শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫, ০৪:০১:৩৬

দেশে অবৈধ বিদেশির সংখ্যা কয়েক লাখেরও বেশি

দেশে অবৈধ বিদেশির সংখ্যা কয়েক লাখেরও বেশি

নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশে বসে জাল ডলার তৈরি করতেন আফ্রিকার দেশ উগান্ডার নাগরিক বেনকো আর সুদানের নাগরিক মেফেজা জিয়েন। চট্টগ্রামের একটি বাড়ি থেকে জাল ডলার তৈরির সরঞ্জামসহ গত বছর তাঁদের গ্রেফতার করে পুলিশ। ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে অনেক থাই তরুণীও জড়িয়ে পড়ছে নানা অনৈতিক কাজে। এজন্য কিছুদিন আগে কয়েকজন থাই তরুণীকে গ্রেফতার করে নিজ দেশে ফেরত পাঠায় গোয়েন্দা পুলিশ। সম্প্রতি ক্যামেরুনের কয়েকজন নাগরিককেও গ্রেফতার করা হয় জাল ডলার তৈরির অভিযোগে। এর আগে রাজধানীর উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরে এক অবৈধ আলজেরীয় নাগরিকের হাতে মর্মান্তিকভাবে খুন হয় ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ (১৭)। ওই ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা রামপুরা, বনশ্রী, গুলশান ও উত্তরায় বেশ কয়েকটি দেশের নাগরিকের বাসা শনাক্ত করেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ৪০টি টিম একযোগে এসব এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে পাঁচ শতাধিক বিদেশি নাগরিককে আটক করে তাঁদের কাগজপত্র পরীক্ষা করে। দেখা যায়, বেশিরভাগের কাগজপত্রই ভুল তথ্যে ভরপুর। তাঁদের মতো আরও অসংখ্য অবৈধ বিদেশি আছেন বাংলাদেশে যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভয়ঙ্কর ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। তাঁদের অনেকেই আবার কারাগারে রয়েছেন। গোয়েন্দা তথ্যমতে, দেশে কয়েক লাখ অবৈধ বিদেশি রয়েছেন। আর ১৬টি দেশের অন্তত ৭০০ নাগরিক দীর্ঘদিন ধরে সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের দেওয়া তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন কারাগারে প্রায় এক হাজার বিদেশি নাগরিক বন্দি আছেন। তবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের কোনো পরিসংখ্যানই নেই। ধারণার ভিত্তিতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ নাগরিকের সংখ্যা বৈধদের চেয়ে অনেক বেশি। বৈধভাবে বর্তমানে দেশে অবস্থান করছেন সোয়া দুই লাখের মতো বিদেশি নাগরিক। আর বেসরকারি হিসাবে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ১২ লাখের অধিক। ঢাকা ও রংপুরে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যাকান্ডের পর বিদেশিদের নিরাপত্তায় বিশেষ উদ্যোগ নেয় সরকার। আর বিদেশিদের নিরাপত্তা দিতে গিয়েই বেঁধেছে যতসব বিপত্তি। বৈধভাবে অবস্থানকারীদের নাম, পরিচয়, ঠিকানা ও কর্মস্থল সরকারের কাছে থাকলেও অবৈধভাবে যাঁরা আছেন, তাঁদের কোনো তথ্যই নেই। ফলে তাঁদের যথাযথ নিরাপত্তা দেওয়া নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। পুলিশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক হিসাবে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে বৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশির সংখ্যা ২ লাখ ২১ হাজার ৫৫৯। আর অবৈধ বিদেশির সংখ্যা এর চেয়েও বেশি। গোয়েন্দাদের কাছে এ তথ্যের পাশাপাশি এসব অবৈধ বিদেশিদের আন্তর্জাতিক অপরাধীচক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্যও রয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যমতে, ১৬টি দেশের অন্তত ৭০০ নাগরিক দীর্ঘদিন ধরে গোয়েন্দাদের সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশি নাগরিকরা অবৈধভাবে অবস্থান করে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করার পাশাপাশি অস্ত্র, স্বর্ণ ও মাদক চোরাচালান, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, বিভিন্ন দেশের জালনোট তৈরি, ডলার জালিয়াতি, এমনকি জঙ্গি তৎপরতায়ও জড়িয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, ঘানা, কঙ্গো, তাইওয়ান, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, চীন, তানজানিয়া, উগান্ডা ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ভোরের পাতাকে জানান, ‘গত কয়েক বছরে ঢাকা মহানগর পুলিশের অভিযানে দু’শতাধিক বিদেশি নাগরিককে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। তাঁদের মধ্যে আফ্রিকান নাগরিকের সংখ্যা বেশি। এছাড়া কিছু পাকিস্তানি রয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। গ্রেফতারকৃতদের বেশিরভাগই জঙ্গি, মাদক, জাল মুদ্রা তৈরি, প্রতারণা, হত্যা ও মানব পাচারে জড়িত। ছাত্র, ব্যবসায়ী, খেলোয়াড় ছাড়াও পোশাক শিল্প, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, আইটি ও টেলিকম সেক্টর, রেস্টুরেন্ট এবং এনজিওসহ নানা প্রতিষ্ঠানের ঢাল ব্যবহার করে তাঁরা অপরাধ করে থাকেন। তাঁরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করে নানারকম অপরাধ কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছেন।’ বিশিষ্ট অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. বোরহান উদ্দীন খান ভোরের পাতাকে বলেন, ‘অবৈধ বিদেশিরা দেশে অপরাধমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকলে সেটা দেখার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর। বিদেশি নাগরিক কখন-কীভাবে ও কী উদ্দেশ্যে এ দেশে ঢুকছে, তার সঠিক তথ্য নেই সরকারি কোনো সংস্থার কাছে। পৃথিবীর কোনো দেশেই অবৈধভাবে বসবাসের সুযোগ নেই। অথচ বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসের পাশাপাশি বিদেশিরা অপরাধ কর্মকা-ও চালিয়ে যাচ্ছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিদেশিদের ওপর কড়া নজরদারি থাকলেও বাংলাদেশে সরকারিভাবে খুব বেশি এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কখনই। শুধু ঘটনাক্রমে দু’চারজন গ্রেফতার হলেই তাঁদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চলে।’ ড. বোরহান উদ্দীন জানান, ‘এ বিষয়টি সাধারণত পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ দেখে থাকে। অবৈধ বিদেশিদের ধরতে প্রয়োজন হলে অ্যাকশনে যেতে হবে। ফরেন অ্যাক্টের ধারায় তাঁদের গ্রেফতার করা যেতে পারে। তবে নিরপরাধ বিদেশিদের আইনগত সহযোগিতা দেওয়া উচিত। তাঁরাও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন।’ র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘গত কয়েক বছরে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে শতাধিক আফ্রিকানসহ বিভিন্ন দেশের দু’শতাধিক নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়।’ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘দেশে অবৈধ বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা অনেক। এর মধ্যে আফ্রিকান নাগরিকদের বেশিরভাগই অবৈধভাবে দেশে বসবাস করে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত। তাঁদের ধরতে গোয়েন্দা পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে।’ পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে জানা যায়, বিদেশিদের মধ্যে বেশিরভাগ পর্যটন ভিসায় বাংলাদেশে এসে কখনো নিজের পাসপোর্ট ছিড়ে ফেলে, আবার কখনো ভিসার মেয়াদ থাকা অবস্থাতেই নানা অপতৎপরতা চালান। পাসপোর্ট না থাকায় অপরাধমূলক কর্মকান্ডে আটকের পর তাঁদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে তৈরি হয় জটিলতা। এ সুযোগে বার বার তাঁরা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। মূলত গুলশান, বনানী, উত্তরার মতো অভিজাত এলাকাগুলোকে বিদেশিরা নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। এছাড়া বিনিয়োগকারী পরিচয়ে অভিজাত হোটেলে উঠে বিদেশে লোক পাঠানো, বাংলাদেশে নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলার আশ্বাস ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়েও সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁরা প্রতারণা করছে। অভিজাত এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসার দায়ে এর আগে বেশকিছু বিদেশিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের নাগরিকরা বেশ কয়েক বছর ধরে অনবরতই অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঢুকছেন। তাঁদের একটি বড় অংশ মাদক, অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদের ওপর বিশেষ নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে উল্লেখ করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ভোরের পাতাকে জানান, ‘অবৈধ বিদেশিদের গ্রেফতারে খুব শিগগিরই অভিযান পরিচালিত হবে। বর্তমানে দেশে অবৈধ বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। তাঁরা বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছেন। ইতোমধ্যে অবৈধভাবে বসবাসরত বিদেশি নাগরিকদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। তালিকায় আফ্রিকান নাগরিকদের ওপর বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে।’ ডিএমপির মুখপাত্র জানান, ‘অনেক বিদেশি অবৈধভাবে বাংলাদেশ অবস্থান করছেন। অবৈধ কাজের সুযোগ নিতে তাঁরা তাঁদের বৈধ কাগজপত্র নষ্ট করে ফেলছেন। এ কারণে তাঁদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য ও ঠিকানা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক সময় তাঁদের আটক করা গেলেও বৈধ কাগজপত্র নষ্ট করে ফেলায় এবং পরবর্তীতে আইনি জটিলতায় তাঁদের দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। আফ্রিকান নাগরিকরা এ অপরাধমূলক কাজে বেশি জড়িয়ে পড়ছেন।’ যুগ্ম কমিশনার আরও জানান, ‘গত কয়েক বছরে আফ্রিকান প্রায় ৫০০ নাগরিককে বিভিন্ন অপরাধে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে বৈধ কাগজপত্র নষ্ট করে ফেলায় তাঁদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে বাংলাদেশে কত আফ্রিকান নাগরিক অবস্থান করছেন, সে তালিকা তৈরির কাজ চলছে। এছাড়া অবৈধভাবে যাঁরা আছেন, তাঁদেরও তালিকা করা হচ্ছে। দেশে বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনার প্রেক্ষাপটে এসব অবৈধ বিদেশি শনাক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। - ভোরের পাতা। ১৭ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ/আসিফ/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে