মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৫, ০২:০৪:৫৪

বিদেশি খুনে অপরাজনীতি

বিদেশি খুনে অপরাজনীতি

শাহজাহান আকন্দ শুভ : দুই বিদেশি নাগরিক খুনের পেছনের রহস্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে ধাপে ধাপে। দুই খুনের মধ্যে ঢাকার গুলশানে নিহত ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লা খুনের মামলা তদন্তে বেশি অগ্রগতি হয়েছে। তাভেল্লা সিজার খুনে কারা পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা এবং হত্যাকাণ্ডে কারা মাঠ পর্যায়ে সরাসরি অংশ নেয় তার অনেক তথ্যই এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই বিদেশি খুনের পেছনেই অপরাজনীতি কাজ করেছে। দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। হত্যাকাণ্ড চালাতে দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র হয়েছে বলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া দুই বিদেশি নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করে আইএসের নামে যে দুটি টুইট বার্তা দেওয়া হয়েছিল তা বাংলাদেশ থেকেই করা হয় বলে নিশ্চিত হয়েছে গোয়েন্দারা।

এদিকে সিলেটের অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার ঘটনায় যাদের সিআইডি গ্রেপ্তার করেছে তাদের সঙ্গে গুলশানে ইতালীয় নাগরিক হত্যার ‘যোগসূত্র’ পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। যে কারণে ওই ঘটনায় আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করা মান্নান রাহিসহ দুই আসামিকে রিমান্ডে আনে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ইতালির নাগরিক তাভেল্লা সিজারকে রাজধানীর গুলশানে গুলি করে হত্যা করা হয়। ৩ অক্টোবর একই কায়দায় রংপুরে হত্যা করা হয় জাপানি নাগরিক কুনিও হোশিকে। তাভেল্লা সিজার হত্যাকা-ের রহস্য বের করতে মাঠে নামে পুলিশ, র‌্যাব, পিবিআইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছু আলামত ও গুলশান এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করে। খুনিদের চেহারা ও গতিবিধি সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে নেয় জবানবন্দি।

এছাড়া কয়েকশ সন্দেহজনক টেলিফোন নাম্বারের কল ডিটেইল রেকর্ড (সিডিআর) সংগ্রহ করে। এরপর একে একে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। শুধু ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশই এ পর্র্যন্ত তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডে অর্ধ শতাধিক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

তাদের মধ্যে কয়েকজনকে আটকও করে সংস্থাটি। ওই ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ, ঘটনার কিছু পারিপার্শিক তথ্য উপাত্ত জব্দ করে গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা তাভেল্লা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে যারা মাঠ পর্যায়ে সরাসরি অংশ নিয়েছিল তাদেরও শনাক্ত করেছে। তাদেরই বেশ কয়েকজনকে ধরতে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ করা ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজন জঙ্গিও রয়েছে। কিন্তু এদের বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা মুখ খুলতে নারাজ।

গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম সোমবার বলেছেন, তদন্ত চলছে। কারা কেন ইতালীয় নাগরিককে খুন করেছে তার রহস্য উদঘাটনে জোর চেষ্টা চলছে।

সূত্র জানায়, তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের রহস্য বের করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জাপানি নাগরিক খুনেরও যোগসূত্র পেয়েছে। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি ঘটনার তথ্যও জানতে পেরেছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সামনে ষড়যন্ত্রকারীদের আরও কী কী মিশন রয়েছে সে সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, তাভেল্লা হত্যা, কুনিও হত্যা, ঈশ্বরদীতে খ্রিস্টান মিশনের যাজককে হত্যার চেষ্টা এবং রাজধানীতে পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খান হত্যা ধারাবাহিকভাবে ঘটে। এর সঙ্গেই যুক্ত হয় বিভিন্ন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সতর্কতা। এসবের পেছনে গভীর চক্রান্তের তথ্যই উঠে আসছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের তদন্তে।

পুলিশের তদন্তকারীদের ধারণা, দুই বিদেশি খুনের পরিকল্পনাকারী চক্রটি এক। কিন্তু ঘাতক ভিন্ন। বেশ কয়েকজন সন্দেহজনক ব্যক্তির সেলফোনের কল লিস্ট পর্যালোচনা করে এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এছাড়া বাংলাদেশকে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল করে তুলতে যে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটানোর প্রয়াস চলছে সে ব্যাপারে নতুন কিছু তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা।

এদিকে বিডিনিউজ জানায়, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে ব্লগার হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, সেই একই ঘাতকদল ঢাকা ও রংপুরে দুই বিদেশি নাগরিককে হত্যার পেছনে রয়েছে বলে ধারণা করছেন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এসব হত্যাকাণ্ডের পর আইএস বা আল কায়েদার নামে দায় স্বীকার করে  যেসব বার্তা ইন্টারনেটে এসেছে তা ‘আপলোড’ করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই।

এসব হত্যাকাণ্ডের তদন্তে গোয়েন্দা পুলিশকে সহযোগিতা দিচ্ছেন তথ্য-প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের সাইবার নিরাপত্তা প্রকল্পের ফোকাল পয়েন্ট তানভীর হাসান জোহা।

তিনি বলেছেন, দায় স্বীকারের বার্তা যে বাংলাদেশ থেকেই ইন্টারনেটে তোলা হয়েছে সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। টুইটার কর্তৃপক্ষকেও বিষয়টি জানানো হয়েছে।

ইতালীয় নাগরিক হত্যায় আইএসের নামে যে বার্তাটি এসেছিল, তা গুলশান থেকেই দেয়া হয়। গার্মেন্টসের ব্যবসা করে এমন একটি কারখানার করপোরেট ইন্টারনেট লাইন ব্যবহার করা হয়েছে এতে। ওই আইএসপির ঠিকানাও সংগ্রহ করা গেছে।

ঘটনার সময় কে ওই আইপি ঠিকানা ব্যবহার করেছিল তার তথ্য গোয়েন্দারা এখন খুঁজে দেখছেন বলে জানান তিনি।

তানভীর হাসান জোহা বলেন, ইলেকট্রনিক এভিডেন্সে দেখা গেছে, তারা ‘স্বঘোষিত’ আইএস সদস্য এবং বিভিন্ন সময়ে সৌদি প্রতিষ্ঠান থেকে তারা তহবিলও সংগ্রহ করেছে। তারা সিরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।

ইতালীয় নাগরিক তাভেল্লা সিজার ও জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের পর পরই আইএস হত্যার দায় স্বীকার করে বলে খবর দেয় জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। এ পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থানের আশঙ্কা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়।
 
তাভেল্লা সিজার হত্যার দায় স্বীকার করে আইএসের নামে বিবৃতি দেয়ার ঘটনায় গুলশান এলাকার একজনকে ইতোমধ্যে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে গোয়েন্দারা।

ব্লগার নিলয় হত্যার পর দায় স্বীকার করে আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাদেশ শাখা ‘আনসার আল ইসলাম’ এর নামে ইন্টারনেটে যে বিবৃতি এসেছিল, তা আপলোড হয় চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থেকে। একই ভাবে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যার দায় স্বীকারের বার্তা চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে আপলোড করা হয়েছিল বলে দাবি করেছেন তানভীর হাসান জোহা।-দৈনিকআমাদেরসময়
১৩ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে