'মামলাজট কমাতে প্রয়োজন যুগোপযোগী আইন’
নিউজ ডেস্ক: মামলা জট কমাতে পুরাতন আইন বাতিল করে যুগোপযোগী নতুন আইন প্রণয়নের ওপর জোর দিলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা।
মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁয়ে ‘রাজস্ব মামলার ব্যবস্থাপনা ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি এর কার্যকারিতা’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, বাংলাদেশে অনেক পুরনো আইন দিয়ে বিচার বিভাগসহ রাজস্ব আদায় কার্য্ক্রম চলছে। এসব আইন বাতিল করে যুগোপযোগী নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। এর দায়িত্ব আইন কমিশনকে দেওয়া যেতে পারে। কমিশন করদাতাসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে আইন প্রণয়ন করবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ প্রক্রিয়ায় আইন প্রণয়ন করা হয়। ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। আমাদের দেশে কখন আইন প্রণয়ন, কখন বাতিল করা হয় কেউ জানতে পারে না।
তিনি বলেন, এ সেমিনারের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগ, এনবিআর ও করদাতাদের মধ্যে দূরত্ব কমে আসবে। আদালতে বাইরেও বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এডিআরের গুরুত্ত অপরিসীম।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও ৬০ ভাগ বিরোধ এডিআরের (শালিশ) মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়ে থাকে। এক উদাহরণ দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, আমেরিকার মতো দেশে ৯০ শতাংশ বিরোধই এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়। তাই এডিআরের মাধ্যমে এনবিআর রাজস্ব মামলা নিষ্পত্তির যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
এস কে সিনহা বলেন, বর্তমানে হাইকোর্টে তিন লাখ ৮০ হাজার মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। এর বিপরীতে বিচারক রয়েছেন মাত্র ১০০ জন। সুতরাং আদালতের মাধ্যমে রাজস্বসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি করতে গেলে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে রাজস্বসংক্রান্ত যে ২৪ হাজার মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে, এগুলো এডিআরের মাধ্যমে দ্রুত নিস্পত্তি করা সম্ভব। আর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দক্ষ কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিতে হবে। তা এডিআরের মধ্য থেকেই করতে হবে। করদাতা ও এনবিআর উভয় পক্ষের সম্মতিতে আইনজীবী নিয়োগ করতে হবে। মামলার সঙ্গে জড়িতদের পারিশ্রমিক যৌক্তিকহারে নির্ধারণ করতে হবে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্তমান এডিআর পদ্ধতি সংশোধনের প্রয়োজন রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রধান বিচারপতি বলেন, আয়কর হয়রানি বন্ধের পাশাপাশি করদাতাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে হবে এনবিআর কর্মকর্তাদের। আয়কর মেলাসহ এনবিআরের গৃহীত নানা পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে করভীতি কমেছে। তবে ঢাকাসহ সারাদেশে কর অফিস বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলো পরিকল্পনামাফিক গড়ে তুলতে হবে, যাতে জনগণের দৃষ্টি কাড়ে।
করদাতাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিতে হলে কর দিতে হবে। কর প্রদানকে হয়রানি হিসেবে না দেখে দায়িত্ব হিসেবে দেখতে হবে। তা না হলে দেশ চলবে কী করে।
সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘রাজস্বসংক্রান্ত মামলায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রতিনিধি বা আইন কর্মকর্তা উপস্থিত না থাকার প্রবণতা রয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেলে বক্তব্যেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে। তাই দেশের স্বার্থে অবশ্যই রাজস্ব সংক্রান্ত যে কোনো মামলায় অন্তত একজন প্রতিনিধি উপস্থিত থাকতে হবে।
তিনি বলেন, মামলার জট কমাতে সুপ্রিম কোর্টে এনবিআরের একটি সেল থাকা উচিত। যেখানে অন্তত এনবিআরের একজন প্রতিনিধি নিয়মিত উপস্থিত থাকবেন।
সেমিনারে এডিআর কার্য্কর বিলম্ব হওয়ার বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে আইনগত বিধি-বিধান সম্পর্কে করদাতা ও আইন প্রয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাখ্যাগত মত পার্থক্য, বিলম্বে রাজস্ব দেওয়ার প্রবণতা, হাইকোর্টে গঠিত বেঞ্চের অপর্যাপ্ততা, অ্যাটর্নি জেনারেল দপ্তরে রাজস্ব মামলা পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত আইন কর্মকর্তার স্বল্পতা, হাইকোর্টের আদেশ প্রদান ও বাস্তবায়নের জন্য প্রদত্ত সময় স্বল্পতার কারণে জটিলতা সৃষ্টিসহ বেশকিছু সুনির্দিস্ট কারণের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়।
রাজস্ব মামলা নিষ্পত্তি দ্রুততরকরণে বেশকিছু প্রস্তাবনার কথা বলা হয়- রাজস্ব মামলা বিচার করার জন্য বিশেষায়িত বেঞ্চের সংখ্যা পর্যাপ্তভাবে বৃদ্ধি করা। রাষ্ট্রের পক্ষে অধিক সংখ্যক আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া এবং আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট আইন সম্পর্কে নিবিড় প্রশিক্ষণ প্রদান, অধিক রাজস্ব জড়িত এমন মামলাসমূহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত নিষ্পত্তি করা, মামলা দাখিলকারী বাদীর আরজির সফট কপি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে আপলোড করা, মামলার আরজিসহ দাখিল, শুনানি ও রায় সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইড থেকে এনবিআরের সাইটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থানান্তর, সুপ্রিম কোর্টের প্রদত্ত রায় দ্রুত কার্য্কর ও প্রদত্ত নির্দেশনা অন্যান্য ক্ষেত্রেও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, যে সকল মামলায় সরকার পরাজিত হয় ওই মামলাগুলোর আপিল দায়ের ও এনবিআরের মামলা মনিটরিংয়ের জন্য একাধিক অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড (এওআর) নিয়োগ ও নির্দিষ্টকরণ, নির্দিষ্ট বেঞ্চসমূহের প্রতিটির জন্য অন্তত একজন ডিএজি ও এএজি সার্বক্ষণিক নিয়োগসহ ১৫টি প্রস্তাবণা দেওয়া হয়।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে সেমিনারে বিশেষ অতিথি হিসাবে প্রাক্তন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
১৮ নভেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি
�