটনায় বাংলাদেশের অস্থিতিশীলতার বার্তা বিশ্বে পৌঁছে গেছে। আবার নিজ দেশের নাগরিকের নিরাপত্তা নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রগুলো যে উদ্বিগ্ন হবে তারও যৌক্তিকতা আছে।

তাদের নাগরিক খুন হচ্ছে, তদন্তে কোনো অগ্রগতি পাওয়া যাচ্ছে না অথচ প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের ওপর দোষ চাপিয়ে একের পর এক বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, এগুলো তো দূতাবাসগুলো দেখছে। তারা তো আর বসে থাকবে না। কূটনীতিকরা তো তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের স্বার্থই দেখবেন, তাদের নীতিই বাস্তবায়ন করার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। তাই শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্বে থাকায় সরকারকেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। তিনি বলেন, দেশের ভাবমূর্তির বিষয় সামনে চলে আসায় অবশ্যই কূটনৈতিক ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, গত মাসের শেষদিকে পশ্চিমাদের ওপর জঙ্গি হামলার ঝুঁকি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের অন্যত্রও ছিল। বিশ্বের আরও প্রায় দুই ডজন দেশের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি ছিল বাংলাদেশের নাম। এ তথ্যের ভিত্তিতেই গত ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সফরে সতর্কতা জারি করে অস্ট্রেলিয়া। স্থগিত করা হয় অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের সফর। ঢাকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেখতে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিরা ঢাকায় থাকাকালীন গত ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশানে ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা ও ৩ অক্টোবর রংপুরে জাপানের নাগরিক হোশি কোনিও খুন হওয়ায় বাংলাদেশ শিরোনাম হয় বিশ্বমিডিয়ায়। পরোক্ষভাবে বাংলাদেশকে অনিরাপদ হিসেবে চিহ্নিত করে জারি করা হয় ভ্রমণ সতর্কতা।

কূটনৈতিক সূত্র জানায়, যেসব দেশ বাংলাদেশে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে বেশির ভাগ দেশই তাদের নিরাপত্তা সতর্কতাকে লেভেল-২-এ উত্তীর্ণ করেছে। এই লেভেল-২ বলতে বোঝানো হয় সংশ্লিষ্ট স্থানে আইনের শাসন দুর্বল এবং সহিংস অপরাধের ঘটনা সচরাচরই ঘটে থাকে। এই লেভেলে সতর্কতার মাধ্যমে ওই স্থানে ভ্রমণের ক্ষেত্রে পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা থাকে না, তবে সর্বদাই ব্যক্তিগত সতর্কতার বিষয়ে সর্বোচ্চ সজাগ থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। আবার বাংলাদেশ সফর নিয়ে পুনরায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ জানায় নিজ নিজ রাষ্ট্রের নাগরিকদের। এতেই যা হওয়ার হয়ে যায়।

বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সরকারি, বেসরকারি প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও উন্নয়ন কর্মীদের সফর একে একে বাতিল হওয়া শুরু হয়। দেশের মধ্যে থাকা বিদেশিরা ফিরে যাওয়া শুরু করেন বা নিজেদের গুটিয়ে রাখেন। যার প্রভাব ইতিমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের পর্যটন ও গার্মেন্ট ব্যবসায়। সরকার এই খুনের ক্ষেত্রে আইএসের দায়স্বীকারের ঘটনা খতিয়ে দেখার কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশে কোনো আইএস জঙ্গি নেই বলে জানায়। কিন্তু আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দেশের রাষ্ট্রদূত এর পেছনে আইএসের জড়িত থাকার কথাই পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত করেন। আবার জাপানের কেবিনেট সচিবও 'আইএস এখানে জড়িত এতে কোনো সন্দেহ নেই' বলে বিবৃতি দেন।

সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত বইমেলার বাইরে জঙ্গিদের হাতে বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক ব্লগার অভিজিৎ রায় খুন হওয়ার পরই পশ্চিমা কূটনীতিকরা বাংলাদেশে বিদেশি নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু এরপর নানা ঘটনা প্রবাহে সেই আলোচনা গুরুত্ব না পেলেও এখন পরিস্থিতি হয়েছে ঘোলাটে। বিদেশিরা হামলার আগাম শঙ্কা সরকারকে জানানোর কথা বললেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যেই কোনো আগাম তথ্য বিদেশিরা দেয়নি বলে দাবি করছেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই অস্বীকার বা সমন্বয়হীনতায় তথ্য না পৌঁছানো এবং খুনের পেছনে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে দায়ী করে সরকারের ঊধর্বতন মহলের একাধিক ব্যক্তির কণ্ঠ থেকে উৎসারিত একের পর এক বক্তব্যের খোলামেলা সমালোচনাও করছেন কূটনীতিকরা। বিভিন্ন ঘরোয়া আলোচনায় নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত উল্লেখ করে পশ্চিমা কূটনীতিকরা বলছেন, দুই বিদেশি খুনের তদন্তকেও রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে নেওয়ার একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত এ ধরনের বক্তব্য। এতে তদন্তও প্রভাবিত হতে পারে বলে মনে করছেন পশ্চিমা কূটনীতিকরা।-বিডিপ্রতিদিন
১১ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে