বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০২৫, ০১:৪১:৩৮

'বিয়ের মেহেদী হাতেই প্ল্যাকার্ড ধরেছি, টিয়ারশেল খেয়েছি'!

 'বিয়ের মেহেদী হাতেই প্ল্যাকার্ড ধরেছি, টিয়ারশেল খেয়েছি'!

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : ‘বিয়ের মেহেদী তখনও তরতাজা। টকটকে। ফ্যাকাশে হয়নি। অথচ আমি চলে গেছি মিছিলে। বিয়ের মেহেদী হাতেই প্ল্যাকার্ড ধরেছি, টিয়ার শেল খেয়েছি। এই আবেগ আসলে এখন বলে বোঝানো যাবে না। মুক্তির নেশা আসলে আপনার সামনের সবকিছুকে তুচ্ছ করে তুলবে।’

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) বিশেষ আয়োজনে নেয়া সাক্ষাৎকারে জুলাই যোদ্ধা লামিয়া ইসলাম এ কথাগুলো বলেছেন। 

লামিয়া ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি সচেতন।  অনেক কম বয়সেই রাজনীতির জটিল বইগুলো অধ্যয়ন করেছেন। বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক বর্ষে পড়ছেন এবং রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়ের অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তার মতামত তুলে ধরেছেন। 

নারী হিসেবে রাজনীতিতে আসায় কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন?-এমন প্রশ্নের জবাবে লামিয়া ইসলাম বলেন, ‘রাজনীতিতে এসেছি রাষ্ট্র ও শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারের স্বপ্ন নিয়ে। আর এই সংস্কার কেউ এসে করে দেবে না, আমাদের নিজেদেরই সেই সংস্কার করতে হবে। জন্মের পর থেকে আমাদের দেশটাকে যে লুটপাট করা হয়েছে, বলা চলে তা ‘সাংবিধানিকভাবেই স্বীকৃত’। আইনের নানান ফাঁকফোকর ও মারপ্যাচই কাঠামোগতভাবে এই দেশের সরকারকে রাষ্ট্রের সেবক নয়, শোষকে পরিণত করেছে। ফলে এই পুরো ব্যবস্থাপনার সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রটাকে আক্ষরিক অর্থে জনগণের করে গড়ে তোলার জন্য রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছি। আর আমি যখন রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিই, সেই সময়টা বাংলাদেশে চূড়ান্ত ফ্যাসিজমের সময়। কেউ তার নিজের অধিকারের পক্ষে কথা বলতে পারেন না। কেউ কথা বললেই, তাকে ভয়ভীতি দেখানো থেকে শুরু করে নানাভাবে হেনস্তা করা হয়েছে।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার গল্প শোনাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমি আগে থেকেই রাজনীতির মাঠে লড়াই সংগ্রামে যুক্ত ছিলাম। রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে রাজনীতি করি। এর আগে আমরা আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে নানা সময়ে যুগপৎভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছি। কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন শুরু হলো, তখন থেকেই এই আন্দোলনের নেতৃত্বের সঙ্গে সাংগঠনিকভাবেই যুক্ত থেকেছি। আমরা বিশ্বাস করতাম, আমাদের ঐক্যবদ্ধতাই আওয়ামী জাহেলিয়াত থেকে আমাদের মুক্ত করবে। ফলে যখনই আমাদের এমন কোনো সুযোগ তৈরি হয়েছে, আমরা তাতে অংশ নিয়েছি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এমনই একটি প্ল্যাটফর্ম যেখান থেকে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে। এই ছাতা আমাদের এক করেছিল। আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল জুনে। তখন থেকেই এতে যুক্ত থাকি। রাজপথে আসি, মিছিলে যুক্ত হই। নানা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে সর্বদা যোগাযোগ রাখি। এই আন্দোলন চলাকালেই আমার বিয়ে হয়।’

লামিয়া বলেন, ‘আমি বিয়ের দুদিন পর আন্দোলনে যুক্ত হইনি বরং বিয়ের জন্য দুইদিন বিরতি নিয়েছিলাম। আমি আন্দোলনের শুরু থেকেই ছিলাম। ১২ জুলাই আমার বিয়ে হয়। তার আগে আমি বিয়ের কেনাকাটা করে শপিং ব্যাগ হাতে নিয়েই মিছিল করেছি। ব্লকেড কর্মসূচি পালন করেছি। বিয়ে এবং তারপরের দিন আমি সশরীরে আন্দোলনের মাঠে থাকতে পারিনি। অনলাইনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সরব ছিলাম। বিয়ের দুইদিনের মাথায় আর রাস্তায় না নেমে থাকতে পারিনি। আপনি নিশ্চয় জানেন, একজন নববধূর পক্ষে শ্বশুরবাড়ি থেকে এই সময়টা বের হওয়া কতটা কঠিন। ফলে আমাকে শ্বশুড়বাড়ি থেকে মিথ্যা অযুহাত দিয়ে বের হতে হতো। এ ব্যাপারে আমার বরের সহযোগিতা পেয়েছি। বিয়ের মেহেদী তখনও তরতাজা। টকটকে। ফ্যাকাশে হয়নি। অথচ আমি চলে গেছি মিছিলে। বিয়ের মেহেদী হাতেই প্ল্যাকার্ড ধরেছি, টিয়ার শেল খেয়েছি। এই আবেগ আসলে এখন বলে বোঝানো যাবে না। মুক্তির নেশা আসলে আপনার সামনের সবকিছুকে তুচ্ছ করে তুলবে।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এই নেত্রী বলেন, ‘ওই সময়টা খুবই অস্থিরতার ভেতর দিয়ে গেছে। তখন পুলিশ ছাত্র দেখলেই তাদের মোবাইল ফোন চেক করতো। আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা তা দেখতো। তখন একটা কৌশল নেয়া শুরু করি। বাসা থেকে যখন বের হতাম, ফোন ফ্ল্যাশ মেরে বের হতাম। আর একটা কাগজে নিজের নাম, মায়ের ফোন নম্বর, হাসবেন্ডের ফোন নম্বর ও বাসার ঠিকানা লিখে নিতাম। আমি তো জানি না, বেঁচে ফিরবো কিনা। দেখা গেল গুলি খেয়ে রাস্তায় আমার মরদেহ পড়ে আছে। কমপক্ষে মরদেহটা যেন আমার পরিবার পায়, এ জন্য এটা করতাম।’

তিনি বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকটি সংগঠন মিলে ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্যে ছিলাম। কিন্তু জুলাই আসলে সবকিছু থেকে আলাদা ছিল। মানুষের ভেতর ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। এখানে আসলে আমাদের আন্দোলনটাকে শুধু কন্টিনিউ করে যেতে হয়েছে; আর কিছু না। আমরা জানতাম, যদি আমরা মাঠে ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারি; তাহলে আরও বেশি মানুষ এতে অংশগ্রহণ করবেন। রাস্তায় নেমে আসবেন। ছাত্রলীগ-যুবলীগ-আওয়ামী লীগের নির্যাতন-নিপীড়ন আর আন্দোলন দমনে তাদের যে দুর্বৃত্তায়ন- তা যেকোনো মানুষকেই ছুঁয়ে গেছে। মানুষ তার সন্তানকে রক্ষা করার জন্য মাঠে নেমেছে, বোন তার ভাইকে রক্ষা করার জন্য মাঠে নেমেছে। এই যে মানুষের স্রোত নামতে শুরু করেছিল, তা আটকানোর ক্ষমতা কারো ছিল না। আন্দোলনের ক্ষেত্রে সশস্ত্র হামলার বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ানোটাই কাজে লেগেছে। আপনি সাহস করে দাঁড়িয়ে থাকবেন, দেখবেন আপনার সঙ্গে এসে অনেকে দাঁড়িয়ে গেছে। আপনি তাদের ধাওয়া দিতে গিয়ে দেখবেন কোথা থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে আপনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।’

জুলাইয়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ২ আগস্ট শাহাবাগে একটা সংঘর্ষের মধ্যে পড়ি। সেখানে গুলি করা হচ্ছিল। আমার চোখের সামনেই দুজন মানুষ রাস্তায় পড়ে গেল। চোখের সামনে মৃত্যু। সেই দৃশ্য এখনো মনে পড়লে শিউরে উঠি।’
 
লামিয়া ইসলাম বলেন, ‘আমরা আসলে জনগণের রাষ্ট্র গড়তে চাই। এমন একটা রাষ্ট্র যেখানে সরকার আইনের ঊর্ধ্বে না বরং এমন আইন করতে হবে যেন যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের জবাবদিহিতে বাধ্য করা যাবে। ক্ষমতা কোনো একক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত থাকবে না। যেন কেউ চাইলেই টাকা পাচার করতে না পারে, নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। নারী, পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ, জাত নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জন্য যেন একটি নিরাপদ দেশ গড়তে পারি। প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে সরকার। মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে। রাজনীতি থাকবে তবে তা যেন ক্যাডারভিত্তিক না হয়। ক্ষমতাবান হবেন নাগরিকরা। জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র কাঠামো নির্মাণ করতে পারলেই আমরা আসলে সত্যিকার অর্থে একটা নাগরিকবান্ধব রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে পারবো।’

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের একটি বড় প্রত্যাশা ছিল, রাষ্ট্র ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। পুরোনো ব্যবস্থাপনা বাতিল, জনবিরোধী বিধিবিধান বাতিল, ভেঙে ফেলা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন। তবে এসবের বাস্তবায়ন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। তবে সময় এখনো শেষ হয়নি। অবিলম্বে জুলাইয়ের আহতদের সার্বিক চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং জুলাই সনদ দিতে হবে। সংবিধান ও আইনি কাঠামোর সংস্কার করতে হবে। ফ্যাসিবাদের বীজ যেখানে আছে তা উৎখাত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সেইসঙ্গে বর্তমান সরকারকেও তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের বিষয়ে জনগণের সামনে জবাবদিহি করতে হবে।’

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে