শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৫, ০৫:০৩:১৭

শেষ হলো সব প্রস্তুতি : রবিবার শুরু হচ্ছে বোধন

শেষ হলো সব প্রস্তুতি : রবিবার শুরু হচ্ছে বোধন

রাজন ভট্টাচার্য: শরতকালে অবতার শ্রী রামচন্দ্র দেবীকে আহ্বা করেছিলেন বলে বাঙালী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ‘শারদীয় দুর্গাপুজো’ নামে পরিচিত। এটাকে অকাল বোধনও বলা হয়। কারণ শ্রীরামচন্দ্র অকালেই দুর্গাকে ডেকেছিলেন। প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এক বছর পর পর অসুরশক্তি বিনাশকারী দেবী দুর্গা আসেন বাবার বাড়িতে। এসেই অবস্থান নেন বেলগাছে। ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যায় বোধনের মাধ্যমে তাকে আহ্বান করা হয়। একইদিনে হয় অধিবাস। পরদিন সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকা স্থাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মূল পুজোর আয়োজন। প্রস্তুতি সম্পন্ন। সারাদেশে এখন উৎসবের আমেজ। রং-তুলি দিয়ে প্রতিমার গায়ে শেষবারের মতো তুলির আঁচড় দিচ্ছেন নির্মাণ শিল্পীরা। অপেক্ষা আর মাত্র একদিন। এর পরেই ম-পে ম-পে প্রতিমা প্রতিষ্ঠা হবে। চলবে পুজোর্চনা আর আরাধনা। প্রতিমা ও ম-প ঘিরে সাজ সজ্জা প্রায় সম্পন্ন। হয়েছে বাহারি রংয়ের আলোকসজ্জাও। রবিবার থেকে শুরু হবে পাঁচদিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা। মন্দিরে মন্দিরে বাজবে ঢাক, শঙ্খ আর ঝাজ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভক্তদের আগমনে পূর্ণতা পাবে শারদীয় এ উৎসব। আনন্দে মাতবে সবাই। এবার দেশের ৬৪ জেলায় ২৯ হাজারের বেশি ম-পে পুজার আয়োজন হয়েছে। রাজধানীর ২২৩টি ম-পে পুজোর আয়োজন হয়েছে। উৎসব সফলভাবে সম্পন্ন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রতিটি ম-পে থাকবে পুলিশ ও আনসার সদস্য। টহলে থাকবে র‌্যাব। ঢাকা মহানগর পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ সাহা মনি বলেন, পুজোর প্রস্তুতি সম্পন্ন। আশাকরি সকলের সহযোগিতায় সুষ্ঠুভাবে উৎসবের সমাপ্তি হবে। তিনি জানান, ২০১৪ সালে রাজধানীতে ২২২টি ম-পে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। এবছর বেড়েছে একটি। সারাদেশে ২৯ হাজার ম-পে পুজোর আয়োজন: বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, এবছর সারাদেশে ২৯ হাজার ৭৪টি ম-পে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হবে। রাজধানীতে ২২৩টি ম-পে শারদীয় দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়েছে। সনাতন বিশ্বাস ও বিশুদ্ধ পঞ্জিকামতে, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এবার ঘোটকে (ঘোড়া) চড়ে মর্তলোকে (পৃথিবী) আসবেন। যার ফল হচ্ছে রোগ, শোক, হানাহানি-মারামারি বাড়বে। আর দেবী স্বর্গালোকে বিদায় নেবেন দোলায় (পালকি) চড়ে। যার ফল মড়ক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ, মহামারীর প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে। অপেক্ষা আর মাত্র ২৪ ঘণ্টা। এর পর পরই উৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু। ১৮ অক্টোবর সায়ংকা ল দেবীর বোধন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯ তারিখ দেবীর ষষ্ঠী বিহিত পুজো, সায়ংকালে আমন্ত্রণ ও অধিবাস। ২০ তারিখ দেবীর নবপত্রিকা প্রবেশ, সপ্তমী ও মহাসপ্তমী বিহিত পুজো। ২১ তারিখ মহাষ্টমী। কুমারী পুজো, সন্ধিপুজো। ২২ তারিখ মহানবমী পুজো। সনাতন পঞ্জিকা মতে এবার ২২ অক্টোবর একই দিনে মহানবমী ও বিজয়া দশমী পড়ায় ওই দিন দর্পণ বিসর্জন হবে। তবে সারাদেশে ২৩ অক্টোবরই বিজয়া শোভাযাত্রাসহকারে প্রতিমা বিসর্জনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে মহালয়ার দিন থেকেই মূলত শুরু হয়েছে দেবী দুর্গার আগমনধ্বনি। দুর্গোৎসবের প্রকৃত তত্ত্ব: দুর্গাপুজো বা দুর্গোৎসবের প্রকৃত তত্ত্ব কী, পুজো শব্দের শাব্দিক অর্থ হচ্ছে-যা করলে জীবনে উন্নয়নের পথ প্রশস্ত হয়। পুজো শব্দটি এসেছে পূজ ধাতু থেকে। প-িতরা বলছেন, এই পূজ ধাতুর অর্থ হচ্ছে বর্ধনশীলতা। উৎসব শব্দটির অর্থ হচ্ছে উৎস অভিমুখে গমন অতএব পুজো বা উৎসব শব্দটি একই অর্থ বহন করে। এই দুর্গাপুজো বা দুর্গোৎসবের মধ্যে দুটি তত্ত্ব নিহিত আছে। একটি জাগতিক বা সাংসারিক এবং অন্যটি আধ্যাত্মিক। এ পুজোর জাগতিক অর্থ হলো বাস্তব জীবনের উন্নয়ন। দুর্গাপুজো করা মানে হচ্ছে দুর্গা হওয়া। দুর্গার দশটি হাতের অর্থ হলো দশদিকের কর্মযোগ্যতা বা দক্ষতা। একজন নারী যখন সংসারের সকল কর্মে দক্ষতা লাভে ব্রতী হয় তখনই তার সংসার সুন্দর হয়। আর সুন্দর সংসার হতে হলেই লক্ষ্মী-সরস্বতীর মতো কন্যা এবং গণেশ-কার্তিকের মতো পুত্র হওয়া বাঞ্ছনীয়। আর সুন্দর সন্তান জন্মাতে প্রয়োজন স্বামীরপ্রতি অবিচ্ছেদ্য টান। শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র বলেছেন, স্বামীর প্রতি টান যেমনি, ছেলেও জীবন পায় তেমনি। তাই দুর্গাপুজোর শিবঠাকুর দেবীর মাথার উপরে। দুর্গার দশটি হাতের মধ্যে একটি আশীর্বাদের অভয় হস্ত এবং বাকি নয়টিই হচ্ছে প্রহরণ যন্ত্র। এই নয়টি প্রহরণ যন্ত্র দিয়ে মহাশক্তি জগতের অমঙ্গলকে ধ্বংস করবে। তাই প্রতিটি মা যদি জীবন্ত দুর্গা না হয়ে ওঠে তবে এ পুজোর সার্থকতা কোথায়? মাটি দিয়ে গড়া এ প্রাণহীন প্রতিমাকে তাই পুরোহিত মন্ত্রের মধ্যদিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন, চক্ষুদান করেন। তেমনি প্রতিটি নারীর মাঝে ইষ্টমন্ত্র বা দীক্ষাদানপূর্বক নতুন করে প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও জ্ঞান চক্ষুদান করে জগতের দুর্গতি নাশে যতœবান হলেই আমাদের এ দুর্গাপুজো সার্থক হবে। সংসার যখন দুর্গা-ম-পে পরিণত হবে তখনই হবে এ পুজোর সার্থকতা। পুজোর ইতিকথা: বৈদিক যুগ থেকেই দুর্গা নাম প্রচলিত। ঋগে¦দে বিশ্বদুর্গা, সিন্ধুদুর্গা, অগ্নিদুর্গা এই তিনটি নাম পাওয়া যায়। দুর্গাপুজো কেবল শাক্ত সমাজেই নয়, প্রাচীন বৈষ্ণব সমাজেও অনুষ্ঠিত হয়েছে। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব চন্ডীম-পেই চতুষ্পটি চালু করেন। প্রাচীন বৈষ্ণব কবি চন্ডীদাস, বৈষ্ণবাচার্য্য নিত্যান্দজীও দুর্গাদেবীর ভক্ত ছিলেন। মার্কন্ডেয় পুরাণ মতে, সত্য যুগের রাজা সুরথ, সমাধি বৈশ্য দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি গড়ে পুজো আরম্ভ করেছিলেন। কৃত্তিবাস রামায়ণ থেকে জানা যায়, ত্রেতা যুগে লঙ্কার রাজা রাবণ দেবীপুজোর আয়োজন করে দেবীর আশীর্বাদধন্য হয়েছিলেন। অন্যদিকে রাবণ বধ এবং জানকীকে উদ্ধার করার জন্য শ্রী রামচন্দ্র বসন্তকালের পূর্বে শরতকালে দেবীপুজো করেছিলেন। উল্লেখ্য, শ্রী রামচন্দ্র দেবী ভগবতীকে অকালে বোধন করেছিলেন। মূলত দেবীর পুজো বসন্তকালে হয়ে থাকে। আর সেই থেকে শরতে দেবীপুজো অকালবোধন নামে পরিচিত। শরতের এই পুজোই আমাদের দুর্গোৎসব। বাল্মীকি রামায়ণে দেখা যায়, রামের জয়লাভের জন্য স্বয়ং ব্রহ্মা দুর্গার স্তব করেছিলেন। মহাভারতে পাওয়া যায়, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদেশে অর্জুন দুর্গার স্তব করেছিলেন। দেবী দুর্গা দেবতাদের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। সবচেয়ে প্রাচীন মহিষমর্দিনীর মূর্তিটি পাওয়া যায় পঞ্চম শতাব্দীতে। জানা যায়, প্রথম শতকে কুষান যুগে, পঞ্চম শতকে গুপ্ত যুগে, সপ্তম শতকে পল্লব যুগে এবং ১১-১২ শতকে সেন বংশের আমলে দেবী মহিষমর্দিনীরূপে পূজিত হয়েছেন। কুষান যুগে দুর্গা ছিলেন লাল পাথরের তৈরি। পাল যুগে অর্থাৎ ১২৮৯ সালে দেবী ত্রিনয়নী এবং চারহাত বিশিষ্ট। দশভুজা দুর্গার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৮ শতকে। বাংলাদেশে প্রথম দুর্গাপুজোর প্রচলন হয় মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে, ষোড়শ শতাব্দীতে। এছাড়া প্রাচীন হিন্দু পুরানের কিছু বিবরণ এবং খ্রিস্টীয় ৫ম শতকের পরে নানা স্থানে দুর্গাপুজো সম্পর্কিত বিক্ষিপ্ত কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ঢাকার প্রস্তুতি: রাজধানীর বেশ কয়েকটি পুজোম-প ঘুরে শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষ পর্যায়ের প্রস্তুতি চোখে পড়েছে। কেন্দ্রীয় পুজো উৎসব হিসেবে পরিচিত ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনের দুর্গোৎসবকে ঘিরে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। বরাবরের মতো এবারও মন্দির মিলনায়তনের বারান্দায় খোলা শেডের নিচে নির্মাণ হচ্ছে প্রতিমা। আর মন্দিরের সামনের মাঠজুড়ে প্যান্ডেল স্থাপন ও মন্দিরের সাজসজ্জার কাজও চলছে। মন্ডপের প্রতিমা নির্মাণের দায়িত্ব যথারীতি প্রখ্যাত প্রতিমাশিল্পী সুকুমার পালের ওপরই বর্তেছে। রাষ্ট্রপতির পদকপ্রাপ্ত ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রীধারী এই প্রতিমাশিল্পী ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু করে মাঝখানের চার বছর বাদ দিয়ে এখানকার প্রতিমা তৈরি করে আসছেন। ঢাকার রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিমা শিল্পী কালিপদ পাল ও শাঁখারি বাজারের প্রতিমা শিল্পী শিশির পাল জানান, নাওয়া-খাওয়া ভুলে তাদের এখন কাজ করতে হচ্ছে। গত দুই মাস বিরামহীন প্রতিমা তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন তারা। এখন শুধু প্রতিমার গায়ে রঙের শেষ ছোঁয়ার কাজ চলছে। ডেকোরেটরের মালিক-কর্মচারীদেরও ব্যস্ততা কম নয়। আয়োজকদের ফরমায়েশ মতো অস্থায়ী পুজোম-পগুলো তৈরি করতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। প্রতিবছরের মতো এবারও শাঁখারি বাজার, তাঁতিবাজার এলাকায় রাস্তার ওপর নির্মাণ করা হয়েছে অস্থায়ী ম-প। এলাকার বিভিন্ন সংঘ এসব পুজোর আয়োজন করেছে। শাঁখারি বাজারে কর্মরত ডেকোরেটরকর্মী রাশেদ আলী বলেন, সময় প্রায় শেষ। এখন আমাদের কাছে দিন রাত সবই সমান। দম ফেলারও সময় নেই। প্রতিমার সৌন্দর্য, ম-পের চাকচিক্য নিয়ে বিভিন্ন পুজোম-পের মধ্যে চলছে নীরব প্রতিযোগিতা। প্রতিমা তৈরির পাশাপাশি শুরু হয়েছে চোখ ধাঁধানো পুজোম-পের মঞ্চ তৈরি ও নানা পরিকল্পনার কাজ। ম-প পরিচ্ছন্ন করার কাজও চলছে। মন্দির প্রাঙ্গণকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলতে মন্দিরগুলোতেও চলছে ঘষামাজা ও রঙের কাজ। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি কাজল দেবনাথ বলেছেন, শারদীয় দুর্গাপুজো কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের নয়, গোটা বাঙালিরই সার্বজনীন উৎসব। এই উৎসব সুষ্ঠুভাবে শেষ করতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বরাবরের মতো এবারও প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রত্যাশা করেন তিনি। - জনকণ্ঠ। ১৭ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ/আসিফ/এআর

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে