অল্প বয়সে বিয়ে হলে যা হয়
নিউজ ডেস্ক : গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার মাঠের হাটের গৃহবধূ শ্যামলী। তাকে ১১ বছর বয়সেই মা-বাবা তার বিয়ে দিয়ে দেয়। এখন তিনি দুই কন্যা সন্তানের মা। দুই কন্যার মধ্যে বড়টির বয়স ৭ বছর আর ছোটটির বয়স ৩ বছর। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই প্রথম সন্তানের জন্ম হয় আর দ্বিতীয় সন্তান জন্মের এর আড়াই বছর পর। অর্থাৎ দ্বিতীয় সন্তান জন্ম নেওয়ার সময়ও শ্যামলীর বয়স ১৪ পূরণ হয়নি! শ্যামলীর প্রথম সন্তান সুস্থ হলেও তার দ্বিতীয় সন্তান মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয়। শিশুটি ঠিকমতো কথা বলতে পারে না।
শ্যামলী জানায়, তার স্বামী তার স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখলেও তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন এই ব্যাপারে উদাসীন। এ জন্য সন্তান জন্ম হওয়ার আগেই শ্যামলীর স্বামী তার স্ত্রীকে শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে পাঠিয়ে দেন।
শ্যামলী বলেন, ‘অল্প বয়সে যখন আমার বিয়ে হয় তখন আমি কিছু বুঝতাম না। মা-বাবা বোঝা মনে করে অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয়। এ ছাড়া পাড়া- প্রতিবেশীদেরও ধারণা বেশি বয়সে বিয়ে হওয়া ভালো না। পড়ালেখাও বেশিদূর করতে পারি নাই। এখন বুঝতে পারি কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে হলে নানা সমস্যা হয়। সন্তানেরও ক্ষতি হয়। একই গ্রামের আরেক গৃহবধূ শিল্পী তিনিও একেই কথা বলেন, ১৫ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর একে একে শিল্পী তিন মেয়ের জন্ম দেয়। শিল্পীর তিন কন্যার মধ্যে মেজো মেয়েটি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। শিল্পীর মতে, কম বয়সে বিয়ে হলে মা-সন্তান ঠিকমতো পুষ্টি পায় না। তিনি আরও জানান, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের পার্থক্য বেশি হলে সমস্যাও বেশি হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) স্ত্রী ও ধাত্রীবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. পারভীন আক্তার শামসুন্নাহার বলেন, বাল্যবিয়ের শিকার কন্যাশিশুদের শারীরিক বিকাশ ভালোভাবে হয় না। আগাম সন্তান জন্মদানে মা ও সন্তান উভয়ের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে প্রসবে জটিলতা তৈরি হলে মা ও সন্তান উভয়ের মৃত্যুঝুঁকিও তৈরি হয়। তিনি বলেন, বাল্যবিয়ের ফলে কন্যাশিশুটির বিকাশ যেমন বাধাগ্রস্ত করে তেমনি তার গর্ভজাত সন্তানের বিকাশেও নানা সংকট দেখা দেয়।
দেশের তিনটি জেলাঃ গাইবান্ধা, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামের ৯০০ কিশোরীর ওপর ইনিশিয়েটিভ ফর ম্যারেজ অ্যাডলোসেন্ট গার্লস এমপাওয়ারমেন্ট (ইমেজ) একটি জরিপ চালায়। বিবাহিত কিশোরীদের ক্ষমতায়নের উদ্যোগ প্রকল্পের এই বেজলাইন জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২৫ শতাংশ অপ্রাপ্ত বয়স্ক মা ও শিশুর সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। আর ২২ শতাংশের গর্ভজনিত জটিলতা বেড়ে যায়। মানিকগঞ্জে প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিচর্যার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে ‘নিকেতন ফাউন্ডেশন’। এই ফাউন্ডেশনের প্রধান ম্যারিয়ন এলজেনার বলেন, আমাদের এখানে আসা অধিকাংশ প্রতিবন্ধী শিশুই অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের সন্তান। যে মেয়েরা এই শিশুদের জন্ম দিয়েছে তাদের বয়স ১৩-১৫ বছর। তাদের শরীর শারীরিক ও মানসিক কোনোভাবেই সন্তান জন্মদানের জন্য উপযুক্ত নয়। আর এই কম বয়সী মেয়েগুলো যখন সন্তান প্রসব করছে তখন তাদের অনেকের সন্তানই প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিচ্ছে। নিকেতন ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবন্ধী সন্তানের মা নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, বিয়ের পর এক বছরের মাথায় মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার সন্তান জন্ম নেয়। সে একটি প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম দেয়। কিন্তু নিলুফার এই সন্তান জন্ম দিতে চায়নি। তার স্বামীকে এ ব্যাপারে জানালেও নিলুফার এই ব্যাপারে স্বামীর পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা পায়নি। এই অপ্রাপ্ত বয়স্ক মা এখন অনুশোচনায় ভুগছেন এই ভেবে যে, তার কারণেই হয়তো সন্তানটি স্বাভাবিক হয়ে জন্ম নেয়নি। মেরি স্টোপস বাংলাদেশের চিকিৎসক ডা. রেহানা সরদার বলেন, বাল্যবিয়ের শিকার যে মায়েরা আমাদের কাছে তাদের সন্তানদের নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন কোনোভাবেই এই বয়সে তাদের সন্তান জন্মদান নিরাপদ নয়। কিন্তু তারপরও ঝুঁকি নিয়ে তারা যে নবজাতক প্রসব করছেন তাদের অনেকেই নানারকম প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে।
২০ নভেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/পিবি/পিপি
�