শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫, ০৩:১৪:১৬

‌‌দৃষ্টি এখন দলীয় নির্বাচনের দিকে

‌‌দৃষ্টি এখন দলীয় নির্বাচনের দিকে

আশরাফুল হক রাজীব: স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর করতে দলীয়ভাবে নির্বাচন করার নিয়ম সংযোজন করে সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিলেও আরো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারকাজে মনোযোগ নেই সরকারের। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু দল ও দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলেই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হবে না; সংস্কারও আসবে না। কার্যকর সংস্কার আনতে হলে স্থানীয় সরকার পরিষদগুলোকে কার্যকর ও শক্তিশালী করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বেশ কয়েকটি পরিবর্তন আনতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। যেমন, এক দিনে নির্বাচন করে সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমতা আনতে হবে। একই আইনের আওতায় স্থানীয় সরকারের সব ইউনিট পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। উপজেলাকে কার্যকর করতে হলে এমপিকে উপদেষ্টার পদ থেকে সরানোর বিধান যোগ করতে হবে। 'ওয়ার্ড সভা' অনুষ্ঠানের বিধান কার্যকর করতে হবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের মন সংস্কারে নেই। তাদের নজর শুধু দলীয়ভাবে নির্বাচনের দিকে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হবে, এটা নিশ্চিত উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, তবে এ-সংক্রান্ত আইনটি সংসদে পাস হতে হবে। আইন পাস করার সময় কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা উচিত। স্থানীয় সরকারের জন্য একটি একীভূত আইন করা দরকার, যাতে সব স্তর- ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশন অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এখন প্রতিটি স্তরের জন্য রয়েছে আলাদা আইন। এ ছাড়া সব স্তরের নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা দরকার। এতে প্রার্থী, দল ও সরকার- সবার খরচ কমে যাবে। প্রতিটি সংস্থা পাঁচ বছর মেয়াদে কাজ করবে এবং একই সময়ে তাদের মেয়াদ শেষ হবে। ফলে তাদের মধ্যে সমন্বয় সহজ হবে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ বলেন, দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার চালু রয়েছে। অথচ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চলছে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের আদলে। সংসদীয় পদ্ধতিতে প্রথমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং তাঁরাই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন। কিন্তু স্থানীয় সরকারে প্রতিটি ক্ষেত্রে মেয়র বা চেয়ারম্যানই সর্বেসর্বা। পরিষদের হাতে কার্যত কোনো ক্ষমতা নেই। দক্ষ ও যোগ্যরা চেয়ারম্যান বা মেয়র পদের জন্য লড়তেই পছন্দ করেন। তাঁকে কেন্দ্র করেই যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এ ধরনের ব্যবস্থায় নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে না। এখন আইন সংশোধন করে এমন বিধান চালু করা উচিত যাতে সাংগঠনিক কাঠামোতে সংসদীয় পদ্ধতির রীতি অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ ভোটাররা প্রথমে কাউন্সিলর ও সদস্যদের নির্বাচন করবেন। এরপর তাঁদের মধ্য থেকে মেয়র কিংবা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন। এ ধরনের ব্যবস্থায় পরিষদে এমন কয়েকজন সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসবেন যাঁরা চেয়ারম্যান বা মেয়র হওয়ার যোগ্য। তাঁদের উপস্থিতি স্থানীয় সরকারের দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি হারুন অর রশিদ হাওলাদার বলেন, স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করতে হলে সবার আগে আইনগুলোতে সমতা আনা দরকার। আইন অনুযায়ী উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হচ্ছেন সংসদ সদস্যরা। অথচ আর কোনো স্তরেই সংসদ সদস্যরা উপদেষ্টা নন। উপজেলাকে কার্যকর করতে হলে প্রথমেই সংসদ সদস্যদের উপদেষ্টার পদ থেকে সরানোর বিধান যোগ করতে হবে। ঢাকা বিভাগের গাজীপুর জেলার একটি উপজেলার চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বর্তমানে উপজেলা একটি প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠান। কারণ উপদেশ বাধ্যতামূলক হবে এমন উপদেষ্টা তো কাম্য হতে পারে না। এমপিরা স্থানীয় উন্নয়নে অবশ্যই যুক্ত হবেন। কিন্তু এমপিদের উপদেশ অবশ্যই পরিষদের মধ্য দিয়েই দেওয়া উচিত। কিন্তু তাঁরা পরিষদের ধার ধারেন না। তাঁরা যা বলেন তাই পালন করতে হয়। তিনি উপজেলা পরিষদকে 'জগাখিচুড়ি' পরিষদ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাঁর মতে, এমপিদের উপদেশ পরিষদের মাধ্যমে গ্রহণ করলে এমপি-উপজেলা চেয়ারম্যান দ্বন্দ্বও শেষ হবে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'এমপিতন্ত্র, আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমরা আমাদের সংবিধানকে পদদলিত করছি এবং আদালতের নির্দেশও অমান্য করছি। উপজেলা নিয়েও যা হচ্ছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা এখন প্রায় ভেঙে পড়েছে। সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদ থেকে বিযুক্ত করে তাদের সংসদকেন্দ্রিক কার্যক্রমে নিবিষ্ট করা উচিত। জেলা পরিষদের আইনটি সংশোধন ও যুগোপযোগী করে জেলা পরিষদ নির্বাচনের আয়োজন করা দরকার। একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিক ক্ষমতা, দায়দায়িত্ব ও সম্পদ হস্তান্তর করা দরকার। স্থানীয় সরকার আইনগুলোকে সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ও এগুলোতে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য একটি সমন্বিত আইন বা 'আমব্রেলা অ্যাক্ট' প্রণয়ন করার সময় এসেছে। এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে বাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য র আ ম ওবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী বলেন, 'আইন অনুযায়ী আমরা উপজেলা পরিষদকে পরামর্শ দিয়ে থাকি। এ পরামর্শ তারা গ্রহণ করতে পারে আবার নাও করতে পারে। উপজেলা পরিষদের ওপর জোর করে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যায় না।' উবায়দুল মোক্তাদির বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে উপজেলার ওপর কোনো ধরনের কর্তৃত্ব করতে আগ্রহী নই। আমি চাই, তারা নিজেরাই নিজেদের সিদ্ধান্ত নিক। কখনো কখনো তারা আমার কাছে কোনো বিষয়ে পরামর্শের জন্য পীড়াপীড়ি করলে কিছু পরামর্শ দিয়ে থাকি। বাড়তি কোনো পরামর্শ দিতে যাই না। তবে এমপিদের পরামর্শ নিয়ে চললে তারাই বেশি লাভবান হয়। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অর্থায়ন নিয়েও সংস্কার দরকার। স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ থাকে। কিন্তু ব্যয়ের বেশির ভাগ করা হয় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে। স্থানীয় সরকারের আয় বাড়ানো দরকার। তা না হলে এসব প্রতিষ্ঠান সব সময়ই সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে। স্থানীয় সরকারের ব্যবস্থাপনা নিয়েও ভাবতে হবে। প্রতিটি উপজেলার জনবল কাঠামো রয়েছে। তার সঙ্গে শত শত কর্মী জড়িত। তাদের মর্যাদা অভিন্ন নয়। কিন্তু উপজেলা পরিষদে সরকারি কর্মী মাত্র দুজন। ইউনিয়ন পরিষদে সরকারি কর্মী মাত্র একজন। স্থানীয় সরকারের এলাকায় নিযুক্ত সরকারি কর্মীদের কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়োজন রয়েছে। আইন সংশোধনের সময় এ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা দরকার। স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইউনিয়ন পরিষদ আইনে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন সংযোজন করা হয়েছে। এ আইনে বছরে দুবার 'ওয়ার্ড সভা' অনুষ্ঠানের বিধান রয়েছে। ওয়ার্ডের সব ভোটারকে নিয়ে ওয়ার্ড সভা গঠিত। এর মাধ্যমে স্বচ্ছতা-জবাবদিহির চর্চা, স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, সামাজিক আন্দোলন পরিচালনা এবং সুস্পষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে সরকারি সেবা প্রদানের জন্য উপকারভোগী চিহ্নিত হওয়ার কথা। ফলে সরাসরি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ভবিষ্যতে স্থানীয় সরকারের কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ওয়ার্ড সভাকে কার্যকর করা। কিন্তু স্থানীয় সরকার বিভাগের নজর এসব সংস্কারের দিকে নেই। আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিরোধ নিষ্পত্তি, অপরাধ দমন, অপরাধ প্রতিরোধ, সামাজিক সংহতি-সম্প্রীতি বজায় রাখতে অর্ধ লক্ষাধিক নেতা ব্যক্তিগতভাবে যে অবদান রাখেন, তার কোনো মূল্যায়ন কোথাও হয়নি। সত্যিকারের মূল্যায়ন হলে বোঝা যেত, একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা তাঁরা পালন করে আসছেন। কোনো রকম পুলিশি ও আইনি সহায়তা ছাড়াই তাঁরা এ অসাধ্য সাধন করেছেন। এখন থেকে মেয়র, চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য প্রার্থীরা নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলের মনোনয়ন ও প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। স্থানীয় সরকারের যেকোনো নির্বাচনে প্রশাসক নিয়োগ করতে পারবে সরকার। এসব বিধান সংযোজন করে গত সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে 'স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) (সংশোধন) আইন, ২০১৫', 'উপজেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন, ২০১৫', 'জেলা পরিষদ (সংশোধন) আইন, ২০১৫', 'স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) (সংশোধন) আইন, ২০১৫' এবং স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) আইন, ২০১৫' সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। সংসদের অধিবেশন না থাকায় এবং আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা থাকায় এসব সংশোধনীর প্রস্তাবের মধ্য থেকে পৌরসভার অধ্যাদেশ জারি করা হবে। -কালেরকণ্ঠ। ১৭ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/আসিফ/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে