শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫, ০৩:৩৯:৪৮

শাহজালালে নিষিদ্ধ হচ্ছে সিঅ্যান্ডএফ স্টাফ

শাহজালালে নিষিদ্ধ হচ্ছে সিঅ্যান্ডএফ স্টাফ

মুজিব মাসুদ: বিমানের কার্গো কমপ্লেক্সের মালামাল লোড-আনলোডের জন্য সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের নিযুক্ত ‘স্টাফ’দের নিয়ে বিপাকে পড়েছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। ‘স্টাফ’ হচ্ছে সিঅ্যান্ডএফ নিযুক্ত বেসরকারি কর্মচারী। গোয়েন্দাদের অভিযোগ, সিঅ্যান্ডএফ নিয়ন্ত্রিত ‘স্টাফ’রা কার্গো কমপ্লেক্সসহ বিমানবন্দরের সব স্পর্শকাতর স্থানে প্রবেশ করছে নির্বিচারে। ভেতরে প্রবেশের জন্য তারা যে আইডি কার্ড (পাস) ব্যবহার করছে তার ৮০ শতাংশই জাল। অভিযোগ রয়েছে, এ কথিত ‘স্টাফ’রা মালামাল লোড-আনলোডরে নামে বিমানবন্দরে চালাচ্ছে ভয়াবহ চোরাচালান। একই সঙ্গে এরা কার্গোপণ্য চুরিসহ লুটপাটের রামরাজত্ব তৈরি করেছে বিমানবন্দরে। বন্দরের নিরাপত্তার স্বার্থে বৃহস্পতিবার বিমান, সিভিল এভিয়েশন, কাস্টমস, এপিবিএন, পুলিশ, সবগুলো গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টসহ ২৪টি সংস্থা জরুরি বৈঠকে বসে। বৈঠকে চলতি মাসের ২৫ তারিখ থেকে নিজস্ব জনবল দিয়ে কার্গো কমপ্লেক্স পরিচালনার জন্য বিমানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মধ্যবর্তী এ সময়ে মালামাল লোড-আনলোডে বিমানের সিকিউরিটি পাস নিয়ে শর্তসাপেক্ষে ‘স্টাফ’দের বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে। বৈঠকে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের চলমান ধর্মঘটও প্রত্যাহার করা হয়। কাল থেকেই আবার মালামাল লোড-আনলোড শুরু হবে বলে সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএমএ খায়ের নিশ্চিত করেছেন। জানা গেছে, সম্প্রতি সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার স্বার্থে বিমানবন্দরে সিঅ্যান্ডএফ নিযুক্ত ‘স্টাফ’দের প্রবেশে কড়াকাড়ি আরোপ করলে তারা ধর্মঘটের ডাক দেয়। এ কারণে মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কার্গোপণ্য লোড-আনলোড বন্ধ ছিল। বিমানের জেনারেল ম্যানেজার (সিকিউরিটি) মমিনুল ইসলাম জানান, বৈঠকে ২৫ তারিখের মধ্যে বিমানকে প্রয়োজনীয় কার্গো হেলপার নিয়োগ দিতে বলা হয়েছে। বিমানের ভারপ্রাপ্ত এমডি মোসাদ্দিক আহম্মেদ জানান, কার্গো কমপ্লেক্স পরিচালনার জন্য এ মুহূর্তে ১২০ জন হেলপার ও ৫০ জন কার্গো সহকারী নিয়োগ দিতে হবে। একই সঙ্গে কার্গো মালামাল লোড-আনলোডের জন্য দ্রুত জিএসই ইকুইপমেন্ট ক্রয় করতে হবে। কার্গো শাখা সূত্রে জানা গেছে, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে বিমানের কার্গো আমদানি-রফতানি শাখা আধুনিকায়ন করছে। এরই মধ্যে ৮০ শতাংশ কাজ শেষ। এখন শুধু মালামাল রাখার র‌্যাকগুলোর ওপর প্লেট বসানো বাকি। তাই এখন মালামাল বিমানবন্দরের বাইরে খোলা আকাশের নিচে রাখতে হচ্ছে। এজন্য সিঅ্যান্ডএফ নিযুক্ত বেসরকারি লোডারদের (স্টাফ) ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে। জানা গেছে, বর্তমানে কার্গো শাখা থেকে বিমানের বাৎসরিক আয় প্রায় ৫শ’ কোটি টাকা। এ কার্যক্রম শেষ হলে কার্গো শাখার আয় বেড়ে ৮০০ কোটি টাকায় দাঁড়াবে। এ অবস্থায় দ্রুত জনবল নিয়োগের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে কার্গো আমদানি-রফতানি শাখার র‌্যাকগুলোতে প্লেট বসানোর কাজ শেষ হবে বলে বৃহস্পতিবারের বৈঠক সূত্র জানায়। কার্গো কর্তৃপক্ষ জানায়, প্লেট বসানোর কাজ শেষ হলে বিমানের নিজস্ব জনবল দিয়েই মালামাল বাইরে খালাস দেয়া হবে। এতে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। বিমানের জেনারেল ম্যানেজার (নিরাপত্তা) মমিনুল ইসলাম বলেছেন, তারা হাতেনাতে একাধিক চুরি ধরেছেন। একটি বিশাল সিন্ডিকেট এ চুরির সঙ্গে জড়িত। সিভিল এভিয়েশনের একটি কক্ষ ব্যবহার করে এসব চুরি হতো। এরপর কক্ষটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, রক্ষক যখন ভক্ষক হয় তখন তাদের ধরা খুবই কষ্ট। দিনের বেলায় বোর্ডটি লাগানো থাকত। রাতের অন্ধকারে যখন কেউ থাকত না তখন দেয়াল থেকে বোর্ড খুলে ওই ছিদ্র পথে মালামাল চুরি করে নিয়ে আসা হতো সুইচরুমে। মালামাল বাইরে নেয়ার সময় কেউ বাধা দিত কিনা জানতে চাইলে মমিনুল ইসলাম জানান, সবাই জানত সিভিল এভিয়েশনের মালামাল, বাধা দেয়ার কি আছে। এর সঙ্গে সিঅ্যান্ডএফ ‘স্টাফ’রাও জড়িত ছিল বলে এটা জানাজানি হয়নি। এ ছাড়া কার্গো গোডাউনের বাইরে রানওয়েতে থাকা মালামালও চুরি হচ্ছে ফ্রি স্টাইলে। সিভিল এভিয়েশনের কিছু ড্রাইভার রানওয়ে থেকে মূল্যবান মালামালভর্তি কার্টন নিয়ে রানওয়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে সে মালামাল বিমানবন্দরের বাউন্ডারি দেয়ালসংলগ্ন স্থানে লুকিয়ে রাখত। সন্ধ্যা নামলে দেয়াল টপকে ওই মালামাল নিয়ে যেত তাদের হেফাজতে। মমিনুল ইসলাম বলেন, বিমানবন্দরজুড়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত এই চুরির সঙ্গে। এ কারণে এগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিমানের কার্গো ভিলেজে প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড় হাজার মামলার শুল্কসংক্রান্ত ফাইল নিষ্পত্তি করা হয়। প্রায় দেড় হাজার সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে এসব মালামালের শুল্ক পরিশোধসংক্রান্ত ফাইল নিষ্পত্তি হয়। আর এসব কাজ করতে ঘাটেঘাটে ঘুষ দিতে হয়। সিঅ্যান্ডএফ সদস্যরাই সংশ্লিষ্ট মালিকের পক্ষে ঘুষ দিয়ে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, ঘুষ না দিলে ফাইলের গতি শ্লথ হয়ে যায়। এ ছাড়া পণ্যের দাম যাচাইয়ের নামে অহেতুক সময়ক্ষেপণসহ অতিরিক্ত শুল্ক ধার্য করার হুমকি দেয়া হয়। আর ঘুষ দিলে কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সহায়তায় ১ লাখ টাকার পণ্য ১ হাজার টাকা লিখেও শুল্ক নির্ধারণ করা যায়। ১৯৮৪ সালের দিকে সিভিল এভিয়েশন কার্গো ভিলেজ ভবন তৈরি হয়। হযরত শাহজালাল আন্তজাতিক বিমানবন্দরে প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৭০টি কার্গো ফ্লাইট ওঠানামা করে। জানা গেছে, দেশের বাইরে থেকে কোনো মালামাল কার্গো কমপ্লেক্সে আসার পর সেটি বিমানের গোডাউনে সংরক্ষণ করা হয়। এরপর আমদানিকারকরা এসব মালামাল ছাড় করানোর জন্য তালিকাভুক্ত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে দায়িত্ব দেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা এয়ারওয়েজ বিল সংগ্রহ করেন। সেখানে কাস্টমসের বিভিন্ন ঘাটে ঘুষ দিতে হয়। বিল অব এন্ট্রি ফরমের জন্য কাস্টমসের অটোমেশন রুমে জমা দিতে হয়। সেখানেও টাকা দিতে হয় ফাইল ছাড়ানোর জন্য। এরপর সিআরএফ রিপোর্ট বের করতেও টাকা গুনতে হয় এজেন্টকে। সবচেয়ে বেশি হয়রানি হয় ক্লিন রিপোর্ট বের করা নিয়ে। বাজার যাচাইয়ের নামে হাতবদল হয় সবেচেয়ে বেশি ঘুষের টাকা। এ ক্ষেত্রে ৫-৬টি টেবিলে গড়ে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, অ্যাসেসম্যান্ট সুপার, সহকারী কমিশনার, ডেপুটি কমিশনারের শাখাগুলোতে চলে দিনভর আন্ডারহ্যান্ড নেগোসিয়েশন। এসব নেগোসিয়েশনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের রয়েছে নিজস্ব স্টাফ। আগে সরাসরি রুমে ঘুষের টাকা লেনদেন হলেও এখন সেটা হচ্ছে না। অধিকাংশ রুমে সিসি ক্যামেরা থাকায় ইশারা-ইঙ্গিতে অন্যত্র ‘স্টাফ’দের মাধ্যমে লেনদেন হয় ঘুষের টাকা। টাকা হাতে পাওয়ার পর সরকারের গ্রিন সিগন্যাল পেলে ফাইলে স্বাক্ষর করেন সংশ্লিষ্ট অফিসার। টাকা না দিলে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে নেয়ার হুমকি দেয়া হয়। এমনকি পিএসআইকৃত পণ্যের দামও যাচাই-বাছাইয়ের নামে সময়ক্ষেপণ করা হয়। - যুগান্তর। ১৭ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ/আসিফ/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে