মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৫, ০৩:০৭:৫৪

যে কারণে সেই রাতে বন্ধ ছিল সড়কবাতি

যে কারণে সেই রাতে বন্ধ ছিল সড়কবাতি

সাহাদাত হোসেন পরশ : ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যাকাণ্ডের পর একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, ঘটনার সময় গুলশানের ৯০ নম্বর রোডের সড়কবাতি বন্ধ ছিল। তাভেলাকে খুনের কয়েক মিনিট পর বাতি জ্বলে ওঠে। অনেকে ধারণা করছিলেন, তাহলে কি অন্ধকারে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করতে সড়কবাতি বন্ধ রাখা হয়েছিল? তাভেলা হত্যা-রহস্য উদ্ঘাটনে গোয়েন্দারা এখন পর্যন্ত যেসব বিষয় মাথায় রেখে নিবিড় অনুসন্ধান করছেন, তার মধ্যে ছিল সড়কবাতির ব্যাপারটি।

প্রতিবেদকের পক্ষ থেকেও বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। তাতে আপাতত বেরিয়ে এসেছে তাভেলা হত্যাকাণ্ডের সময় সড়কবাতি বন্ধ থাকার বিষয়টি পূর্বপরিকল্পনার অংশ নয়। তাহলে কী ঘটেছিল সেই দিন! এ প্রশ্নের উত্তর মিলেছে। উত্তর সিটি করপোরেশনের লাইনম্যান নাসিরুল কবির।

গুলশান ও নর্দা এলাকায় তিনি সড়কবাতি সুইচবোর্ড অন-অফ করার দায়িত্বে নিয়োজিত। তার আওতায় ৩৫টি সুইচবোর্ড রয়েছে। একেকটি বোর্ডের আওতাধীন অন্তত ৩৫টি সড়কবাতি। সব মিলিয়ে দিনে সহস্রাধিক সড়কবাতি সুইচবোর্ড অন-অফের দায়িত্ব তার ওপর। প্রায় প্রতিদিন বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে তিনি গুলশানে সড়কবাতির সুইচবোর্ড চালু শুরু করেন। সাইকেল চালিয়ে এ কাজ করতে তার সময় লাগে অন্তত এক ঘণ্টা।

গত ২৮ সেপ্টেম্বর কালাচাঁদপুর এলাকার সড়কবাতির সুইচবোর্ড চালু করেন। এরপর একে একে যান ৭২, ৭৩, ৬৯, ৬৮, ৫৮, ৫৬, ৫০, ৫১ নম্বর সড়ক, বনানীর মূল সড়ক, গুলশান ২ নম্বর, ৮৪ ও ৮৬ নম্বর সড়কে। ৯০ নম্বর সড়কের মাথায় যে স্পটে তাভেলাকে হত্যা করা হয়েছে তার ২৫ মিটারের মধ্যে পাঁচটি সড়কবাতি। ওই রাস্তার পূর্ব অংশের সড়কবাতি নিয়ন্ত্রিত হয় ৮৬ নম্বর সড়কে স্থাপিত সুইচবোর্ডের মাধ্যমে। ৮৪ নম্বর সড়কের সুইচবোর্ডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় ৯০ নম্বর সড়কের পশ্চিম অংশের বাতি। কালাচাঁদপুর থেকে সুইচবোর্ড চালু শুরু করে ৮৪ নম্বর সড়কে পৌঁছতে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ লেগে যায় নাসিরুলের। ওই এলাকার সড়কবাতি চালু হওয়ার কয়েক মিনিট আগে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। তাই হত্যাকাণ্ডের সময় ওই এলাকা অন্ধকারে ছিল।

সিটি করপোরেশনের কর্মী নাসিরুল প্রতিবেদককে বলেন, নব্বইয়ের দশকে তিনি বিএনপির সমর্থক ছিলেন। তবে তার কোনো পদ-পদবি ছিল না। এখন তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জাতীয় শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি মাহফুজুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশে সড়কবাতির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীসহ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়েছে। ফিউজ নষ্ট না হলে একই এলাকায় কোথাও বাতি জ্বলবে আবার কোথায় নিভবে- এটি সম্ভব নয়। কারণ এটা পুরোপুরি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পদ্ধতিতে করা হয়।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপসহকারী প্রকৌশলী আবদুল হালিম এই প্রতিবেদককে বলেন, ৩৩ বছর ধরে নাসিরুল গুলশান এলাকায় একই কাজে নিয়োজিত। তিনি মাস্টাররোলের কর্মচারী। তার আওতায় ৩৫টি সুইচবোর্ড রয়েছে। প্রায় একই নিয়মে তিনি প্রতিদিন সুইচবোর্ড নিয়ন্ত্রণ করেন। ঘটনার দিনও এর কোনো ব্যত্যয় হয়নি। গুলশানে সড়কবাতির রহস্য উদ্ঘাটনে একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিগত তদন্তও করেছেন গোয়েন্দারা। নাসিরুলের দেওয়ার তথ্যের সঙ্গে প্রযুক্তিগত তদন্তে এখনও কোনো গরমিল পাওয়া যায়নি।

কোনো আসামি গ্রেফতার হয়নি : এদিকে তাভেলা হত্যাকাণ্ডের ১৪ দিন পার হলেও এখনও কোনো আসামি গ্রেফতার করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে দুই বিদেশিকে হত্যার পর ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নামে যে টুইটবার্তা দেওয়া হয়েছিল, তার রহস্য শিগগিরই উন্মোচন হচ্ছে। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইট 'সার্চ ফর ইন্টারন্যাশনাল টেররিস্ট এনটিটিস' (এসআইটি)-এর প্রতিষ্ঠাতা রিটা কাৎজ যে সূত্রের মাধ্যমে টুইটবার্তাটি পেয়েছিলেন, সেটিকে দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। অল্প সময়ের মধ্যে জড়িতদের আটক করা সম্ভব হবে। এরই মধ্যে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, রিটার টুইটের আগেই দুই বিদেশিকে হত্যার ঘটনায় বাংলা, আরবি ও ইংরেজিতে টুইট করা হয়। সেটি দুই ধাপ পেরিয়ে রিটার কাছে পৌঁছে। এর পরই রিটা এসআইটিতে টুইট করেন।

গোয়েন্দারা বলছেন, বাংলাদেশকেন্দ্রিক উগ্রপন্থি সংগঠন দেশে তাদের কর্মকাণ্ড ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য এলাকায় একই মতাদর্শের কার্যক্রম প্রচারের জন্য ওয়েবসাইটে নানা প্রচার চালায়। সেখানে বাংলা ভাষায় দুই বিদেশি হত্যার ছয় ঘণ্টা পর টুইট করা হয়েছিল। 'আইএসে'র নামে গুলশান এলাকা থেকে আপলোড একটি ইন্টারনেট বার্তা খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা। এ ছাড়া সন্দেহভাজন একটি পোশাক কারখানার করপোরেট ইন্টারনেট লাইন এবং তার আইএসপির ঠিকানার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সাইবার নিরাপত্তা প্রকল্পের কর্মকর্তারা আইএসের নামে টুইটবার্তার রহস্য বের করতে কাজ করছেন।

ব্লগার নিলয় হত্যার পর দায় স্বীকার করে আল কায়দার ভারতীয় উপমহাদেশের (এআইকিউএস) বাংলাদেশ শাখা 'আনসার আল ইসলামে'র নামে ইন্টারনেটে যে বিবৃতি এসেছিল, তা আপলোড হয় চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থেকে। একইভাবে ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যার দায় স্বীকারের বার্তা হাটহাজারী থেকে আপলোড করা হয়েছিল। দুই খুনির সঙ্গে ব্লগার হত্যাকারীদের কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি-না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এরই মধ্যে এ ব্যাপারে সন্দেহভাজন একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সাইবার নিরাপত্তা প্রকল্পের ফোকাল পয়েন্ট অফিসার তানভীর হাসান জোহা এই প্রতিবেদককে বলেন, দুই বিদেশি হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে প্রযুক্তিগত যেসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে, তা তদন্ত সংস্থাকে দেওয়া হয়েছে।-সমকাল
১৩ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে