বৃহস্পতিবার, ০৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭, ০১:১৮:৩০

পরিস্থিতি আরো পর্যবেক্ষণ করবে বিএনপি

পরিস্থিতি আরো পর্যবেক্ষণ করবে বিএনপি

কাফি কামাল : নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ বিএনপি। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি নির্বাচন কমিশন গঠনে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবও দিয়েছিল দলটি। সিইসিসহ কমিশনারদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা নিয়ে কিছু পরামর্শও ছিল সে প্রস্তাবে। বিএনপির প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ ও সার্চ কমিটি গঠনের মাধ্যমে নতুন কমিশন গঠন করেছেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু যে কারণে প্রস্তাবটি দেয়া হয়েছিল সেটাই লঙ্ঘিত হয়েছে বাস্তবে।

সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে অতীতে আওয়ামী লীগের পক্ষে বিতর্কিত অবস্থান নেয়ার অভিযোগ উঠেছে খোদ নবনিযুক্ত সিইসি কেএম নুরুল হুদার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হলেও হার্ডলাইনে যাচ্ছে না বিএনপি। আপাতত ইসির কর্মকাণ্ড ও সরকারের পদক্ষেপসহ সার্বিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করবে দলটি। পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সামনে আনবে ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা’ ও আগামী দিনের কর্মসূচি। সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক কারণে ইসি প্রত্যাখ্যান ও তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ‘সাফল্যের সম্ভাবনাহীনতা’র বিষয়টি বিবেচনা করেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপি ও তাদের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা।

নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনে যাবার পরিবর্তে তারা এখন নির্বাচনকালীন ‘নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের’ দাবিকে সামনে রেখেই সাজাতে চায় সার্বিক কর্মপরিকল্পনা। বিএনপি নীতিনির্ধারক ফোরামের সদস্য ও জোটের শরিক দলের দায়িত্বশীল নেতারা এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ, সার্চ কমিটি গঠন এবং সার্চ কমিটির তৎপরতার বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রেখেছিল বিএনপি। কিছু কিছু বিষয় তাদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি করলেও মোটাদাগে তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশনের আশাবাদ ছিল তাদের। নির্বাচন কমিশনের গঠনের পরপর ইতিবাচক অবস্থান থেকেই সার্বিক বিষয়ে দেশবাসীর উদ্দেশে একটি বক্তব্য দেয়ারও কথা ছিল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার।

সে অনুযায়ী সার্চ কমিটি যেদিন রাষ্ট্রপতির কাছে নাম প্রস্তাব করে একই দিন দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠক ডেকেছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু রাষ্ট্রপতি দ্রুততম সময়ে ইসি নিয়োগ দিলে নিয়োগপ্রাপ্তদের নাম দেখে ও অতীত কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হন বিএনপি নেতারা। দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পরদিন জোটের শরিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে আগের অবস্থানে কিছুটা পরিবর্তন আনে বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারক ফোরাম ও জোটের শীর্ষ নেতারা আলোচনা করেন নতুন ইসিকে স্বাগত জানালে বা প্রত্যাখ্যান করলে সম্ভাব্য কি ধরনের লাভ-ক্ষতি হতে পারে। তারা একমত হন, সাংবিধানিক কারণে নতুন ইসির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে গিয়ে সাফল্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ।

কারণ, দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। অন্যদিকে নির্বাচনকালে নিরপেক্ষ সরকার থাকলে নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করতে পারে না। ফলে নির্বাচন কমিশনকে যতটুকু ইতিবাচক রাখা যায় সেটাই ভালো। এখন বিএনপিসহ বিরোধী জোটের আন্দোলন সংগ্রামের লক্ষ্যবিন্দু হওয়া উচিত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকার। বিএনপি নীতিনির্ধারক ফোরামের সদস্য ও জোটের একাধিক নেতা জানান, কৌশলগত কারণে আপাতত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ভুল পদক্ষেপের চেয়ে বিএনপিকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা ও আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর দিয়েই এগোতে হবে। সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির দেশি-বিদেশি শুভাকাঙ্ক্ষীদের তরফেও এসেছে তেমন পরামর্শ।

মঙ্গলবার রাতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইসি গঠন নিয়ে দলের তরফে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, আমরা মনে করি একজন বিতর্কিত সাবেক সরকারি কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত কোনো প্রতিষ্ঠান নির্মোহভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। কাজেই এই সিইসির নেতৃত্বে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, নুরুল হুদা যুগ্ম সচিব হিসেবে চাকরি জীবন শেষ করেছেন। অতিরিক্ত সচিব ও সচিব হয়েছেন শুধুই কাগজে। ফলে এসব পদে দায়িত্ব পালনে কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা তার নেই। অভিজ্ঞ সচিব ছাড়া সিইসি নিয়োগের এ ঘটনা অভূতপূর্ব। রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়া এমন হওয়ার কথা নয়।

রাষ্ট্রপতি যত দ্রুততার সঙ্গে ইসি নিয়োগ করেছেন সেটা নিয়েও সন্দেহ বিএনপির। মির্জা আলমগীর বলেন, এটা অনেক সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। এসব সন্দেহের মধ্যে একটি বড় সন্দেহ হলো, কাদের নির্বাচন কমিশনে রাখা হবে, সেটি ছিল শাসক মহলের পূর্বপরিকল্পিত। নুরুল হুদা সম্পর্কে নেতিবাচক উপলব্ধি সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি সার্চ কমিটি এবং রাষ্ট্রপতির বিবেচনায় না নেয়া খুবই রহস্যজনক। সঙ্গত কারণেই আমরা মনে করতে পারি, বর্তমান ইসি গঠনে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দেরই প্রতিফলন ঘটেছে।

মির্জা আলমগীর বলেন, ১৯৯৬ সালে কুমিল্লার ডিসি হিসেবে জনতার মঞ্চের সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এমন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া সরকারি চাকরি বিধির নিদারুণ লঙ্ঘন ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার বিষয়টি নিয়ে নুরুল হুদার মনে ক্ষোভ থাকতে পারে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়ে তিনি তাদের প্রতি অনুরাগ পোষণ করতে পারেন। সিইসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে যা প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ মিউনিসিপ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (বিএমডিএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ছিলেন তিনি। আমাদের প্রস্তাবে সরকারি চাকরি শেষে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিতদের ইসিতে অন্তর্ভুক্ত না করতে বলেছিলাম। সব মিলিয়ে একটি নির্বাচন কমিশনের যাত্রার শুরুতে আস্থার সংকট ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্যার জন্ম দিতে পারে।

নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনকে কেন্দ্র করে বিএনপির আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সরকারের প্রতি গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি ছিল সব মহলের। সরকার দলবাজ ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়োগের মাধ্যমে সে দাবি পদদলিত করেছে। নতুন সিইসির অতীত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই জানি। তাই দেশবাসীর কাছে এটাই বলে রাখতে চাই, এ কমিশন কোনোভাবেই নিরপেক্ষ নয়। তারপরও দেশের গণতন্ত্র ও জাতীয় রাজনীতির স্বার্থে আমরা ইতিবাচক থাকতে চাই।

তিনি বলেন, দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয় না। তাই আমরা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের কথা বলেছি। এখন সে সহায়ক সরকারের একটি রূপরেখা আমরা দেবো। আগামী দিনগুলোতে সে সহায়ক সরকারকে কেন্দ্র করেই আমাদের আন্দোলনসহ সার্বিক কর্মসূচি ও কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগুবো।

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশন যে বিতর্কিত ও দলান্ধ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে সেটা আমরা দলীয়ভাবে বলেছি। এখন এ কমিশনের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন সংগ্রাম করতে পারি কিন্তু সেটার ফলাফল কি দাঁড়াবে। এখানে পরিবর্তনের সুযোগ নেই। অন্যদিকে ইসি স্বাধীন হলেও যারা মাঠপর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনা করবেন, দলীয় সরকারের অধীনে তারা নিরপেক্ষ থাকবেন না। কারণ, ইসির ক্ষমতা নির্বাচনকালীন মাত্র ১৫ দিনের। আর সরকারের ক্ষমতা পাঁচ বছরের। সরকারি কর্মকর্তারা ১৫ দিনের ক্ষমতাশালীদের কথা মানতে গিয়ে তাদের ৩০ বছরের চাকরির ওপর বিপদ ডেকে আনতে চাইবে না। সে জন্য একটি সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার। আমরা সে লক্ষ্যে আগামী দিনের সমস্ত কর্মপরিকল্পনা করবো। নির্বাচনকালীন সরকার নিরপেক্ষ হলে ইসির কর্মকাণ্ডও ইতিবাচক হতে বাধ্য।

বিএনপি নেতারা জানান, হার্ডলাইনে না গেলেও সিইসির অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা অব্যাহত রাখা হবে। তবে চার কমিশনার নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করবে না বিএনপি ও জোটের নেতারা। আপাতত তাদের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করবে। সিইসির বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণসহ সমালোচনা ও কমিশনারদের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনায় রাখার মাধ্যমে ইসির ওপর বাড়ানো হবে জনমতের চাপ। বিএনপি নেতারা অভিযোগ করে বলেছেন, সিইসি কেএম নুরুল হুদা একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। ছাত্রজীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল পর্যায়ে ছাত্রলীগের পদবীধারী নেতা ছিলেন। পঞ্চম সংসদ চলাকালে আওয়ামী লীগের আন্দোলন সমর্থন করে সরকারি কর্মকর্তারা ‘জনতার মঞ্চ’ গঠন করলে তিনি সেখানে যুক্ত হয়েছিলেন। কুমিল্লার ডিসি হিসেবে তিনি সেখানে জনতার মঞ্চের সপক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সরকারি অফিস থেকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছবি নামিয়ে ফেলেছিলেন।

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনেও তিনি পটুয়াখালীতে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছেন। এমন একজন ব্যক্তির পক্ষে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। গতকাল তিনটি পৃথক অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতাদের বক্তব্যেও ছিল দলের মনোভাবের প্রকাশ। ভাসানী অনুসারী পরিষদের এক অনুষ্ঠানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বলেছেন, ক্ষমতা ধরে রাখতেই একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে সিইসি নিয়োগ করতে যাচ্ছে সরকার।

আরেক ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু এক মানববন্ধন থেকে প্রেসিডেন্টের প্রতি সিদ্ধান্ত বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে বলেছেন, কোনো সুযোগ থাকলে সেটা বিবেচনা করে বিতর্কহীন একজন ব্যক্তিকে সিইসি করুন। দুদু গতকাল সিইসির ব্যাপারে অভিযোগ করলেও কমিশনারদের ব্যাপারে বলেছেন, আমরা চার নির্বাচন কমিশনার সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না।

নতুন সিইসি কেএম নুরুল হুদাকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত জনতার মঞ্চের নেতা উল্লেখ করে অভিযোগ তীব্র হওয়ার আগেই তার সরে যাওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ। টাঙ্গাইলে ছাত্রদল আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, যারা একবার ডিসিপ্লিন ব্রেক করে, শৃঙ্খলা ব্রেক করে, বিদ্রোহ করে, তাদের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে কোনো কাজ করা কঠিন। এমজমিন

৯ফেব্রুয়ারি,২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে