শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০২২, ০২:৪৮:২৩

মাত্র ৬ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে কুয়াকাটা

মাত্র ৬ ঘণ্টায় ঢাকা থেকে কুয়াকাটা

পটুয়াখালী প্রতিনিধি, আবদুল কাইউম: দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। এখানে বছরজুড়ে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের উপস্থিতি থাকে চোখে পড়ার মতো। তবে বিগত দিনে কুয়াকাটায় আসতে পর্যটকদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবে পরিবহন ও পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় পৌঁছা যাবে মাত্র ছয় ঘণ্টায়। এ কারণে কুয়াকাটায় দেশ-বিদেশের পর্যটক বাড়বে বলে জানিয়েছেন তারা। 

এদিকে পদ্মা সেতু চালু হলে কুয়াকাটায় দেশি-বিদেশি পর্যটকদের যে চাপ বাড়বে তা সামাল দিতে এবং সেবার মান বাড়ানো নিয়ে কাজ করছেন হোটেল ও মোটেল মালিকরা। 

পদ্মা ও লেবুখালী সেতুর কারণে সাগর কন্যা কুয়াকাটা পর্যটকদের কাছে সহজ গন্তব্য হবে জানিয়ে বরিশালের বিআরটিসির ডিপো ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পদ্মা ও লেবুখালী সেতুর কারণে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে কুয়াকাটার দূরত্ব দাঁড়াবে ২৮৭ কিলোমিটারে। মাওয়া অ্যাপ্রোচওয়ে হয়ে পদ্মা সেতু দিয়ে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত এই দূরত্ব। এই পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে ছয় ঘণ্টা। 

তিনি আরও বলেন, এই পথ পাড়ি দিতে পাঁচ ঘণ্টার বেশি লাগার কথা না। কিন্তু ভাঙা থেকে কুয়াকাটা সড়কের মধ্যে ৯০ কিলোমিটার রাস্তা সংকীর্ণ হওয়ায় এক ঘণ্টা সময় বেশি লাগবে। 

সেতু চালু হলে পরিবহন বহরে অত্যাধুনিক বাস নামবে বলে জানিয়েছেন পটুয়াখালীর বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি রিয়াজউদ্দিন মির্জা। তিনি বলেন, উন্নত বাস নামাতে বেশ কয়েকটি পরিবহন কোম্পানি আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে। এই রুটে তারা নতুন ‍ও উন্নতমানের বাস নামাতে চায়। আমরা তাদের স্বাগত জানিয়েছি। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি পরিবহন কোম্পানি তাদের কাউন্টার বসিয়েছে। পদ্মা সেতু চালুর পর তারা বাস সার্ভিস চালু করবে।

পটুয়াখালীর সৌদিয়া বাস কোম্পানির কাউন্টার ইনচার্জ গাজী আব্দুস শাকুর বলেন, ফেরি পার হয়ে ঢাকা যেতে ১০ ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। পদ্মা সেতু চালু হলে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে কুয়াকাটায় পৌঁছা যাবে। বর্তমানে ৫০টিরও বেশি বাস কুয়াকাটা থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় যায়। সেতু চালুর পর এই পরিবহনের সংখ্যা আরও বাড়বে। 

পটুয়াখালীর বিআরটিসি বাস কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা মো. জুয়েল জম্মাদার বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে কুয়াকাটার পরিবহন সেক্টরে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। ২৫ জুনের পর থেকে ঢাকা থেকে সরাসরি বিলাসবহুল এসি বাস কুয়াকাটা আসবে। 

পটুয়াখালীর সড়ক ও জনপথ বিভাগ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সেতু চালু হলে কুয়াকাটার নিরবচ্ছিন্ন পরিবহন সার্ভিস মিলবে। এছাড়া ঢাকা থেকে কুয়াকাটার ২৮৭ কিলোমিটারের বেশি সড়ক পাড়ি দিতে ৬ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। 

কুয়াকাটা হোটেলে-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও কুয়াকাটা গেস্ট হাউসের মালিক মোতালেব শরীফ বলেন, আগে ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় আসতে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা সময় লাগতো। এ দীর্ঘ ভ্রমণে পর্যটকরা ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। কিন্তু পদ্মা সেতু চালুর পর মাত্র ছয় ঘণ্টায় ঢাকা থেকে কুয়াকাটায় পৌঁছাবে বাসগুলো। এতে পর্যটকদের সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি ক্লান্তিও কমবে। 

সময় কম লাগার বিষয়ে তিনি বলেন, লেবুখালী সেতু চালু হওয়ায় বরিশাল ও কুয়াকাটার দূরত্ব নেমে এসেছে দুই ঘণ্টায়। এবার পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ঢাকা থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যেই সরাসরি কুয়াকাটায় পৌঁছা যাবে।

পদ্মা সেতুর সুবিধা কাজে লাগিয়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে কুয়াকাটার হোটেল মালিকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, কুয়াকাটায় বর্তমানে ছোট-বড় ১৫০টি আবাসিক হোটেল রয়েছে। এসব হোটেলে ১৫ হাজার পর্যটক আরামে থাকতে পারবেন। পদ্মা সেতু চালুর পর এ সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। পর্যটকের বাড়তি চাপ সামাল দিতে কয়েকটি হোটেল তাদের অবকাঠামো ও সেবার মান বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

তিনি আরও জানান, বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার পর্যটক কুয়াকাটায় অবস্থান করেন। পর্যটন মৌসুমে এ সংখ্যা তিন থেকে চারগুণ বাড়ে। ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতে হাঁটা, সাগরে গোসল করা, গঙ্গামতিসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলে নানা ধরনের পাখপাখালির উপস্থিতি উপভোগ, কুয়াকাটায় সংরক্ষিত রাখাইনদের প্রাচীন কাঠের নৌকা, ঐতিহ্যবাহী ‘মাথিনের কুয়া’, রাখাইন পল্লি ও রাখাইন মন্দির পরিদর্শনের সুযোগ পাচ্ছেন পর্যটকরা। এছাড়া পর্যটকরা কুয়াকাটা সৈকত থেকে পাঁচ কিলোমিটার আগের মিস্ত্রিপাড়ার এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম রাখাইন মূর্তিসহ নান্দনিক ডিজাইনের মন্দির দেখতে পারবেন। 

পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কুয়াকাটা সৈকতে পর্যটকরা স্পিডবোটে করেও ঘুরতে পারেন। সৈকত থেকে ট্যুরিস্ট বোটে করে যেতে পারেন প্রায় ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে ফাতরার বনে। এটি সুন্দরবণের একটি অংশ। এখানে নানা জাতের গাছপালা ছাড়াও রয়েছে হরিণ, কুমিরসহ নানা জাতের বন্যপ্রাণী। সব মিলে পর্যটকরা এখানে পেয়ে যাচ্ছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ফুল প্যাকেজ। 

বাড়তি পর্যটকের চাপ সামাল দিতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন বিভিন্ন হোটেল-মোটেলের মালিকরা। অতিথিদের উন্নত সেবা নিশ্চিতে চলছে পুরনো হোটেল সংস্কারের পাশাপাশি নতুন হোটেল নির্মাণের কাজ। হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট মালিকরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালুর পর পর্যটক কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। সেজন্য হোটেলের কক্ষ, জনবল ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে।

কুয়াকাটার অন্যতম হোটেল সিকদার রিসোর্টের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার মো. আল আমিন বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর কুয়াকাটায় পর্যটকের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। সে অনুযায়ী আমরাও হোটেলে সেবার মান বৃদ্ধিসহ অবকাঠামোর উন্নয়ন শুরু করেছি। আমাদের এখানে আগে ১২টি ভিলা ও ৬৮টি রুম ছিল। বর্তমানে আরও ২০টি ভিলা ও আরও ৩৪টি রুম তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া ১৩-তলা বিশিষ্ট সিকদার টাওয়ার থেকে সরাসরি সমুদ্র, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগের সুবিধা রয়েছে। 

ঢাকা থেকে আগত পর্যটক রিয়াজুল ইসলাম জানান, কুয়াকাটা ভ্রমণের ইচ্ছা থাকলেও এতদিন যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল মূল প্রতিবন্ধকতা। তবে পদ্মা সেতু চালু হলে সেই প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। এক্ষেত্রে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের চেয়ে সড়ক পথে কুয়াকাটায় যেতে সময় কম লাগবে। এতে সময় ও অর্থ দুটোই বাঁচবে। 

কুয়াকাটা ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কে এম বাচ্চু বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর বর্তমানের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পর্যটক কুয়াকাটায় আসবেন। সেজন্য ট্যুর গাইডদের পরিধি বাড়ানো হচ্ছে। তাদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেছি। পাশাপাশি সৈকতকে আরও সুন্দর করারও চেষ্টা চলছে। পর্যটকরা যাতে নির্বিঘ্নে কুয়াকাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন সে বিষয়েও আমরা কর্মীদের উদ্বুদ্ধ ও প্রশিক্ষিত করছি।

কুয়াকাটার সমুদ্র বাড়ি রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল ইসলাম মিরন বলেন, আমরা এখন নির্দিষ্ট সংখ্যক পর্যটক পাই। তবে পদ্মা সেতু চালু হলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে হোটেল রুম, জনবল, সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে।  

ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার (টোয়াক) সভাপতি রুম্মান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, সেতু চালু হলে কুয়াকাটায় পর্যটক আরও বাড়বে। বাড়তি পর্যটকের চাপ সামলানোর জন্য আমরা আশপাশের বাসাবাড়িতেও ‘হোমস্টে’ সার্ভিস চালু করছি। ইতোমধ্যে বাসাবাড়ির প্রায় ৫০০ মালিককে আমরা পর্যটকদের সেবা সম্পর্কিত বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও দিয়েছি। এটি আরও বাড়ানো হবে বলে জানান তিনি। 

ট্যুরিস্ট নৌকা ‘জল তরণী’র মালিক আরিফুর রহমান বলেন, কুয়াকাটায় ঘুরতে আসা পর্যটকদের সৈকতে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি ফাতরার বন ও হরিণঘাটার সংরক্ষিত বনও গুরে দেখতে পারবেন। সেখানে যেতে আমরা ট্যুরিস্ট বোট সার্ভিস দিয়ে থাকি। এর ব্যয়ভারও সাধ্যের মধ্যে। কেউ পুরো নৌকা ভাড়া নিতে পারেন অথবা শীতকালের পর্যটন মৌসুমে আমাদের নিয়মিত ট্রিপেও অন্যদের সঙ্গে সঙ্গী হতে পারেন। 

এদিকে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে কুয়াকাটার হোটেল-মোটেলে পর্যটক আকর্ষণে ৫০ শতাংশ ছাড়ের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সেতু দিয়ে চলার আনন্দ ভাগাভাগি করতে এ বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন হোটেলে-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি ও কুয়াকাটার হোটেল বনানীর মালিক শফিকুর রহমান। 

তিনি বলেন, পর্যটকদের কুয়াকাটা ভ্রমণ আরও আনন্দদায়ক করতেই আমাদের এ বিশেষ উদ্যোগ। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে